শিরোনাম- বন্ধ দুয়ার / গল্প কলমে-ছন্দা চট্টোপাধ্যায়।

শিরোনাম- বন্ধ দুয়ার / গল্প

কলমে-ছন্দা চট্টোপাধ্যায়।

অনিশ্চিত জীবন,অজানা ভবিষ্যৎ। তবু হেঁটেই চলেছেন নিলীমা। তাঁর মনে উথালপাথাল একটাই প্রশ্ন,-” কিসের সন্ধানে চলেছি আমি? কী কী হারিয়েছি? কী পেতে চাই ফিরে?”– মনে পড়ে ধনী ঘরের আদরের দুলালী ছিল সে। মা-বাবার নয়নের মনি। একান্নবর্তী পরিবারের দাদুভাই, ঠাকুমা,জেঠু, কাকুদের নিয়ে জমকালো সংসার। তখন মুখ ফুটে কিছু চাইতেও হতো না। শুধু অভিজাত,সম্পন্ন পরিবারের ঐতিহ্য মেনে চলতে নির্দেশ দেওয়া ছিল। নিলীমা নিজেও শান্তশিষ্ট, ভদ্র,সভ‍্য এবং বাধ‍্য মানসিকতার মেধাসম্পন্ন মেয়ে। তার রূপে উজ্জ্বল জৌলুস ছিল না, ছিল স্নিগ্ধ কমনীয়তা। তবু বয়োঃসন্ধির অসতর্ক মূহুর্তে কখন যে পদস্খলন হলো! নিখিল নামের সেই তরুণ, যে ভালোবাসার নামে অবিমৃষ‍্যকারী সিঁদুর পড়িয়ে দিয়ে নিয়ে গেলো নিজের জীর্ণ কুঁড়েঘরে। শ্বশুর ও শাশুড়িমা সাগ্রহে বরণ করলেন নিলীমাকে। কেউ ভাবতেও পারেনি, এরপরে কী ঝড় অপেক্ষা করছে তাদের জীবনে। কী হারাতে চলেছে তারা! নিখিল বলেছিল-” নীলু, আমাদের বাড়িতে রোজ মাছ হয়না, সরু চালের ভাত খাওয়ার সামর্থ‍্য নেই আমাদের। তুমি কী পারবে আমাদের সংসারে মানিয়ে থাকতে?”– নিলীমা বলেছিল -” একবার নিয়ে চলো তো, দেখো কেমন মানিয়ে নিই। তবু আমাকে বাড়ি ফিরতে বোলো না। এতো নিয়মকানুন মেনে থাকতে হয়, হাঁপিয়ে উঠেছি আমি।”– ক্লাস নাইনের মেয়ের মুখে পাকা পাকা কথা শুনে হাসে নিখিল। বি.এস.সি পাশ বেকার যুবক, নিলীমার অঙ্কের মাষ্টার। তারপর অপরিণত সিদ্ধান্ত। নয়নের মনি হওয়া বোধহয় নিলীমার বিধিলিপি। শ্বশুর শাশুড়ির আর স্বামীরও নয়নের মনি সে। তবে সুখ নয় চিরস্থায়ী। নিলীমা একচোখো হরিণের মতো ভাবেনি যে, চৌধুরী পরিবারের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে! প্রথমত,নাবালিকা অপহরণের দায়, দ্বিতীয়ত,নিলীমার গায়ে সবসময় পরার জন‍্য যে গয়না ছিল,তা হার, বালা,আংটি, মাকরি মিলিয়ে ভরি দশেকের মতো হবে। তা চুরি করার দায়ে নিখিলের নামে থানা-পুলিশ করলেন নিলীমার বাবা জেঠু কাকারা। নিলীমাকে টেনে হিঁচড়ে বাড়ি আনা হলো। নিখিলের জেল হয়ে গেলো। শোকে পাথর নিখিলের মা,বাবা আত্মহত‍্যা করলেন।

অনেক বছর পরে। কালের চাকা ঘুরে চলেছে।গ্রামে তখন গুরুমা ট্রেনিং শুরু হয়েছে। নিলীমা তার গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষিকা। নাঃ তার বাবা মায়েরা আর তাকে বিয়ে দিতে পারেননি। নয়নের মনি এখন সে স্কুলের খুদে পড়ুয়াদের। এইভাবে দিন চলে। নিলীমার অবসরের দিন এসে যায়।

আজকাল বড়ো একা লাগে। নিখিল জেল থেকে ফিরেছিল কিনা জানেন না নিলীমা দিদিমনি। শুধু জানেন তাদের সেই মাটির বাড়ি কালের ঘুর্ণিঝড়ে মাটিতে মিশে গেছে।শুধু একখানা ঘরের একটা চৌকাট যেন রকের মতো জেগে আছে। সেখানে এখন ছাগল চরে। একদিন কৌতুহলবশত পায়ে পায়ে চলে যান সেই স্মৃতি বিজড়িত স্থানে। মাত্র একমাস সংসার করা এই একফালি জমি নিলীমার তীর্থস্থানের মতো।তারপর নেশার মতো প্রতি প্রত‍্যুষে আর অপরাহ্নে নিলীমা চলে যান তাঁর চারণভূমিতে। কিসের খোঁজে আসি আমি রোজ এখানে? নিজেকেই প্রশ্ন করেন বৃদ্ধা।

এখন প্রভাত ও সান্ধ‍্যভ্রমণ নিলীমার প্রাত‍্যহিক কাজের মধ‍্যেই পড়ে। এক সন্ধ‍্যায় দেখেন কে যেন বসে আছে ভেঙে পড়া এক টুকরো রকের মতো চৌকাঠে। নিলীমা একটু এগিয়ে যান,-” কে আপনি?”– অসংলগ্ন উত্তর আসে,-” কে আমি! মনে পড়ছে না তো! আচ্ছা,নিখিলকে চেনেন আপনি? আমি নিখিলকে খুঁজছি।”– আপাদমস্তক বিদ‍্যুৎ খেলে যায় নিলীমার। –” কে আপনি? নিখিলকে কী ভাবে চেনেন? “– আগন্তুক বলে,ধীরে ধীরে যেন স্মৃতির অতলে ডুব দিয়ে দিয়ে -” জেলে নিখিলকে খুব মারতো,অঙ্ক পারতো না তো, তাই..”– নিলীমা মোবাইলের টর্চটা জ্বেলে আলো ফেলেন আগন্তুকের মুখে। সেই মায়াবী চোখ দুটি আজ কী করুণ! কী উদাস!! নিলীমা আগন্তুকের হাত দুটি ধরেন। আস্তে আস্তে বাড়ির দিকে এগিয়ে চলেন। আগন্তুক বলেন -” কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমায়? জেলে নয়তো?”– নিলীমা প্রশ্ন করেন –” নিলীমাকে মনে পড়ে?”– আগন্তুক মলিন হাসে–” ও খুব ভালো, জানেন, কী ভালো গান করে”– দু কলি গেয়ে ওঠে আগন্তুক –“তুমি সন্ধ‍্যার মেঘমালা,তুমি আমারো সাধের সাধনা”– নিলীমা ঘরে আনেন নিখিলকে। ভাইপোরা আর তাদের বৌরা অবাক হয়ে যায়। -“ইনি কে পিসি?”- -“ইনিই তোমাদের পিসেমশাই নিখিল ঘোষ।”- সবাই হতবাক। তারা জানতো, অথবা তাদের বোঝানো হয়েছিল নিলীমা অল্প বয়সের বিধবা। তাঁর প্রিয় ভাইপোবৌ নীনাকেই তিনি কিছু মনের কথা মাঝেমাঝে বলেন। নীনার দিকে নিজের মাথাটা ঝুঁকিয়ে দেন নিলীমা।-” দ‍্যাখ্ চুলের ফাঁকে সিঁদুরের ছোঁয়া।”–

ফিরে পেয়েছেন নিলীমা নিখিলকে, নিখিল তাঁর নিলীমাকে। জেলে খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, বহুদিন আগেই মুক্তি পেয়েছিলেন নিখিল। তারপর জেল থেকে বেরিয়ে কোথায় গেছিলেন কর্তৃপক্ষ তা জানাতে অপারগ। এরপর ডাক্তার দেখিয়ে,মানসিক চিকিৎসা করিয়ে নিখিলকে অনেকটা সুস্থ করে তুলেছেন নিলীমা। শুধু বিষন্নতা কাটছে না নিখিলের। ডাক্তার বলেছেন ওনাকে উৎফুল্ল রাখার চেষ্টা করতে হবে,ফিরিয়ে দিতে হবে ওনার স্মৃতি। নিলীমা নিখিলের বাড়িটা আবার সেই ভাবেই তৈরী করাচ্ছেন। সেই ঘর, সেই দাওয়া, সেই চৌকাঠ। বন্ধ হৃদয়ের দুয়ার আজ খুলে গেছে। স্মৃতিরা এখন উঁকি মারছে নিখিলের। দাওয়ায় বসে চাঁদের আলো গায়ে মেখে বলে নিখিল-” নীলু, এর কী কোন দরকার ছিলো? কী লাভ? এই যে এতো -“দীর্ঘ মন্থর দিন”- কার লেখা যেন নীলু?! “– কেটে তো যাচ্ছিল! আমাদের যে দিন গেছে,একেবারেই গেছে”– নিলীমা হাসেন, —“সমর সেন।”- তোমার মনে পড়ছে কবিতা!- “ওগো তুমি নিরুপম”- তবু তো ফিরে পেয়েছি আমরা আমাদের ভিটে। ফিরে পেয়েছি নিজেরা পরস্পরকে। বলো! “– নিখিল বলে -” রাতের সকল তারা থাকে দিনের আলোর গভীরে।”- জ‍্যোৎস্নাপ্লাবন গায়ে মেখে পরস্পরের হাত ধরে মাটির দাওয়ায় বসে রইলো বৃদ্ধ ও মুগ্ধ দম্পতি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *