// লীলাবতী **** পূর্বা মাইতি

// লীলাবতী

পূর্বা মাইতি

এই গল্পটা কোন হাড়-হিম করা ভূতের গল্প নয়, বা কোন সাসপেন্স থ্রিলার, এটা নিতান্ত মামুলি ঘরের এক রমণীর কথা ,যার কথা শুনতে শুনতে , দু-চোখ খালি রাখা দায় হয়ে ওঠে,যাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলো ….ভিজে শ্রাবণের বেলা ….
ছোটবেলায় দেখতাম লীলাবতী পিসি তাঁর নাতিকে নিয়ে ,মাঝে মাঝে আমাদের বাড়ি আসতেন | এক-পক্ষ কাল, দুই পক্ষকাল থাকতেন | বাড়ির সবার পছন্দের পাত্রী ছিলেন |মা-ঠাকুমার কাজের ভাগীদার হতেন | তিনি নানান গুণের গুণী ছিলেন ,তাই সম্পর্কটাকে নিজ গুণে অনেক দূর থেকে কাছে আনতে পেরেছিলেন |হয়ে উঠেছিলেন আমাদের আপন পিসি |তিনি যখন চাটাই বুনতেন বা দড়ি তাকাতেন ,বা শুয়ে শুয়ে পান চিবোতেন–তখন আমরা ভাইবোনেরা পড়াশুনো কাট মেরে ,পিসির কাছে গল্প শুনতে চাইতাম | লীলাবতী নাছোড়বান্দাদের গল্প শোনাতেন ….আপনমনে ….
লীলাবতীর এক কাকা ছিলেন –আজন্ম পরোপকারী,অকৃতদার এবং খুব বুদ্ধিমান |তাঁরই বুদ্ধির নমুনা,পিসি আমাদের মাঝে মাঝে শোনাতেন | আমরা সেই কাকার কথা শুনতে শুনতে, মানসপটে একটা অবয়ব তৈরি করে নিয়েছিলাম এবং ভেবেছিলাম, আমরা প্রত্যেকেই ঐ কাকার মতো হবো |কাকার আমল ছিলো –ইংরেজ শাসনাধীন | প্রতি পদে চলতে গিয়ে বাধা | স্বাধীনচেতা মানুষ, কোনমতেই মেনে নিতেননা কোন হুকুমজারি | তিনি প্রায়ই কাউকে কিছু না বলে, হঠাৎ গায়েব হয়ে যেতেন | আবার হঠাৎই বাড়ি ফিরে আসতেন | এরকম একবার গায়েব হবার পর , বাড়ি ফিরলেন এক বাউলকে সংগে নিয়ে | বাউল ,কাকার বাড়ি এসে সন্ধ্যায় আখড়া জমিয়ে –সবার নজর কেড়েছিলেন | কিছুদিন পর হঠাৎ বাউল-সমেত কাকা উধাও | পরে ,পুলিশ বাড়িতে এলে জানা যায়, বাউলটি এক বড় বিপ্লবী ছিলেন |গা ঢাকা দিয়ে , কাকাই তাঁকে এ-বাড়িতে থাকতে সাহায্য করেছিলেন |এরকম অনেক ঘটনার জন্য , কাকা তৎকালীন পুলিশের নজরে পড়েন |
লীলাপিসির ছোটবেলায় পানীয়জল বাড়ির কাছাকাছি পাওয়া যেতোনা |দূর-দূরান্ত থেকে কলসি ভরে জল আনতে হোত | কোন এক বিকেলে পিসি যখন অন্যান্যদের সংগে জল আনতে যাচ্ছে , তখন পিসির কাকাও ওদের সংগে জল আনতে গেল | জল নিয়ে বাড়ি ফেরার পর ,মহিলারা লক্ষ্য করলেন যে ,একটি কলসি তাঁদের বাড়ির নয় | মাটির কলসি ওই জল ভরার কাছে পাল্টে গেছে | ছেলে-মেয়েরা গালগল্পে ব্যস্ত থাকার জন্য কেউ খেয়াল করেনি |কিন্তু আসল গল্প অন্যখানে –কাকা কোন বিপ্লবীর দরকারি জিনিস কলসিতে ভরে পাচার করে দিয়েছিলেন | এমনি খণ্ড খণ্ড কাকার কত গল্প –যেগুলো আমাদের সন্ধ্যার মনোরঞ্জন হয়ে উঠতো, অথচ পরাধীন ভারতবর্ষে যার মূল্য অসীম ,ইতিহাসের পাতায় নাম না থাকা, দশের কাছে- দেশের কাছে–যিনি কোন কিছু প্রত্যাশা না করে,দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করে দেন ,সেই মহান দেশপ্রেমিককে যদি বিপ্লবী বলে ডাকি …
ইতিহাস কি মুখ ফিরিয়ে নেবে ….
এ-হেন কাকার ভাইঝি হলেন লীলাবতী পিসি | ঠিক কত বছর বয়সে পিসির বিয়ে হয়, সে খবর আমার জানা নেই | আগেকার দিনের বাচ্চাদের,এখনকার বাচ্চাদের মতো এতো প্রশ্ন ছিলোনা |মুখে মুখে কথার পিঠে কথা বসানোকে– বড়রা তর্কবাজ বলে একটু বাঁকা চোখে দেখতেন | যে মুখ বন্ধ করে,দোর বন্ধ করে, জীবনে দম বন্ধ করে বাঁচতে জানে — তারাই লক্ষ্মীশ্রী এ্য।ওয়ার্ড় পেতো !
শুনেছি, লীলাবতীর বিয়ে হয়েছিলো– কোন এক দোজবরের সঙ্গে |তাঁর একটি সদ্যমাতৃহারা দুধের শিশুও ছিলো | শিশুটির অকালে মাতৃবিয়োগের ফলে, বিকল্প মায়ের প্রয়োজন হয়ে পড়ে –এক্ষেত্রে লীলাবতী মনোনীত হন | নববধূর ওপর শ্বশুরালয়ে অন্যান্য কাজের সঙ্গে সঙ্গে , মাতৃহারা শিশুটির মাতৃবৎ দেখভালের দায়িত্বও বর্তায় | নানান কাজের ভিড়েও, নতুন মায়ের ভালোবাসায় –খোকা মা ডাকতে শিখে গেলো |এরপর, লীলাবতীও স্বপুত্রের জননী হয়ে উঠলো | দুই সন্তানকে নিয়ে এগিয়ে চললো — লীলাবতীর বারোমাস্যা |
ঋতুচক্রে ঘুরতে ঘুরতে এলো সেই ডাকাত শ্রাবণ,সঙ্গে নিয়ে এলো বুক ভরা ঝড়-জল ! এরকম এক ঝড়-জলের সন্ধ্যায় ,অন্যান্য জায়েদের মতো , পিসিও বাচ্চাদের নিয়ে হিমসিম খেতে লাগলো |শ্রাবণের জল আকাশ ভেঙে ঝরতে ঝরতে ,প্রবল আকার ধারণ করলো …
ধেয়ে এলো বন্যা |বাড়ির কর্তা প্রমাদ গুণলেন |
মাটির বাড়ি | দেওয়াল চাপা পড়ে , মরার শঙ্কা থাকে |সুতরাং বাড়ির বাইরে থাকাটাই শ্রেয় |যা কপালে আছে ঘটুক | ভবিতব্য কে খণ্ডায় !
প্রত্যেক জায়েরা কোলের শিশুটিকে কোলে নিলো আর বাড়ির পুরুষেরা বড় ছেলেপুলেদের আগলে , ঘরের বাইরে বেরলো |
বাদ সাধলো খোকা |লীলাবতী যেই নিজের ছেলেকে কোলে নিতে যাবে , অমনি খোকা মাকে জড়িয়ে ধরে,প্রবল স্বরে মা-মা বলে কাঁদতে লাগলো | ও ততদিনে একটু বড় হয়েছে |কিন্তু ও কিছুতেই মায়ের কাছ ছাড়া হতে চাইলোনা | বন্যার জল পাগলপারা | হু হু করে ঘরে ঢুকতে লাগলো ….| তাড়াহুড়োর মধ্যে লীলাবতী খোকাকে কোলে নিয়ে , নিজের সন্তানকে স্বামীর কোলে ঠেলে দিলো !
প্রবল বন্যায়, সে অন্ধকার রাতে — কে যে কোথায় ভেসে গেলো, তার হিসেব দু’দিন পর পাওয়া গেলো | কোন এক গাছের গুঁড়িতে , খোকাকে জড়িয়ে লীলাবতী আটকে ছিলো | মা-ছেলের যখন হুঁশ ফিরলো , ধীরে ধীরে পরিবারের সকলকে পেলো …. পেলোনা শুধু নিজের স্বামী আর সন্তানকে !
যে নাতিটিকে নিয়ে লীলাবতী আমাদের বাড়ি আসতেন, সে তাঁর সতিন-পুত্র খোকারই সন্তান | মা’র মুখে শুনেছি ,জীবনে খোকার বিরূদ্ধে পিসির কোনো অভিযোগ ছিলোনা | হয়তো তিনি মনে করতেন …. তাঁর মাতৃত্বেরতো অপচয় হয়নি ….

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *