পর্ব আট মিরুজিন আলো ✒️✒️ বিজয়া দেব

পর্ব আট
মিরুজিন আলো
বিজয়া দেব

আসলে বাঁহাতি কারবারে একটা নেশা আছে। টাকা তার হকের নয়, অথচ পকেটে ঢুকে গেল। তবে অপরাধ বোধটা আছে। ওটা কাঁটার মত ফুটতে থাকে। রক্তও ঝরায়।
ঐ আগের বেসরকারি কলেজে সে খাটত খুব। রোজগার ছিল কম। দেবাংশী এজন্যে খুশি ছিল না। এখানে খাটতে হয় না। কী হবে খেটে! তারচেয়ে কিছু এদিক ওদিক করলে কিছু বিনা হকের টাকা আপনা থেকেই পকেটে ঢুকে যায়।   লুকিয়ে সে বন্ধকী কারবার করে। অন্নপূর্ণা তাকে হুকুম দিয়ে এ কাজে নামিয়েছে। অন্নপূর্ণার বাড়িতে এই ব্যবসা খুল্লমখুল্লা চলছে বংশপরম্পরায়। অধঃপতনে পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারলে বেঁচে থাকাটা সুগম হয়। কিন্তু খাপে খাপে না বসলেই তো মুশকিল।
দেবাংশীকে ভোলা যায় না। হয়ত অন্নপূর্ণার সঙ্গে মনের সম্পর্কে জড়িয়ে না পড়ায় দেবাংশী আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে।
জুহি খুব আদুরে ছিল। পার্কে নিয়ে যেত সে। ফুটফুটে প্রজাপতির মত মেয়েটা ছুটত। সব এখন অতীত। তবু কেন মনে হয় জুহি তাকে খোঁজে, খুঁজে চলেছে, আর একদিন ঠিক মেয়েটা তার কাছে এসে দাঁড়াবে। তখন সে কী সোজা চোখে মেয়ের দিকে তাকাতে পারবে!
দেবাংশীর সঙ্গে প্রথম প্রেমের দিনগুলো আজও তার কাছে স্বপ্ন। সেই কলেজ শেষে এক সন্ধ্যা। মফস্বলে সেই কলেজটা। সে বাসে উঠেছে। একটি ছিপছিপে তরুণী বাসে উঠল। সিটটা তার পাশেই। সরকারি লাল রঙা লম্বাটে বাস। পাশে বসতেই একটি মৃদু কোমল সুগন্ধ। সেই গন্ধটি এখনও শীতের সন্ধ্যায় সে অনুভব করে। তারপর সে-ই প্রথম জিজ্ঞেস করেছিল – কোথায় থাকেন আপনি?
তরুণীটি হেসে বলেছিল – আমি সরকারি অফিসে চাকরি করি। বাড়ি শহরে। আপনি?
-আমি কলেজে পড়াই । এখানেই থাকি।আজ শনিবার। বাড়ি ফিরছি।
বাস চালু হয়নি। লোকজন ওঠানামা করছে। নিভু নিভু সন্ধ্যায় বাইরে অস্পষ্ট মেদুর আলো। বাসের ভেতর তেমনি মেদুর আলোর রঙ ক্রমশ বদলে যাচ্ছিল। কমলারঙের সঙ্গে আঁধারের মিশেল। শীতের সন্ধ্যায় কোথা থেকে একটা শীতগন্ধী হাওয়া এসে তাকে উথালপাথাল করে দিচ্ছে। সে জিজ্ঞেস করেছিল – আপনার নামটা জানতে পারি?
তরুণী হেসে বলে – কেন নয়? আমি দেবাংশী। আপনার নাম?
-জয়মাল্য।
-দারুণ নাম তো। কে নাম রেখেছিল আপনার?
