** অভিনেত্রী ** কাবেরী বোস ঘোরাই

** অভিনেত্রী **

কাবেরী বোস ঘোরাই
#নীলবৃষ্টি

আমি অনুমিতা কে প্রথম দেখি আমার ছোড়দির ছোটো জায়ের ছেলের জন্মদিনে , সব টিপটপ অবস্থায় যখন পার্টি চলছে , ছেলের কেক কাটা হয়ে গেছে , পার্টি প্রায় জমজমাট তখনই হঠাৎ আলুথালু নোংরা একটা জামা পড়ে , খোলা চুলে সে বাইরে এসে সবার মাঝে কিছু একটা খুঁজছিলো !! সবাই হতভম্ব , অপ্রস্তুত !! ছোড়দির শ্বশুরমশাই কড়া গলায় হুঙ্কার ছেড়ে বলেছিলো , এই কে আছো একে শিগ্‌গিরি নিয়ে যাও এখান থেকে!! তারপর দুজন মহিলা এসে অনুমিতা কে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়েছিলো সেখান থেকে!! পার্টির মুড কার্যতই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো তারপর সবাই ই প্রায় যত শীঘ্র সম্ভব খাওয়াদাওয়া করে বিদায় নিয়েছিলো এবং আমরাও সেইসাথে ফেরার সময় মা গাড়িতে বলেছিলো , কি কান্ড হ্যাঁ !! আরে আমি তো নন্দিতাকে কতবার বলেছি ওরম পাগল কে বাড়িতে না রেখে কোনো পাগলাগারদে রেখে আয় তানা!! কি লজ্জা ছি ছি!! আমি চুপ করে ছিলাম কথাগুলো ভালো লাগছিলোনা আমার , আমার ছোড়দি নন্দিতা একটি রত্ন বলা যায় , ছোটো থেকেই এদিক ওদিক সেদিক করে পড়াশুনোর দফারফা করে পাড়ার এক ছোকরা র সাথে এমনভাবে জড়িয়ে পড়েছিলো যে তাকে এইখানে বিয়ে দিয়ে সবাই হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে ! সম্মন্ধ টা তুলি মাসি করে , ছেলেও দোজবরে কারণ ছোড়দি যা কাণ্ড করেছে তাতে তাকে বিয়ে করার মতো কেউ ছিলোনা!! এরপর এই প্রতুল দার সাথে বিয়ে হয় , প্রতুলদাও দোজবরে, প্রথমে জেনেছিলাম তার বৌ মারা গেছে কিন্তু পরে জেনেছি না এই বাড়িতেই সে থাকে মাথার কোনো ঠিক নেই !! কারণ সে অনাথ কোথায় যাবে এই ভেবে বাড়ির কাজের লোকের মতোই তাকে রাখা হয়েছিলো পরে আস্তে আস্তে তার মাথার প্রব্লেম দেখা দেয় তখন তাকে একটা ঘরে আটকে রাখা হয় !! এইভাবেই কাটছে রাত্রদিন , অনেকবার শুনলেও তাকে এই প্রথম আমি স্বচক্ষে দেখলাম। মুখশ্রী ক্লান্তি আর অসুখে প্রায় শুকিয়ে গেছে , বেশ কালো , চোখগুলো খুব বড় বড় , আর মাথা ভর্তী চুল সে চুল পিঠ ছাড়িয়ে নেবে গেছে। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে বললাম দিদি কে জিজ্ঞেস করো যদি ওরা রাজি হয় তাহলে ওনার চিকিৎসার ব্যাবস্থা ও থাকার ব্যাবস্থা করে দেওয়া যাবে! মা চুপ করে থেকে বললো , দেখি দাঁড়া জিজ্ঞেস করে…

আমি পেশায় ডাক্তার , বেশ পসারো আছে , আমার দুই দিদির পর আমি শ্রীমান অজয় কুমার মিত্র, মা উঠেপড়ে বিয়ের সম্মন্ধ দেখছিলো কিন্তু আমি বিয়ে করবোনা বলে দিয়েছি, কিজানি বিশ্বস্ত জীবনসঙ্গী না পেলে জীবনই বৃথা !! দিদি ভালো হলেও ছোড়দির ব্যাপারে আমার তিক্ত অবিজ্ঞতা আছে !! তাই কোনো রিলেশনে যাবার খুব একটা ইচ্ছে নেই , সাতদিন বাদে মা বললো , অজয় শোন ওই মেয়েটাকে!! আমি বললাম কে!! মা মুখে বিরক্তিসূচক শব্দ করে বললো , আহ!! ওই যে রে পাগল টা নন্দি র শাশুড়ি র সাথে আমার কথা হয়েছে ওরা রাজি ওই আপদ কে বিদায় করতে দেখ কোথায় রাখা যায়!! আমি বললাম ,মা এরম ভাবে বলোনা ওই মেয়ের খুঁত আছে বলেই আজ ওর জায়গায় তোমার মেয়ে রয়েছে নইলে ছোড়দিকে!! মা আমায় থামিয়ে দিয়ে বললো ,আচ্ছা ঠিক আছে তুই দেখ , যত শীঘ্র হয় আমায় জানা। বেশ কিছুদিনের মধ্যিই সব ব্যাবস্থা হয়ে গেলো , অনুমিতা কে আনা হলো সুচিকিৎসার জন্য মেন্টাল এসাইলামে… সুস্থ হয়ে গেলেও এখানের হোষ্টেলে সে যাতে থাকতে পারে সেই ব্যাবস্থাই করা হয়েছে, অনুমিতা শান্তই চুপচাপ কোনো কথা বলেনা এর বাইরে তার আর কিছু নেই !! মাঝে মাঝে ক্লান্ত চোখদুটো বন্ধ করে বসে থাকে সে চোখে কি আছে জানা নেই !! আমি ফ্রি হলেই যাই সেখানে , খবর নিই সেরম খুব কিছু না হলেও আগের থেকে ভালো আছে। এইভাবে একদিন অনুমিতার সাথে আমার বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিলো , আমি গেলেই সে হাসতো , তাকে দেওয়া না না রঙিন ছবির বই গুলো আমার দিকে এগিয়ে দিতো , নিজের নামো বলতো অনুমিতা মিত্র !! সেযে আর মিত্র নেই তা আর কে বলবে এই হতভাগী কে!! মেয়েটার ওপর কেমন যেনো মায়া পড়ে গিয়েছিলো , আমারই বয়সী হবে ত্রিশ বত্রিশ বছর বয়স ! কি জীবন!! আমার জামাইবাবুর নাকি পছন্দ ছিলোনা তাও কিভাবে বিয়ে হয়েছিলো কে জানে! সেও আর এক জিনিষ এখন রতনে রতন চেনে হয়েছে , যেমন ছোড়দি তেমন নিজে!! যা যা পারে কর!! আমি দেখেছি অনুমিতা মিষ্টি খেতে খুব ভালোবাসে তাই নিয়ে যাই মাঝে মাঝে , খুব খুশী হয় সে। ভালো লাগে আমার… এইভাবেই দিনগুলো যাচ্ছিলো আমি জানি অনুমিতা আমার ভবিষ্যত নয় তাও তাকে ছাড়া কিছু ভাবতে পারিনা আমি ! আমার বাড়ির লোক অনেক বুঝিয়েছে কিন্তু আমি পারিনি , অনুমিতা এখন অনেক সুস্থ সে এখন হোষ্টেলে থাকে , ছ মাস অন্তর তার চেকাপ থাকে , নিজেই রান্না করে খায় , এখানেই কাজ করে , মাইনেও পায়। সেদিন আমি যেতেই সে বললো , অজয় দা আপনি আমার কাছে ভগবান এর সমান আপনি আমার জন্য অনেক করেছেন তাও আপনাকেই বলছি আমাকে অন্যকিছু কাজ দিতে পারেন আমি সেলাই জানি! বলেই সে চুপ করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো, আমি হেসে বললাম , এই রে ডাক্তারবাবু সেলাই এর কাজের লোককে জানবে কিভাবে! সে সঙ্গে সঙ্গে হাতজোড় করে বললো , আমার ভুল হয়ে গেছে মাফ করবেন আমি বুঝতে পারিনি!! আমি বললাম আরে না না তুমি লেখাপড়া করেছো কতদুর জানতে পারি! সে চুপ করে থেকে বললো , আমি বিএ পাশ , অনাথ আশ্রম থেকেই আমাকে লেখাপড়া করিয়েছে। আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললাম , হাসপাতালে কাজ করবে? সে চুপ করে রইলো , আমি বললাম , যদি কিছু মনে না করো আমি কি জানতে পারি তোমাকে প্রতুল দার কেন পছন্দ হলোনা!!

অনুমিতা বললো , আপনি বসুন , আমি একটু চা করে আনি । একটু পরে চা সঙ্গে চারটে রুটি আর ক্যাপসিকাম দিয়ে সয়াবিনের তরকারি আর তারজন্যেই আনা দুটো মিষ্টি দিয়ে বললো , খেয়ে নিন খুব সামান্যেই , অনুমিতা খুব ভালো রান্না করে এই কদিনে তার হাতে টুকটাক খেয়ে আমি বুঝেছি !! আমি হেসে বললাম দাও দাও খুব খিদে পেয়েছে আমার , সে কিছুখন বাদে চা নিয়ে এলো , আমি তৃপ্তি র সাথে চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম , এসো বোসো অনুমিতা… অনুমিতা বসলো চায়ের কাপ হাতে , আমি বললাম তুমি জানো প্রতুল দা তোমায় ডির্ভোস দিয়ে আমার ছোড়দিকে বিয়ে করেছে? সে অল্প হাসলো তারপর ঘাড় নেড়ে বললো , হ্যাঁ জানি বললো ভালোই তো প্রতুল দা আর তার মা যেরম চেয়েছিলো সেরমই পেয়েছে আমিতো!!প্রতুল সেই সময় এন জি ও র সাথে কাজ করতো সেই সূত্রে আমার সাথে পরিচয় এবং নিজের পছন্দে বিয়ে !! অথচ আমার শাশুড়িমা ছেলের বিয়েতে টাকাপয়সা সোনা দানা টিভি ফ্রিজ সব নেবে বলে বসে আছে , সে আমাকে মানবে কেন!! কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হলো চরম অশান্তি ! আমার শ্বশুরমশাই এক কাপড়ে আমায় বাড়ি থেকে বের করে দিলো ! কোথায় যাবো কি করবো ভেবে না পেয়ে পাড়ার পার্টি অফিসে গিয়ে বললাম তারা এসে আমায় আবার ওই বাড়িতে দিয়ে গেলো, এবার কাজের লোক হিসেবে আমায় রাখা হলো , আর ইচ্ছে মতো ব্যাবহার ও করা হতো , প্রতুল বাদে তার ভাই ও আমার শ্বশুরমশাই ও সুযোগ নিতে ছাড়েনি !! সবই আমার শাশুড়িমার নির্দেশে অবশ্য এরপর আমি অন্তঃস্বত্বা হয়ে পড়ি ইচ্ছে করেই কাউকে বলিনা যাতে এদের কুকর্ম ফাঁস হয় এরপর একদিন এরা জানতে পারে আমি মা হতে চলেছি আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় দেওঘরে প্রতুলের মাসির বাড়ি , ফিরে আসি এক মেয়ে সন্তান কে কোলে নিয়ে !! কিন্তু সেও আমার ই মতো কালো!! তবু আমি তো তার মা কি করে ফেলে দিই !! আবার শুরু হয় অত্যাচার !! সব মুখ বুজে সহ্য করতে থাকি আর মেয়েকে বড় করে তুলতে থাকি, কিন্তু মেয়েটাকে কেউ সহ্য করতে পারতোনা মাত্র দুদিনের জ্বরে সেও আমায় ছেড়ে চলে গেলো!! কোনো ডাক্তার পথ্য না পেয়ে!! বোবা হয়ে গিয়েছিলাম তখন আপনার বোনের সম্মন্ধ এলো শাশুড়িমা ঘরে এসে বললো , শোনো মেয়ে আমার প্রতুলের সম্মন্ধ এসেছে অনেক বড় ঘর থেকে সোনায় মুড়ে দেবে তারা মেয়েকে তোমার মতো হাভাতে নয় কিন্তু আমরা বলেছি তার বৌ মরে গেছে!! কিন্তু এসব তো চলবেনা বেশীদিন তাই তুমি পাগল সেজে থাকবে বুঝলে কেউ যদি জানতে পারে তুমি পাগল নও তাহলে দেখবে কি দশা করি তোমার! সেইথেকে পাগলের অভিনয় শুরু !! আচ্ছা অজয় দা আমি ভালো অভিনয় ও পারি কিন্তু সেইখানেও তো আমাকে কাজ দিতে পারেন!! আমি অপার বিস্ময়ে অনুমিতার দিকে তাকিয়ে ছিলাম !! কথা বলতে পারিনি শুধু বুকের ভেতর কোথাও কিছু ভেঙে যাচ্ছিলো!! চলে এসেছিলাম কোনো উওর না দিয়েই , কিছুদিনের জন্য বাইরে গিয়েছিলাম আর মনস্থির করে ফেলেছিলাম যে ফিরে এসে আমি অনুমিতা কে বিয়ের প্রস্তাব দেবো যদি সে রাজি হয় ভালো নইলে চিরকাল এভাবেই থেকে যাবো! ফিরে এসে অনুমিতার খোঁজ করলাম শুনলাম সে মেন্টাল এসাইলামে !! দৌড়ে গেলাম সেখানে , ডাক্তার দীপঙ্কর বসাক আমাকে বললো , বসুন ডাক্তার মিত্র , অনুমিতা র আবার সব সিমটম ফিরে এসেছে !! আমি চেঁচিয়ে বললাম, না না ও পাগল নয় ডক্টর ও পাগল নয় সে আমায় নিজে বলেছে!! ও অভিনয় করছে পুরোটা !! কিন্তু কেন!! ডক্টর বসাক আমাকে বললো , আপনি ওকে গিয়ে দেখে আসুন প্লিজ … আমি গেলাম , অনুমিতা আমায় দেখেও দেখলোনা !! আমি বললাম ,কেন কেন কেন অনু কেন!! আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই, সুস্থ জীবন দিতে চাই , আমি ভালোবাসি তোমায় অনু!! কিন্তু সে নিশ্চুপ অন্য দিকে তাকিয়ে ! আমি বললাম , তুমি শুনছো অনু !! আমাকে আর বলতে দেওয়া হলোনা সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো!! এরপর ও বহুবার গিয়ে বলেছি কোনো সাড়া পাইনি!! অনুমিতা মুখ ঘুরিয়ে দেখে অজয় চলে যাচ্ছে তার করুণ আকুতি কে অগ্রাহ্য করা খুব মুশকিল কিন্তু কি করে বলবে অনু অজয়ের মা এসে দিব্যি দিয়ে গেছে তার অজয় কে যেনো মুক্তি দেওয়া হয় তাসে পাগল সেজেই হোক না কেন!! তাইইই বহু মেয়েকে জীবনে অনেক কিছু সেজেই কাটাতে হয় তার জীবনের রোলটা হয়তো এই পাগলেরই …!!

কাবেরী বোস ঘোরাই
#নীলবৃষ্টি

স্বত্ব সংরক্ষিত

1 thought on “** অভিনেত্রী ** কাবেরী বোস ঘোরাই

  1. দুই একটা জায়গায় টাইপো হয়েছে। কিন্তু গল্প বলার সাবলীল গতি খুব ভাল লেগেছে। মেয়েরা মেয়েদের দুঃখের কথা যতো ভাল লিখতে পারবে, আমরা কি আর তেমন পারি?
    অনেক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন, বন্ধু।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *