পেয়ালা – পিরিচ / গল্প ( পরবর্তী অংশ ) গীতশ্রী সিনহা

পেয়ালা – পিরিচ / গল্প ( পরবর্তী অংশ )

গীতশ্রী সিনহা

উপমা আবার আগের প্রসঙ্গে ফিরে যায়, গ্র‍্যাজুয়েশনের পর কোনো গ্যাপ দিতে চাই নি রে, চাকরির জন্য বিভিন্নধরনের পরীক্ষা, তার সাথে ছোট বড় কিছু কোর্স করতে শুরু করি। অবশ্যই বাড়ির অমতে। সেই সময় নির্ঝরের সাথে দেখা। চওড়া পুরুষালি বলিষ্ঠ চেহারা, চকচকে নিখুঁত নিকষ আঁধারের মতো গভীর মানুষ। এই প্রথম নিজের মধ্যে এক অদ্ভুত অনুভূতি বোধ করি, যা আগে হয় নি কখনোই। আমার চোখে তখন রূপকথার রাজকুমারীর কল্পনা। একদিন নির্ঝর নিয়ে গেল ওদের নিউ আলিপুরের বিলাসবহুল বাড়িতে। আমি গেছিলাম নির্ঝরের প্রতি মুগ্ধতায়।
…… বৃষ্টি, ভুলতে পারিনি আমি, নির্ঝরকে। কি করে ভুলবো বল ! ও যে আমার সবটা জুড়ে ছিল রে ! আমি সাধামাটা আটপৌরে চেহারার লড়াকু মেয়ে। মামুলি সালোয়ারে লম্বা বিনুনি, নরম করে কথা বলা, আবেগ – প্রবণ একটি মেয়ে। নির্ঝরের বাবা খুব গম্ভীর মানুষ। তাঁর গাম্ভীর্য বজায় রেখে আমার অনার্সের নম্বর, এবং লেখাপড়ার খবর নিলেন। ভবিষ্যতের কথা জানতে চাইলেন।
…… উপমা নির্ঝরের মা কি করলেন রে ? তাঁর প্রতিক্রিয়া কি ছিল রে ?
…… অনেকক্ষণ পরে বললেন , তা মা , নাম টা যেন কী ?
…… উপমা, উপমা রায়।
ভাইবোন আছে নাকি, বাবা কোথায় চাকরি করে, রান্নাবান্না কিছু জানি কিনা… দ্রুত সোজাসাপ্টা জানতে চাইলেন নির্ঝরের মা।
…… বৃষ্টি, তারপরের প্রশ্ন শুনে তুই ঠিক থাকতে পারবি না, আমি জানি। কিন্তু বৃষ্টি তাও আমি… বৃষ্টি তাকিয়ে থাকে উপমার দিকে…
…… তা মেয়ে, দুদিন আমার নির্ঝরের সাথে ঘুরেফিরে খেয়ে ফূর্তি করে আবার কোনো বড়লোক দেখে… ভেবে বলো বাপু !
আমি চুপ… ঘরে পিন পড়লেও ঝংকার উঠবে যেন ! চলে গেলেন সবাই, রইলাম আমি আর নির্ঝর। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলাম শূন্যের দিকে…
—— বুঝলাম ! তোর ওই প্রেমিকটা কিছু বললো না ? উপমা, আমার কিন্তু মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে !!!!
——- হুম, বললো। মা তাঁর অভিজ্ঞতা থেকেই কথাটা বলেছেন। এটা উচিত কথা, তাই শুনতে খারাপ লাগলেও…
সেদিনই আরও বলেছিল নির্ঝর, উপমা আমি তোমার রূপে মুগ্ধ, আগে দেখিনি এমন আটপৌরে রূপ, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি তোমায় বিয়ে করতে চাই উপমা।
বুকের উপর চেপে বসা জগদ্দল পাথরটাকে গড়িয়ে একটু যেন নিচের দিকে নামিয়ে দিলাম, আবেগে তাকিয়েই ছিলাম নির্ঝরের দিকে।
——- জীবনের পরতে পরতে কতো সঞ্চয়ের ঝুলি পূর্ণ হতে থাকে, উদ্ধত হাসিতে বৃষ্টি বলে চলে, তোর ওই নির্ঝর কোনো প্রেমিকই ছিল না, ভন্ডা প্রেমিকের আইডিয়া মাত্র ! মোহগ্রস্ত মন, শুধু নারীর প্রতি গন্ধ শুকে বেড়ায়।
তারপর… তারপর বল কি হলো ! বিয়েটা হলো ?
—— না ! বিয়েটা কেউ আটকাতে পারলো না, নির্ঝরের বাবা প্রথম থেকেই মত দিয়েছিলেন,মত ছিল না বাকিদের। আমার বাড়ির কেউ রাজি ছিল না।
—— তারপর ?
ঘন কালো মেঘেরঘটা, উপমার মুখেচোখে আত্মপ্রত্যয়হীন ভাষা, যেন শব্দ খুঁজে ফিরছে… বৃষ্টি, আমার ভিতরের আমিটা বার বার তর্জনী তুলে শাসন করছিল … পাত্তা দেই নি সেই মুহূর্তে !
বউভাতের দিন দুপুর ।
মাথায় কাপড় টেনে বড়দের ভাত পরিবেশন করার কথা। আমাদের চিরন্তন নিয়মের প্রথা মেনে , ‘ নির্ঝর বলে, আমি তোমার ভাত কাপড়ের দায়িত্ব নিলাম ‘। শুরু হয়ে যায় আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে গুন গুন গুঞ্জন , চারিদিকে ফিসফাস কানাকানি… ভেসে আসা কথা, ‘ দিনরাত টিউশন করে পেট চালানো মেয়েকে এতো মুল্যবান শাড়ি না দিলেই চলতো ‘ বৃষ্টি, বুক কাঁপতে শুরু করেছিল তখন থেকেই।
সন্ধ্যায় সাজো সাজো রব,নতুন বউয়ের রূপে আলোকিত চারিদিক। কেউ বলছে সুপ্রিয়া, কেউবা মাধবীর সাথে মিল খুঁজতে ব্যস্ত! ততক্ষণে বুঝে গেছি, এটা আমার জায়গা নয়! চারিদিক থেকে টিপ্পনীর ছোবল…
বিয়ের সাতদিন পর…
আমার এয়োতি চিহ্ন মুছে ফেলে দেওয়া হলো জোর করে, কপালের সিঁদুর, শাঁখা পলা শাশুড়ি মা নিজে সব করলেন ! কিন্তু শরীর থেকে… ! মুছতে পারে নি কেউ… !
বৃষ্টি আর নিতে পারছিল না, দু’কান চেপে বলতে থাকে উপমার উদ্দেশ্যে, প্লিজ উপমা প্লিজ …! ভুল ছিল উপমা রায় এর, ভুল ওদের না। ঐ অনিবার্য অনিশ্চয়তার কবলের জন্য তুই নিজে দায়ী ছিলি উপমা! সোসাইটির উঁচু মহলের বাসিন্দা ওরা, ওদের শোভা পায় এসব ! কিন্তু নির্ঝর? নির্ঝর কি করলো রে ?
আপন মনে বলতে থাকে উপমা, নিজেরই অলক্ষ্যে ঘুণপোকায় আক্রান্ত এক সময়ের উথলানো প্রেম যখন থিতিয়ে তলানিতে চলে যায়… মিউচুয়াল সেপারেশন ছাড়া উপায় ছিল না। সেই নির্ঝরকে পরে বুঝলাম, প্রেম নামক শব্দের অন্তরালে দুর্বোধ্য কোনো এক অনুভূতি ।
—— তোকে সোজাসুজি কিছু বলেনি ?
—— বার বার একটি কথা ! আমি নাকি মিডিলক্লাস মেন্টালিটিতে বিলং করি !
ওরা চেয়েছিল সফিস্টিকেশনের প্রলেপ, আর আমি চেয়েছিলাম উন্নত উদার মানসিকতা। শিক্ষিত ভদ্র ফ্যামিলির মেয়ে আমি। সমস্ত শিষ্টাচার নিয়েই আমার পরিচিত পৃথিবী। ফিরে আসার সময় নির্ঝরকে বলেছিলাম, ‘ যে সাহেবিয়ানা তোমাদের তথাকথিত সভ্যতার মাপকাঠি, মিডিলক্লাস ফ্যামিলির হয়েও আমি অনেক বেটার জানি।
——- ভেরি বোল্ড ডিসিশন। কিন্তু এই সিদ্ধান্তে আসতে তোর কষ্ট হয় নি রে উপমা ?
—— হয়েছে, খুব হয়েছে। বিয়ের সাতদিনের মধ্যে ভরসা – ভালোবাসা কিছু দেখতে পাইনি নির্ঝরের মধ্যে। দেখতে পেয়েছি শুধুই শারীরিক ভোগ !
অক্টোপাসের অগুনতি শূঁড় হয়ে পেঁচিয়ে ধরে প্রশ্ন করতে থাকে, দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়, শুধু অন্ধকার… চারিদিকে শুধু অন্ধকার… হাঁকপাঁক করে ওঠা অস্তিত্বের সঙ্কট।
সেই সময় আমার চোখ থেকে মুছে গেল… ঘাড়ের কাছে আলতো খোঁপা,কপালে মস্ত টিপ, ছাপা শাড়ির আঁচলে হলুদের দাগ, সদ্য রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে হলুদের গন্ধমাখা হাতে একান্তে নির্ঝরের পাশে আমি।

একটা ধাবার সামনে গাড়ি এসে দাঁড়ালো। নজর কাড়া দুই মহিলাকে আসতে দেখে ধাবার মালিক তো ব্যস্ত ! আসুন, দিদিমণিরা, এ…ই, এ…ই মানকে… মানকে নামক বাচ্চা ছেলেটি এসে ঘাড়ের গামছা দিয়ে চেয়ার মুছতে থাকে… কি কি কোল্ড ড্রিংক্স আছে এক দমে বলতে থাকে। শুধু কি মানকে ! সবাই এসে হাজির, একটু যদি দিদিমণিদের সেবায় আসতে পারে… খাটিয়ায় বসে ভোজনে ব্যস্ত মানুষগুলো রিমোটে আটকে যাওয়া মনে হচ্ছে।
বৃষ্টি এগিয়ে এসে বলে… তোর নাম বুঝি মানকে ?
না — হ্যাঁ মানে মানিক চন্দ্র নস্কর।
কিন্তু নস্কর বাবু , আমরা যে ভাত খাবো ! মুহূর্তের মধ্যে দৌড়ে পালিয়ে যায় মানকে, মালিকের কাছে। উপমা আর বৃষ্টি দেখতে থাকে ধাবার মালিকের কান্ডকারখানা। যেন বিনা নোটিশে রেড ! অল্প সময়ের মধ্যে খোলা আকাশের নিচে ছাতা লাগিয়ে টেবিল – চেয়ার পেতে সুন্দর মধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থা করে দেয় ধাবার মালিক।
আসলে অনেক সাহেব – মেমসাহেব আসেন আমার এখানে, তাই একটু – আধটু ব্যবস্থা রাখতে হয় দিদিমণি… বললেন ধাবার মালিক দীনবন্ধু বাবু।
ওরা দীনবন্ধু বাবুর পেমেন্ট মিটিয়ে, বাচ্চা ছেলেদের হাতে কিছু বকশিস তুলে দেয়। এমন সময় ঘোমটা টানা গৃহবধূ এসে ওদের হাতে প্লেটে সাজানো পান দিয়ে বলে… সাদা পান, জরদা দেয় নাই । বৃষ্টি – উপমা অবাক… একি কান্ড ! তুমি কে গো ? বৃষ্টি উৎসাহে ঘোমটা সরিয়ে বলে — দেখ উপমা কি দারুণ বিউটি রে ! ততক্ষণে দীনবন্ধু বাবু এসে পড়েছেন, বলেন – আসলে দিদিমণিরা কলাপাতায় ভাত খেতে চাইলেন, ভাবলাম কলাপাতায় খাবেন আর খেয়ে উঠে একটা পান খাবেন না, তা কেমন করে হয় !
এ হচ্ছে আমার ইস্ত্রি বাতাসী। ঘোমটা আরও টেনে লজ্জায় সে যেন বাতাসের সাথে মিশে যেতে পারলে বেঁচে যায়।
এবার ফেরার পালা। স্টিয়ারিং – এ বসলো বৃষ্টি। গুন-গুন করে গান গাইতে থাকে উপমা, গলা মেলায় বৃষ্টিও।
… হ্যাঁ বল উপমা, আজকের উপমা মিত্র হলি কি করে ?

আগ্রহী পাঠকের জন্য… পরবর্তী অংশ প্রকাশিত করতে পারি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *