* সেদিনের কবিগান: পর্ব ১ * কলমে : গীতালি ঘোষ

      * সেদিনের কবিগান: পর্ব ১ *
               কলমে : গীতালি ঘোষ

বাংলা গানের জগতে কবিগান এক বিস্মৃতপ্রায় নাম। যা বহুদিন ধরে অনেকেরই অগোচরে রয়ে গেছে। আজকের গতিময় জীবনে সেই কবিগানের মূল‍্য বা প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে কিছু সন্দেহ থাকলেও, আমাদের আপন অতীতের কথা জানতেও তো ইচ্ছা হয়! কেমন ছিল সেসব দিন, কেমন ভাবে কবিগান সে সময়ে মাতিয়ে তুলেছিল গ্রাম‍্য তথা শহুরে মানুষকে, সে কাহিনী নিয়েই আমার এই কবিগান-কথা। আশা করি উৎসুক পাঠক- চিত্তকে কিছুটা হলেও তৃপ্তি দিতে পারব। আমার এই কাজটি বিশেষ বড় নয়, বরং সে হিসাবে  ছোটই। সকলে পড়ে মতামত জানালে খুব  ভালো  লাগবে। সকলকে শুভেচ্ছা জানিয়ে শুরু  করলাম আমার ‘সেদিনের  কবিগান’।

অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে যে সময়ে নবাবী শাসনের কবর খোঁড়ার পালা চলেছিল, অন্যদিকে বণিক  ইংরেজের মানদণ্ড  রাজদন্ডরূপে দেখা দেওয়ার প্রতীক্ষায় রত, তখন বাংলা সাহিত্য তথা গানের আসরে আবির্ভাব হয়  এক নতুন শাখার– যার নাম ‘কবিগান’। এ এক ধরণের স্বতঃস্ফূর্ত গানের লড়াই। এর কোনো পূর্ব প্রস্তুতি থাকত না। কবিগানে আগে থেকে কেউ গান লিখে প্রস্তুত হয়ে আসত না। যা হত, সবটাই মঞ্চে দাঁড়িয়ে সহজ ভাবে হত। গানের দুটি দল থাকত। প্রত‍্যেক দলের একজন মূল গায়ক থাকতেন। তারাই মূলত গান বাঁধতেন এবং গানের মাধ্যমে একে অপরকে প্রশ্ন করতেন। সে প্রশ্নের উত্তর দিতে হত অন‍্যপক্ষকে। দলে আরও কিছু মানুষ থাকত সহযোগিতা করার জন‍্য। এভাবেই গানের মাধ্যমে লড়াই চলত। এটি সে সময়কালে এক বর্ণময় উৎসবের আকার নিত। কবিগান প্রাথমিকভাবে শুরু হয়েছিল গ্রামের আঙিনায়। কিন্তু অচিরেই তা তৎকালীন শহুরে জীবনের অন‍্যতম আনন্দের উপকরণ হয়ে  ওঠে। গ্রামজীবনের থেকে শহরে পদার্পণ করার পরে কবিগান অনেক পরিমাণেই শহুরে হয়ে ওঠে।

সাধারণত বৈষ্ণব বা শাক্ত গান অথবা পুরাণকথার বিষয়কে কেন্দ্র করেই এই কবিগানের উদ্ভব হয়। তাছাড়াও কিছু সমসাময়িক জীবনকথারও সন্ধান পাওয়া যায়  এই গানগুলিতে। একে অপরের সঙ্গে গানের মাধ‍্যমে লড়াই করে, নানারকম প্রশ্ন করা হয়  ও তার জবাব দেয় অন‍্য পক্ষ। সেইসব প্রশ্ন মাঝেমাঝেই ব‍্যক্তিগত আক্রমণের পর্যায়ে চলে যেত। সেকালের সামাজিক অবস্থাও কখনও কখনও কবিগানের মাধ্যমে জানা যেত। এইভাবেই কবিগান তার উচ্চকিত কথায় ও সুরে  ক্রমশ আসরকে মাতোয়ারা করে তুলত। সেই সময়ের উচ্চবিত্ত মানুষের আমোদ আহ্লাদের যে কোনো আসরে এই শাখাটি অপরিহার্য হয়ে ওঠে। এই কবিগান সেকালের বাবুসমাজের এক অত‍্যন্ত জনপ্রিয় গানের শাখা, যা পরে খেউড় গানের অপর রূপ হয়ে  দাঁড়ায়। এর থেকেই পরবর্তীকালে টপ্পাগানের উদ্ভব ঘটে, এটাও সত্যি।

সাধারণ মানুষের চিত্ত বিনোদনের জন‍্য কবিগানের শিল্পীরা আসরে গান বাঁধতেন… উত্তর -প্রত্যুত্তরের খেলা চলত, যার নাম চাপান- উতোর। ঢোল, কাঁসি, মন্দিরা, ক্লারিওনেট, হারমোনিয়ামের উচ্চকিত আওয়াজ ও সঙ্গী দোহারদের সঙ্গতে আসর মাতোয়ারা হয়ে  উঠত। মূল গায়কের সঙ্গে সঙ্গী গায়কদের দোহার বলা হয়। তারা এই আসরের অন‍্যতম আকর্ষণ হয়ে  উঠত। গানের তালে তালে নানা নৃত্যভঙ্গিমায় তারা দর্শক শ্রোতাকে প্রভূত আনন্দদান করত। এমনি করেই বাংলা গানের জগতে এই শাখাটি চিরস্থায়ী ছাপ রেখে যায়।

১৮শ শতকে প্রথম কবিগানের দল খোলেন, গুঁজলা গুঁই।পরবর্তী কালে তাঁর সুযোগ‍্য শিষ‍্যরা…. রঘুনাথ, লালু, নিতাই বৈরাগী, হরু ঠাকুর, রাম বসু প্রমুখ কবিয়াল আসরে নামেন।              (  চলবে )

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *