শিরোনাম : ঝিলিক-টিলিক কলমে: সাহানা

শিরোনাম : ঝিলিক-টিলিক
কলমে: সাহানা
ঝিলিক একটু অবাক হলো! একি রে বাবা! পুচকু, টিনা, পাখি সবাই যে বললো আজ বিকেলে প্রি-হোলি-র পার্টি! সেইমতো সব্বাই পুরনো জামা-টামা পরে মুখে ক্রিম ঘষে চট্ করে চলে আসবে মিত্তিরদের বাগানে। ন্যাড়াপোড়াও হবে। কাগজ-কুড়ানি পাখি কাঠকুটো, পাতা জমিয়ে রেখেছে!
আসল দোল তো আগামীকাল! তখন যদি কেউ না আসে তো ঝিলিক মজা দ্যাখাবে!
বাজেশিবতলার ওপাশে একটা রাস্তা চলে গিয়েছে খেয়াঘাট অবধি। পাড়া থেকে বিপানকাকু, সুরেনমামা টিফিনের ডিবে ঝুলিয়ে রোজ অফিস যায় ওখান দিয়ে! বিকেলে, সূর্যটা যখন লাল-কমলা আলোয় রেঙে ওঠে, ওরা একে একে ফেরে। ছোটাছুটি করে খেলতে খেলতে ঝিলিক দ্যাখে ওদের!
কিন্তু, সে নাহয় হলো! এখন কি করা যায়! মিত্তিরদের বাগানটা বেশ ঝুপসি। আশেপাশর জমিতে অনেক বাড়ি হয়েছে কিন্তু এইটা থেকে গিয়েছে একরকমই। সবাই বলে, মিত্তিরকাকা বিদেশে চলে গিয়েছে, জমি-টমিতে উৎসাহ নেই।
বুড়ো ছাতিমগাছের নীচে পাথরের একটা বেদী আছে। ওর ওপরেই বসে ঝিলিক। চাদ্দিকে বেশ একটা ঘন ছায়া-ছায়া ভাব। বেশ লাগে।
আচমকাই ওপাশের ঘন গাছের মধ্যে থেকে কি যেন নড়ে ওঠে! কি ওটা?
ঝিলিক চমকে ওঠে!
একটা মেয়ে! অনেকটা তার মতোই! ফ্রকখানাও পরেছে একরকম প্রায়! ঝিলিকের লাল ফিতে, ওরটা নীল!
-“কে তুমি?”
মেয়েটি হাসে! ভারী মিষ্টি হাসি!
-“আমি টিলিক! ”
-“ওমা! বলে কি! এরকম নাম হয় নাকি?”
নিম, জারুল, কৃষ্ণচূড়া, কাঁঠাল ইত্যাদি প্রাচীন গাছের জমজমাট ছায়ায় টিলিক যেন একখানা জলরঙের ছবি!
-“তুমি কোথায় থাকো? আগে দেখিনি তো!”
উত্তর দ্যায় না মেয়ে!
এগিয়ে আসে চুপচাপ।
ওর জামার কোঁচড়ে কি যেন মুড়ে রেখেছে!
-“এই! কী নিয়েছো দেখি!”
-“খাবে?”
বলেই একখানা পেয়ারা বের করে।
“ওই, ওদিকের গাছে হয়েছে!”
ঝিলিকের এবারে বেশ রাগ হয়!
“তুমি কে বলোতো! বাগানে ঢুকে পেয়ারা পাড়ছো!”
এই অনধিকার প্রবেশ ঠিক মেনে নিতে পারে না!
“আমি টিলিক। এখানেই থাকি।”
“বটে! আগে তো দেখিনি।”
“দেখবে কি করে! আমি তো জলের তলায় ছিলুম।”
“সে আবার কি! জলের তলায় মানে?”
“মানে,ওই যে ওখানে একটা কুয়ো আছে না!”
বিলক্ষণ জানে ঝিলিক। কুয়ো একটা আছে বটে। মানে, ছিল। এখন সেটা মাটি দিয়ে বুজিয়ে দেওয়া হয়েছে। বহুদিন! একখানা পোড়ো ঘর-ও আছে! ছোটদের ওদিকে যাওয়া বারণ! মা-বাবা পইপই করে বলেছেন।
তাতে কি! ঝিলিক কি ছোট নাকি? রীতিমতো সিক্সথ্ স্ট্যান্ডার্ড! ক্যারাটেও শিখছে।
“ঠিক করে বলো। কোথায় থাকো তুমি?”
বেশ কড়া গলায় বলতে চায়!
মেয়েটি নির্বিকার। পেয়ারাগুলো মাটিতে ফেলে দেয়! ওর চোখগুলো যেন কেমন!
একটু চুপ্ করে থেকে বলতে শুরু করে…
-“জানো তো! বেশ ছিলাম। মামা-মামী খুব ভালোবাসত! লেখাপড়ায় ফার্স্ট হতুম কিনা! ”
-“তোমার মা-বাবা?”
বাধা দেয় ঝিলিক।
-“সে তো কবেকার কথা। আমি খুব ছোট্ট! বাবা-মা একটা দুর্ঘটনায় ..”
চোখের জল যেন গড়াবে!
ঝিলিক বলে ওঠে, “থাক্! থাক! তারপর?”
টিলিক বলে চলে…”বেশ কাটছিল! হঠাৎ মামার জমিটা প্রোমোটারের নজরে পড়ে। চাপ দিচ্ছিল বিক্রি করার জন্য! কিছুতেই রাজি না করতে পেরে একদিন সোজা বাড়িতে হামলা করলো দলবল নিয়ে!”
-“বলো কি!”
-“হ্যাঁ, প্রোমোটার বাক্স থেকে একখানা কাগজ বের করে বলছিল সই করে দিতে। মামা-মামী আপত্তি করছিল! একথা-সেকথা, ঝগড়া …হঠাৎ মামার মাথায় একজন লাঠি দিয়ে মারলো! অজ্ঞান মামার আঙুল কালিতে চুবিয়ে টিপসই নিল প্রোমোটার! মামীর গলা টিপে টেনে ফেলে দিল আর একজন! বাধা দিচ্ছিল যে!”
-“তুমি কোথায় ছিলে?”
-“দরজার ওপাশে। চট্ করে সরে এসে ওদের রেখে যাওয়া কাগজটা আগেভাগে ছোঁ মেরে তুলে নিলুম।”
-“বলো কি!” মেয়েটার সাহস দেখে ঝিলিক হতভম্ব!
-“হুঁ! ওরা আমাকে ধাওয়া করলো। কোনরকমে ট্রাঙ্কের পাশ থেকে কেরোসিনের বোতলটা নিয়ে এক ছুটে একটা বাড়ির আড়ালে গিয়ে তেল ঢেলে আগুন দিলাম।”
-“অ্যাঁ?”
-“কিন্তু ওরা আমাকে ধরে ফেলল।”
টিলিকের মাথাটা নিচু। হঠাৎ যেন চারপাশটা বিবর্ণ হয়ে এল! সেই চমকদার ভাবটা উড়ে গিয়েছে। এতক্ষণ কথায় ডুবেছিল, লক্ষ্য করেনি। আশেপাশে একটা পাখিও ডাকছে না। অদ্ভুত একটা নীলচে কুয়াশা যেন ছড়িয়ে পড়ছে মার্চের এই গুমোট সন্ধ্যায়!
টিলিক যেন আবছা আলোয় হারিয়ে যাচ্ছে, মুছে যাচ্ছে সিন্ থেকে!
-“তারপর বলে যাও!” চিৎকারটা অজান্তেই বেরিয়ে আসে।
বহুদূর থেকে কন্ঠস্বর ভেসে আসে…
“ওরা আমার দুটো হাত মুচড়ে দিল, মুখে লাগালো থাপ্পড়! প্রোমোটার যখন দেখল কাগজের কিছু নেই, হিংস্রভাবে আমার মাথাটা ধরে ঘুরিয়ে দিল পেছনদিকে!
উফফফ্! কি যন্ত্রণা!”
টিলিক যেন ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে হাওয়ায় মিশে যাচ্ছে! অণু-পরমাণু মিশছে বাতাসে!
ঝিলিকের ঘোর লাগে! ও কে? ও কি মানুষ! একরাশ জোনাকি-আলো চিকমিক করে ছড়িয়ে যাচ্ছে ওর চারপাশে!
ওকি ফেয়ারি! হ্যাঁ, ও ফেয়ারি! এরকম পরীর ছবিই তো দেখেছে বইতে! হাতে ম্যাজিক স্টিকটা….
মিষ্টি একটা সুর ভেসে আসে…
-“আমাকে ওরা ফেলে দিয়েছিল ওই কুয়োর মধ্যে। তারপর মাটি দিয়ে বুজিয়ে দিয়েছে! তুমি আমার উপকার করবে একটা? সবাইকে বলবে আমার কথাটা? আমি তো হেরে যাইনি! আমার জয় লোভের বিরুদ্ধে! জানো, আমরা খুব দমবন্ধ লাগে, বিশ্বাস করো! বড্ড কষ্ট! আমাকে ছেড়ে দাও না গো, মুক্তি দাও না!”
শেষের কথাগুলো কান্নায় মেশে।
ঝিলিকের ও ভীষণ কান্না পায়।
অন্ধকার গাছের গুঁড়িটা ছাড়িয়ে আরও কিছুটা গেলেই একটা পোড়ো ঘর আর কুয়োটা আছে। ও জানে! ভয় কিসের?
উঠে দাঁড়িয়ে বাগান থেকে বেরোনর পথ ধরে সে। গেটের কাছে কারা?
ওমা! পুচকু, পাকুই আর টিপ্পু ওকে হাঁ করে দেখছে!
“কিরে! কোথায় ছিলিস তুই? কত ডাকলাম তোকে! এপাশে ন্যাড়াপোড়া, রঙ-মাখানো সব হয়ে গেল! লাড্ডু খেলাম আমরা। কিরে কথা বলছিস না কেন?”
ঝিলিক বোঝে, ও বাগানের সম্পূর্ণ উল্টোদিকে গেছিল। কিন্তু, কেন? টিলিক কি ওকে চেয়েছিল!
মনে পড়ে আজ কিন্তু বিপিনকাকু বা সুরেনমামাকে ফিরতে দেখেনি সে!
উত্তর না দিয়ে টলতে টলতে বাড়ির পথে হাঁটে ঝিলিক। অনেক কাজ এখন! সে যেন একলাফে অনেকটা বড় হয়ে গিয়েছে ! পরাজিত এক মানুষকে জয়ী করে তুলতে হবে, আসল ঘটনা প্রকাশ্যে আনতেই হবে!
ন্যাড়াপোড়ার নিভন্ত আগুন পেরিয়ে সামনে এগোয় ঝিলিক।