ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে (পঞ্চদশ পর্ব) ✒️✒️ সায়ন্তন ধর

ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে (পঞ্চদশ পর্ব)

সায়ন্তন ধর

ব্রহ্মপুত্র দিয়েছে ডাক প্রাক বর্ষা দিনে
ভোরের বাতাসে শিশির স্পর্শ নিয়েছে এ মন চিনে
কুহুতান আর পিউকাহা রাগে প্রকৃতি মনোরম
আবির গন্ধে মাতোয়ারা বসুধৈব কুটুম্বকম্।

এবারে কোন মিটিং ব্যতীতই গুয়াহাটি অফিসে চলেছি। গত মিটিং এ আমার আগামীর পরিকল্পনায় প্রতি মাসে অন্তত একশোটি হার্বেরিয়াম স্পেসিমেন সংগ্রহ ও তা জমা দেওয়ার কথায় অনেকেই বলেছিলেন যে টার্গেট এমন রাখবে যা বাস্তবসম্মত মনে হয়। একমাসে একশোটি হার্বেরিয়াম সংগ্রহ প্রায় অসম্ভব। আমি চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করি। আর তাই ফেব্রুয়ারির পর আবার মার্চ মাসে ১০৭ টি হার্বেরিয়াম স্পেসিমেন নিয়ে আমার ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে আসা। বরাবর হয় একা অথবা কলিগদাদার সাথে এলেও এবারে বাবাকে সঙ্গে নিলাম। আমি আমার কাজ করবো, বাবা সাথে থাকলে বাবারও ঘোরা হবে। প্রতিবারের ন্যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে উঠলাম সন্ধ্যে সাতটায়। পরদিন ভোর সাড়ে তিনটায় পৌঁছে গেলাম গুয়াহাটি স্টেশনে। ভোর রাতে কোন হোটেলেই চেকইন করা সম্ভব নয়। অগত্যা ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করতে লাগলাম প্রথম অহনা আলোর। কিন্তু সূর্যকে ওয়েটিংএ পাঠিয়ে আকাশ মেঘেদের জল মেপে নিলো এক পশলা বৃষ্টিতে। তারপর কাছেই পানবাজারে একটি হোটেলে সকাল ছ’টায় চেকইন করলাম। একে বসন্ত, তাতে এক পশলা বৃষ্টি, উষ্ণতার লেশমাত্র নেই। তবুও কিছুটা অজ্ঞতাজনিত কারণে এমন একটা হোটেল নিলাম যার প্রতিটি রুম এসি করা। তাই এসি ব্যবহারের প্রশ্ন না এলেও, আর নামমাত্র পরিসেবা সত্বেও গুনতে হলো মোটা অংকের টাকা। যাই হোক দু’জনেই ফ্রেশ হয়ে সঙ্গে থাকা খাবার গ্রহণ করে একটু রেস্ট করে নিলাম। বাবা সঙ্গে থাকা মানে খাওয়ায় কোন চিন্তা নেই। আমি একা হলে হয়তো এক প্যাকেট বিস্কুট দিয়েই প্রাতরাশ সারতাম। কিন্তু বাবা তার সাথে এক গ্লাস করে ছাতু তৈরি করে দিল, যা প্রাকৃতিক, পুষ্টিকর ও দীর্ঘ সময়ের জন্য পেটে থাকবে। তারপর ন’টার দিকে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকায় হোটেলের সামনে থেকেই আইআইটির বাস সার্ভিস গ্রীণ ভ্যালির বাস পেয়ে গেলাম। লাস্ট স্টপেজ অর্থাৎ ঠিক আমার অফিসের সামনে নেমে গেলাম। অফিসে ঢুকে আমার কলিগদের জানালাম যে আমার বাবা এসেছেন সঙ্গে। উনারাও সাদর অভ্যর্থনা জানালো বাবাকে। প্রতিদিন কতশত আবিস্কার হয়ে চলেছে আমার দেশের আনাচেকানাচে। এত খুঁজি, তবু কতটুকুই বা জনসমক্ষে আনতে পারি, তার মধ্যেই যে অসাধারণ আবিস্কারগুলোর জন্য ভারত বর্তমানে বৈশ্বিক উদ্ভাবন সূচকে ৪০ তম স্থানে রয়েছে তার কিছু আমাদের অফিসে রাখা আছে। আমি এতদিন অফিসে আসছি কিন্তু দু’চারটা বাদে তেমন কোনটিই দেখা হয়ে ওঠেনি। বাবার উপস্থিতি সে সুযোগ করে দিলো। অফিসের সেকেণ্ড বস প্রতিটি আবিস্কার তুলে ধরলেন বাবার সামনে। এভাবে বেশ কিছুটা সময় অতিবাহিত হলে আমাকে নিয়ে স্যার হার্বেরিয়ামের দিকে গেলেন। একটা একটা করে কাগজ উল্টে দেখছেন, তিনি যে প্রসন্ন তা তাঁর কথায় ফুটে উঠলো। আগামী মাসে যেন ২০০ টি হার্বেরিয়াম স্পেসিমেন সংগ্রহ করতে পারি সেকথা বললেন। ওদিকে বাবা সবসময়েই বই নিয়ে সময় কাটাতে ভালোবাসে। তাই ওখানে থাকা বিভিন্ন বই নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলেন। কোনটা ইনোভেশন সংক্রান্ত তো কোনটা আবার আইআইটির গাছপালা, পাখি সংক্রান্ত। আমি স্যারকে আমার ও পায়েলদির যৌথ উদ্যোগে হার্বেরিয়ামের ওপর লেখা বইটি প্রেজেন্ট করলাম। এরপর লাঞ্চে চলে এলাম কামেং হোস্টেলের ক্যান্টিনে। এখানে প্রতিটি হোস্টেল অসমের নদ-নদীর নামে নামাঙ্কিত। একটু পিছিয়ে যাই, কিছু কথা বলা বাকি রয়ে গেছে। বাসে করে আসার সময় বাবাকে আমার গল্পের হিরোর সাথে পরিচয় করালাম। হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন, ব্রহ্মপুত্রের সাথে। শহর থেকে আইআইটি আসতে অতিক্রম করতে হয় দু’কিলোমিটার দীর্ঘ সরাইঘাট সেতু। তারপর বাসের থেকেই দেখালাম আইআইটি গুয়াহাটির নৈসর্গিক দৃশ্য। বড় বড় ঝিল, অনুচ্চ পাহাড়, সুদৃশ্য মসৃণ রাস্তা, রঙবেরঙের ফুলে সেজে থাকা গাছ, সবমিলিয়ে বাবারও বেশ ভালো লেগেছে। এদিকে লাঞ্চ খেতে যাওয়ার সময় দেখা হলো হেলেঞ্চা, কলমীদের সাথে। আমরুল ফল যেন এক বিস্ময়। বচ ও নলখাগড়া জাতীয় ফুলেরা বাতাসে আন্দোলিত হয়ে যেন গার্ড অব অনার দিচ্ছে। এরপর লাঞ্চ সেরে অফিসে আসতেই শুনি একটা অনলাইন মিটিং হঠাৎ করেই ফিক্স করা হয়েছে হেডকোয়ার্টার থেকে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের শদুয়েক স্টাফ একত্রিত হওয়ার ডাক ইথার মাধ্যমে। অফিসের ল্যাপটপ থেকেই কানেক্টেড হলাম। এর আগে নিওনর্মাল সিচ্যুয়েশনে অনেকবার বাড়িতে বসে অনলাইন মিটিং সারলেও অফিসে বসে অনলাইন মিটিং এই প্রথম। এরপর মিটিং শেষে স্যার একটু আমাকে নিয়ে বেরোলেন। এদিকে অন্য কলিগদাদা বাবাকে নিয়ে একটু অন্য দিকে গেলেন। উদ্দেশ্য একটু চা পান ও কিছুটা ঘুরিয়ে দেখানো। পরে বাবার কাছে শুনেছিলাম যে আইআইটির পাশেই রয়েছে এলপিজি গ্যাসের স্টোরেজ। তাই পুরো ক্যাম্পাসেই আগুনের কাজ খুব সাবধানে করতে হয়, কারণ কোন কারণে অগ্নিকাণ্ড হলে পুরো গুয়াহাটি শহর উড়ে যেতে পারে। এরপর ঠিক করেছিলাম মাজগাঁও ফেরিঘাট থেকে লঞ্চে চড়ে জলপথে ফ্যান্সি ফেরিঘাটে পৌঁছে যাবো। কিন্তু অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় আর প্রাকবর্ষায় অল্প জলে ফেরি সার্ভিস কিছুটা সময়সাপেক্ষ ও বিপজ্জনক হওয়ায় তা আপাতত মুলতুবি রইলো। গ্রীন ভ্যালির বাসেই ফিরে এলাম পানবাজারে। জি২০ এর আবহে রাতের গুয়াহাটি সেজেছে আলোকমালায়। মাত্র পাঁচ টাকা মূল্যে ভীষণ সুন্দর আসাম লিকার চা খাওয়ালো এক দোকানী ভাই। মন বড় হলে যে পরিমাণ কথা শোনে না, তাই ওই একই মূল্যেই দু’কাপ করে চা অফার করলো সে। সেখান থেকেই পরবর্তীতে থাকার জন্য তুলনামূলক সস্তা হোটেলের সন্ধান পেলাম। পরের বার সেখানেই থাকবো ঠিক করলাম। এরপর ডিনার সেরে চেকআউট করে রওনা দিলাম স্টেশনের উদ্দেশ্যে। আজকাল ব্রহ্মপুত্র আমাকে কানে কানে বলে, “আমার সাথে দেখা করতে এসেছো অথচ আমার বোন বরাককে দেখবে না?” তাই তো স্টেশনে গুয়াহাটি শিলচর এক্সপ্রেসের অপেক্ষা। স্টেশনে লক্ষ্য করলাম প্রচুর আর্মি। আসলে কোন একটা ব্যাটেলিয়ন শিফ্ট হচ্ছে। ওরা নিজেদের মধ্যে অরুনাচলের ঠাণ্ডার গল্প করছিলো। কেউ কেউ শোনাচ্ছিল তাদের কাশ্মীরের পূর্ব অভিজ্ঞতা। সত্যিই এই নদ-নদীরা আমাদের ডেকে আনে, আর কত গল্পই না শুনিয়ে যায়।

(ক্রমশঃ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *