আত্মজা ———– ধারাবাহিক উপন্যাস অধ্যায় -১৯ সুদেষ্ণা সিনহা

আত্মজা
———–
ধারাবাহিক উপন্যাস
অধ্যায় -১৯
সুদেষ্ণা সিনহা
ভাকুড়ী ১ গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীনে চুঁয়াপুর সমৃদ্ধ গ্রাম। চাকরি পাবার পর পরই এখানেই রামকৃষ্ণ পল্লীতে দুই কাঠা জায়গা কিনে রেখেছিল স্বাধীনতা নিজের নামে।
ছোট থেকেই ইচ্ছে ছিল চাকরি পেলে বাবার হাতে রোজকারের টাকা তুলে দেবে সে। তার সেই ইচ্ছে পূর্ণ হয়নি।
আলিপুরের হেস্টিংস কলেজে বি পি এড ফাইনাল থিওরি পরীক্ষার মাসখানেক বাকী। হোস্টেলের ঘরে পড়াশোনা করছিল স্বাধীনতা।তখনই বাবার মৃত্যু সংবাদের টেলিগ্রাম এসেছিল।
চিরকাল বাবার আদর্শে বড় হওয়া মেয়েটার পায়ের তলার মাটিটা কেঁপে উঠেছিল সেদিন।
দশ দিনে শ্রাদ্ধের কাজ সেরে যখন হোস্টেলে ফিরেছিল স্বাধীনতা,তখন মনে মনে পিতৃশোককে কাটিয়ে উঠতে চেয়েছিল এই ভেবে যে মৃত্যু মানুষটার প্রাণটাকে ছিনিয়ে নিলেও সেই মানুষ বেঁচে থাকে তাঁর আদর্শের মধ্যে। সুতরাং যে মানুষের আদর্শ আছে সে কোনদিন মরে না,কোনদিন মরতেই পারে না।আদর্শই তাঁকে অমর করে রাখে চিরকাল।
অলোকের সাথে বিয়ের পর জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেও স্বাধীনতার জীবনে জবা এসেছে।জবাই তাঁর বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন।জবা আসার পর স্বাধীনতার মনে হয়েছে চুঁয়াপুরের রামকৃষ্ণ পল্লীর জমিটুকুতে একটা আস্তানা গড়ার প্রয়োজন আছে।
ভিত খুঁড়ে প্রথমে একতলার শুরু,সামনে ছোট্ট বাগান। অনেক ভেবেচিন্তে স্বাধীনতা নাম দিয়েছিল–‘নিরালায়’।
অলোক হেসেছিল ।ব্যঙ্গ করে বলেছিল,আর নাম মনে এল না বুঝি ?
এখন অলোককে অনেকটা বুঝে গেছে সে। অলোকের যে কথা বা আচরণ ভাল লাগে না,সেগুলোতে ভুলেও মত দেয় না। বরং উপেক্ষা করে।
মনে মনে বলে,অলোক,তুমি কি আমার মনের খোঁজ রাখ? নিরালায় যে আমার আসল ‘আমিটা’ বেঁচে থাকবে।
বেশ কয়েক বছর পরে হাতে কিছু টাকা জমতেই ধীরে ধীরে ‘নিরালায়’ দোতলা উঠেছে।
অলোককে কোনদিন কোন বিষয়ে জোর করে না স্বাধীনতা। বাড়ির ব্যাপারেও কোন জোরজবরদস্তি নেই। ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে হাতে দিলে অলোক বালি,সিমেন্ট,মিস্ত্রীর ব্যবস্থা করে। কোথায় জানলা ,কোথায় দরজা,বারান্দা থাকবে কি থাকবে না,দেওয়াল দশ ফুট না বারো ফুটের এসব বিষয় অলোকই ঠিক করে।স্বাধীনতা শুধু ভাবে ‘নিরালায়’ তার অস্তিত্বটুকু টিঁকে থাক।
অলোকের দুই বোন,টিঙ্কু,মুন্নির বিয়ে হয়ে গেছে। অলোকের মা কৃষ্ণনগরে স্বামীর ভিটে ছেড়ে আসতে চাননি । জবার অন্নপ্রাশনের সময় অলোককে বলেকয়ে শাশুড়িমাকে জোর করে এই বাড়িতে আনিয়েছিল স্বাধীনতা।তখনই আবদার করেছিল সে,মা আর কিছুদিন থাকো।
সে সময় স্কুল ছুটি নিয়ে শাশুড়িমাকে নিজের হাতে রান্না করে খাইয়েছিল স্বাধীনতা।পঞ্চানন তলা পেরিয়ে বিষ্ণুপুর কালিবাড়ি,ডাহাপাড়ায় জগদ্বন্ধু ধামের ঠাকুর মন্দির দেখিয়েছিল সে।
খুব আনন্দ পেয়েছিলেন বিমলাদেবী।দিন পনের থেকেছিলেন ছেলে-বউ এর কাছে।
শাশুড়িমা যতদিন বেঁচেছিলেন তাঁর কাছে চায়নাদি থাকত।গত বছর শাশুড়িমা মারা যাবার পর কৃষ্ণনগরের বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছে অলোক।তাদের দুজনের এদিকেই চাকরি।শুধু শুধু অত বড় বাড়ি রেখে লাভ কি? জানলা,দরজা বন্ধ করে বাড়ি পড়ে থাকলে রোদ,হাওয়া না পেয়ে দেওয়াল স্যাঁতস্যাতে হয়ে নষ্ট হবার ভয়। খালি বাড়ি পড়ে থাকলে কখন কে দখল করে নেয়— সে ভয় ও আছে। আবার বাড়িতে ভাড়াটে বসালে,সে উঠবে কি উঠবে না– নানা চিন্তা।সুতরাং মা মারা যেতেই বাড়ি বিক্রির নোটিশ দিয়েছিল অলোক। আশেপাশে পাড়া-প্রতিবেশীকে বলেও রেখেছিল।
স্বাধীনতা শুনেছে, কৃষ্ণনগরের বাড়িটা বেশ চড়া দরেই বিক্রি হয়েছে । সেই টাকা অলোক ব্যাঙ্কে রেখেছে না কি করেছে জানে না স্বাধীনতা। টাকা -পয়সার ব্যাপারে অলোক কিছু বলতে চায় না তাকে। এই সবে কোন মাথা ব্যথাও নেই স্বাধীনতার। নিজের রোজগারে চলে যায় মা-বেটির।যেটুকু টাকা বাঁচে তাতে একটা রেকারিং ডিপোজিট করেছে নিজের নামে,নমিনি জবা।
জবাকে নিয়ে কতরকম ভাবনা আসে মনে!শরীরের কথা কি বলা যায়! হঠাৎ তার কিছু একটা হয়ে গেলে অলোক দেখবে তো মেয়েটাকে!
একই বাড়িতে বাস,নিজের আত্মজা,তবুও এ কেমন বাবা যে নিজের মেয়েকে ছুঁয়েও দেখে না! আর কত মানুষকে চিনবে সে!
জবার পাঁচ বছর হতেই তাকে স্কুলে ভর্তির চিন্তা মাথায় ঢুকেছিল স্বাধীনতার।অলোক নির্বিকার।এ কোন্ মানুষকে সে জীবনসঙ্গী করেছে?
বছর শুরু হতেই একদিন স্বাধীনতা অলোককে বলেছিল,জবার পড়াশোনার ব্যাপারে ভেবেছ কিছু?পাঁচ বছরে পড়ল মেয়েটা।কোন্ স্কুলে ভর্তি করবে ?
অলোক কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বলেছিল ,দেখ কি করবে!
—- মেয়েটা তো তোমারও!
—- তোমার কি সে কথা মনে থাকে?
অলোকের সাথে তর্ক করতে ভাল লাগে না স্বাধীনতার।
এবার সরস্বতী পুজোয় পুরোহিত ডেকে জবার হাতে খড়ি দেওয়া হয়েছে।
সরস্বতী ঠাকুরের সামনে শ্লেটে পেন্সিল দিয়ে পুরোহিত মশাই লিখে দিয়েছেন “অ,আ,ক,খ”।
পেন্সিল জবার হাতে। স্বাধীনতা ওর আঙুলগুলো ধরে বর্ণের উপর দিয়ে বুলিয়ে দেয়।সরস্বতী ঠাকুরের সামনে গড় হয়ে প্রণাম করে স্বাধীনতা।প্রার্থনা করে — মা, আমার মেয়েকে বিদ্যা দাও।বুদ্ধি দাও।বিবেক দাও।চরিত্রবতী কর।বাবার মতো যেন কাপুরুষ না হয় মা,এই আশির্বাদ কর তুমি।
জবার স্কুল বাড়ির কাছেই।সরকারি প্রাইমারি স্কুল।শিবশঙ্কর দাস প্রধান শিক্ষক।স্কুলের গেট খুললেই মাটির রাস্তা সামনের পাকা স্কুলঘর অবধি ,দুই ধারে টগর,বেলি,জবা,নয়নতারার গাছ।সামনে তিনটে পাকা ঘর টু,থ্রী আর ফোরের জন্য।ঘরগুলোর সামনে প্রশস্ত বারান্দায় ওয়ান আর শিশু শ্রেণির ক্লাস,চাটাই এর বেড়া দিয়ে ঘিরে ক্লাসগুলো আলাদা করা হয়েছে। স্কুল বসে এগারটায়,তার আগে প্রার্থনা সভা। স্কুলে শিবশঙ্করবাবু ছাড়া আরো একজন শিক্ষক ও শিক্ষিকা আছেন।
জবাকে স্কুলে ভর্তি করবে বলে ছুটি নিয়েছিল স্বাধীনতা।মেয়ে কোনদিন বাড়ির বাইরে যায়নি।যদি নতুন পরিবেশে ভয় পেয়ে কান্নাকাটি শুরু করে। সে অলোককেও থাকতে বলেছিল সেদিন।
মানুষটা এত নির্মম! পাঁচটা নয় দশটা নয় একটাই সন্তান।
তবুও মুখের উপর সে কিনা বলে দিল, না আমি থাকতে পারব না। আমার গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে।
আর কোন কথা বাড়ায়নি সে । স্বাধীনতা সিদ্ধান্ত নিয়েছে,জবাকে মনে মনে কোন কষ্ট পেতে দেবে না সে। মা হয়ে নিজেই সে তার মেয়েকে মানুষ করবে । তার স্বপ্ন ,জবা বড় হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াবে।
পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথেই জবার স্কুল। তবে এখন জবা আছে সঙ্গে।তাই স্বাধীনতা মোড়ের মাথা পৌঁছে একটা রিক্সাওয়ালাকে ডেকে নিল। জবা খুব খুশী। এখনও স্কুল থেকে কোন ইউনিফর্ম দেয়নি ।স্বাধীনতা ওকে ‘আবরণী ‘থেকে কেনা পুজোর লাল ফ্রকটা পরিয়েছে। কপালে চুল চাইনিজ কাট করে কাটানো।নিজের মেয়ে বলে নয়।মেয়েটা ওর পিসিদের মতো সুন্দরী।কি মিস্টি যে লাগছে জবাকে!
পুষ্প দিদিমণি শিশু শ্রেণীর ক্লাস নেন।
দিদিমণি জিঞ্জেস করলেন,তোমার নাম কি?
জবা চটপট উত্তর দিল,আমার নাম আত্রেয়ী সান্যাল।
জবা বেশ সপ্রতিভ অন্য বাচ্চাদের তুলনায়।
দিদিমণি বেশ খুশী। জিঞ্জেস করলেন, তোমার ভয় করছে না তো?
—না তো।মাথা নাড়ায় জবা।
—– কাল আসছো তো?
——- আসব তো। জবা হাসে।
স্কুলের বারান্দা পেরিয়ে মাঠে নামতেই কে যেন ডাকে,দিদি।
পিছন ফেরে স্বাধীনতা।কে এ?
রোগা ,ছিপছিপে গড়নের ,মিস্টি মুখশ্রীর একটা বউ। ফর্সা মুখখানায় কি এক আকর্ষণ আছে। আর একবার তাকাতেই মায়াবী চোখদুটো বেশ চেনা চেনা লাগে স্বাধীনতার।বউটির হাত ধরে আছে জবার বয়সী একটা বাচ্চা মেয়ে। নাহ্ বাচ্চাটাকে দেখেনি কোথাও। স্বাধীনতা ভাবে,কোথায় যেন দেখেছি!কোথায়!কোথায়! মনের মাঝে আলোড়ন চলে।
বউটি বলে, মনে পড়ছে না দিদি।আমি বুলটি মন্ডল।আমি,পপি,মাধবী,কল্যানী সব একসাথে পড়তাম।…..মনে পড়ছে? আপনি আমাদের স্কুলে এলেন সেবার।ডিসকাস থ্রোতে ডিস্ট্রিক্টে ফার্স্ট হয়েছিলাম।আপনি বাড়িতে বাবাকে বোঝাতে গেছিলেন….
মনে পড়ে স্বাধীনতার। বুলটি। বাপরে একেবারে গিন্নীবানি হয়ে গেছিস তুই ! আমি চিনতেই পারিনি রে। তবে তোর চোখদুটো সেই একই রকম আছে।কবে দেখেছি,বল! আট বছর আগে! তখনকার ফ্রকপরা মেয়েটা এখন শাঁখা-সিঁদুর-শাড়ি……চেনা যায়? কোথায় থাকিস এখন?
–‐–এই তো এই মোড়টা পেরিয়ে বাঁদিকের রাস্তা,লোকনাথ পল্লীতে।
—- এখানে শ্বশুরবাড়ি?
—– না ত্রিমোহিনীতে শ্বশুরবাড়ি।এখানে আমার বর জায়গা কিনে বাড়ি করেছে।
—–তোর বর কি করে?
—–ফৌজদারি কোর্টে মুহুরি।
বুলটির চোখ পড়ে জবার দিকে। এটা তোমার মেয়ে দিদি? কি নাম?
—- হ্যাঁরে ।ওকে জবা বলে ডাকি।তো ওটা তোর মেয়ে বুঝি?
—- হ্যাঁ।বুলটি মেয়েকে বলে,এই স্কুলে তোর যেমন ম্যাম আছে,এই দিদিও আমার ম্যাম।প্রণাম কর।বুলটি,বুলটির মেয়ে দুজনেই স্বাধীনতাকে প্রণাম করতে গেলে স্বাধীনতা ওদের বুকে চেপে ধরে।
জবা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে বুলটি আর তার মেয়েকে। স্বাধীনতা বলে,জবা এটা তোমার বুলটিমাসি।বুলটিমাসিকে প্রণাম কর।আর এটা তোমার নতুন বন্ধু।
বুলটি বলে,দিদি তুমি এখন কোথায় থাক?রামকৃষ্ণপল্লী না কোথায় যেন বাড়ি করেছিলে,সেখানেই?
— হ্যাঁরে।একদিন আয় না। শিবমন্দিরের পাশে মাঠ আছে না,তার পাশেই দোতলা বাড়ি।আমার নাম বলবি।জবার বাবার নাম বললেও হবে….অলোক সান্যাল।
—-অলোক সান্যাল ? আমার শ্বশুরবাড়ির ওখানের স্কুলের টিচার?
—-তুই কি করে চিনলি?
—- সে অনেক কথা।পরে বলব তোমাকে। আমাদের বাড়ি এসো একদিন।লোকনাথ পল্লীতে নেমেই যে রাস্তাটা গেছে।ওখানে বলবে সমর বিশ্বাসের বাড়ি যাব।ওর বাবাকে সবাই চেনে।
স্বাধীনতার বুকের ভিতরটা ঢিপ ঢিপ করে। বুলটিদের শ্বশুরবাড়ির গ্রামে অলোকের ঘটনা সবাই জানে নাকি!ঠাকুমা বলতেন,খারাপ কথা তাড়াতাড়ি ছড়ায়।
জবার আজ খুব আনন্দ হচ্ছে। অলোক স্কুল থেকে ফিরলে জবা ছুটল তার বাবার কাছে।
—– জান বাবা,তোমাদের মতো আমারও স্কুল আছে। আমার একটা দিদিমণিও আছে।খুব ভালো।তুমি আমার স্কুলে যাবে কাল?
পেপার পড়তে পড়তে অলোক এক পলক তাকায় জবার দিকে।
—- ও বাবা? জবা অলোকের মনোযোগ আকর্ষণ করে।
—- কি বলছিস? অলোক বিরক্ত চোখে তাকায়।
—– আমার একটা ফ্রেন্ড আছে।একটা মাসিও আছে।বাবা,শোনো না।
অলোক বিরক্ত হয়।
—– যা তো এখন খবরের কাগজ পড়ছি।পরে আসবি। যাহ্।
ভয়ে ভয়ে জবা মায়ের কাছে চলে যায়।অলোক আবার খবরের পাতায় মন দেয়।