-আমার মা।
-বাহ। মা-কে আমার প্রণাম জানাবেন।
দেবাংশী খুব স্বচ্ছন্দ। কোনও আড়ষ্টতা নেই। বাস ততক্ষণে চলতে শুরু করেছে। ঝাপসা হয়ে গেল দিন, আঁধারের আঁচলের গায়ে গায়ে আলোর চুমকি – আর তা থেকে একটা নিবিড় আলোর নিঃসরণ এসে পড়েছে দেবাংশীর মুখে। জয়মাল্য দারুণ মুগ্ধ হলো।
সামনে নদীটির ওপর ব্রিজটি দুর্বল। এখানে এসে বাস থামে। সব যাত্রীদের নামিয়ে দেয়। ব্রিজটা হেঁটে পার হতে হয়। আর খালি বাসটি ধীরে ধীরে ব্রিজ পার হয়ে এসে এপারে থামে, সব যাত্রীরা ওঠে। চারপাশে ঘন বাঁশঝাড়।গ্রামীণ এলাকা। একা থাকলে আর সন্ধ্যা হলে কেমন একটা ভূতুড়ে আবহ তৈরি হয়। ভয় করত তখন দেবাংশীর। কথাগুলো সে জয়মাল্যকে বলল। জয়মাল্য খুব উৎসাহী, ভারি মজা পেয়ে বলে – একটা ভূত ভূত গন্ধ, তাই না? সেটা আমিও পাই।
একচোট হাসি হল।
দেবাংশী বলছিল –
-এই ব্রিজটা কবে সারাই হবে বলুন তো? খুব অসুবিধে, আর অনেকদিন থেকেই নাকি এমনি গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে ব্রিজ পেরোতে হয়।
জয়মাল্যর মুখ থেকে ফস করে বেরিয়ে গেল – থাকুক না এই অসুবিধে… এই হেঁটে ব্রিজ পেরোনো…
-মানে? – দেবাংশীর ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি.. অপূর্ব ভ্রূভঙ্গি..
জয়মাল্য তখন নিরুচ্চারে – “ভ্রুপল্লবে ডাক দিলে দেখা হবে চন্দনের বনে…”
এদিকে অপ্রতিভ সে  – আরে বুঝতে পারছেন না এসব ইচ্ছে করে.. ইচ্ছে করে ফেলে রেখেছে… সাধারণ মানুষ যত অসুবিধে ভোগ করবে ততই ওদের আনন্দ…
দেবাংশী ফিচেল হেসে বলে – ওরা কারা?
জয়মাল্য হো হো করে হেসে বলেছিল – ওরা মানে ওরা। এই ভর সন্ধেয় ওদের নাম বলতে নেই।
দেবাংশী শব্দ করে হাসে – যা বলেছেন! আমাদের কষ্টে ওদের আনন্দ!
জয়মাল্যও হা হা হাসে।
-কোথায় উপনিষদের “আনন্দ” অথবা রবীন্দ্রনাথের “আনন্দ” আর কোথায় আপনার আনন্দ”। একই শব্দ কিন্তু ভাবুন তো প্রয়োগে কত ফারাক! আপনারটি কী ভয়ানক শ্লেষাত্মক।
দেবাংশীর বলার ভঙ্গিমা তাকে আরেক চোট হাসাল।
-হ্যাঁ এটা ওদের আনন্দ। এই আনন্দের… এই আনন্দের…
জুৎসই শব্দ খুঁজে পাচ্ছিল না জয়মাল্য। দেবাংশী বলে উঠল – তুলনা হয় না। অতুলনীয়।
-একদম ।একদম ঠিক- “অতুলনীয়”
আবার একচোট হাসি। তারপর জয়মাল্য হাসি সামলে বলেছিল – খুব জটিল ব্যাপার।
-জটিল তো বটেই। সেদিন শরীর ভালো লাগছিল না জানেন। ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরছি তাড়াতাড়িই। দুপুরের কাঠফাটা রোদ। তার মধ্যে হেঁটে হেঁটে এই ব্রিজ পেরোনো..মাথা ঘুরছিল।
-তাই? এমন হলে সোজা আমার কলেজে চলে আসবেন।
-মানে?
-না না একা একা এইরকম কড়া রোদে খারাপ শরীর নিয়ে আপনি কেন হেঁটে হেঁটে এই ব্রিজ পেরোবেন? একা একা…
দেবাংশী মুখ টিপে হেসে বলেছিল – যাহোক ভরসা পেলাম।
সেই ভরসাই তো। ভরসা যখন সুস্থির বীজতলায় ছড়িয়ে যায় তখনই সম্পর্কের শিকড় শাখাপ্রশাখায় ছড়াতে থাকে। কিন্তু সব শিকড় কি আর পোক্ত হয়? নাহলে ঝড়ে উন্মূল হয় কেন বৃক্ষ?তবে তুলনাটা বোধহয় ঠিক হল না।  তাদের সম্পর্কটা কি বৃক্ষের মত শিকড় ছড়িয়েছিল? খুব বড় ঝড় উঠেছিল কি? নাহ্। দেবাংশী সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল এক শিল্পীর সাথে। অনিমেষ। যে দেবাংশীর দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকত। আর জয়মাল্যর বুকের ভেতরটা নিরন্তর জ্বালা করত।দেবাংশী তারপর থেকেই কি  খুঁতখুঁতে হয়ে পড়েনি জয়মাল্যর প্রতি? জয়মাল্য ভালো কলেজে চাকুরি পেল না, এক বেসরকারি কলেজে সেই কবে থেকে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করেই চলেছে, জয়মাল্যর উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই ইত্যাদি ইত্যাদি কত অভিযোগ কত অবহেলা…
একদিন সকালে বেরিয়ে গেল দেবাংশী ঐ শিল্পীর সাথে। অনিমেষের শিল্প প্রদর্শনী আছে, এরজন্যে গোটা একটা দিন ছুটি নিয়েছিল অফিসে দেবাংশী। জুহিকে কাজের মহিলার জিম্মায় রেখে সে সারাদিন বেপাত্তা। বেশ রাত করে ফিরেছিল বাড়ি। এর আগেই সেই মফস্বলের কলেজ থেকে বাস জার্নি করে সে ফিরে এসেছে বাড়ি। রাতে এ নিয়ে তুমুল অশান্তি।
তবে একটা ব্যাপার ছিল দেবাংশীর, কোনও লুকোচুরি করত না। বলত – অনিমেষ আমার খুব ভালো বন্ধু। এর বেশি কিছু নয়।
কিন্তু বিবাহিত মহিলার পুরুষ বন্ধু কেন হবে? হয় এরকম? হয় না। যৌনকাতরতা থাকবেই। উভয়ত। যৌনতার মত শক্তিশালী আর কিছু আছে নাকি? যে যতই বাতেলা করুক সে বিলকুল বিশ্বাস করে না। এই নিয়ে অশান্তি গড়াতে গড়াতে বিচ্ছেদ। দেবাংশী তার সঙ্গে আর থাকতেই রাজি হল না। তার মুখে একটিই কথা – বিয়েটাকে আমি দাসত্ব ভাবি না। আমার ভালো লাগার কিছু কিছু জায়গা আছে। সেখানে আমি কোনও আপোষ করি না, করবও না।
না,  জয়মাল্য কোনও ভুল করেনি। যা হবার ছিল তা হয়েছে। কিন্তু দেবাংশী অনিমেষকে বিয়ে করেনি কিংবা আর কাউকে। কেন করেনি? হয়তো আর স্বাধীনতা হারাতে চায়নি।
জয়মাল্যর চারপাশে আজ বড় বেড়াজাল। সে কি পুরোপুরি স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলে নি? নিজের ভুলে নিজের চারপাশে অদৃশ্য ঘেরাটোপ তৈরি হয়ে গেছে। । এর থেকে পরিত্রাণ নেই আর। এরজন্যে কি সে নিজে দায়ী? উহুঁ! সে দায়ী নয়, সে দায়ী নয়, দায়ী তো দেবাংশী।

(ক্রমশ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *