মিরুজিন আলো
মিরুজিন আলো
তিন
রেস্তরাঁতে বসে মেনুকার্ডটা পড়ছে পারিজাত খুঁটিয়ে। কী খেতে ইচ্ছে তার আজ? কী খেলে একটা তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলা যাবে? ওয়েটার দুবার এসে ঘুরে গেল। কিছুই পছন্দ হচ্ছে না। টের পেল তেমন খিদে নেই আসলে। চলে যাবে?
-স্যার?
মুখ তুলে তাকাল পারিজাত। ওয়েটার। এ নিয়ে তিনবার এল। ওর মুখের দিকে তাকাল পারিজাত। বেশবাসে পারিপাট্য। মুখ অভিব্যক্তিহীন। কাজ করে যাচ্ছে।
এখন এভাবে চলে যাওয়াটা ভালো দেখায় না। কিছু একটা অর্ডার দিতে হবে। মেনুকার্ডের দিকে নজর ফেরাতেই চোখে পড়ল “চিকেন হানি”… পারিজাতের তর্জনি ছুঁয়ে নিল ওটাই।
“চিকেন হানি” স্যার? – বলে একটু যেন স্বস্তি পেয়ে ওয়েটার ত্রস্তে চলে গেল। কেন দিল সে চিকেন হানির অর্ডার? কোনওদিন চেখেও দেখা হয়নি। তাই হয়তো । ওয়েটার নিয়ে এল। বোনলেস চিকেন দিয়ে তৈরি। মধু-র স্বাদ গন্ধ ঠিক হৃদয়ঙ্গম করা গেল না। খাওয়া শুরু করেছে পারিজাত। অতি ধীরেসুস্থে।
-আজ এখানে থাকব অনেকটা সময়, শেষ বিকেল অব্দি। চার্জ কত? ওয়েটারকে বলল সে।
দুটো ছাত্র পড়তে আসবে সেই সন্ধ্যার পর। আপাতত বাড়িতে ফিরতে ইচ্ছে নেই, কোথাও যেতে ইচ্ছে নেই। ঘড়ি দেখল। এখন আড়াইটে।
-স্যরি! আপনার হয়েছে?
পারিজাত মেয়েলি কণ্ঠে চমকে তাকাল।
-একটু তাকিয়ে দেখুন, একটা টেবিলও খালি নেই। আমি অপেক্ষায় আছি। মনে হচ্ছে আপনি অনেকক্ষণ ধরে খেয়েই চলেছেন। ধীরেসুস্থে।
পারিজাত বলে – এখানেই বসে পড়ুন। নো প্রবলেম। আমার একটু সময় লাগবে।
মেয়েটি বলে – ও। দাঁতে ব্যথা?
পারিজাত বাঁহাতের তর্জনি তুলে বলে-ঠিক। একদম ঠিক। দাঁতে ব্যথা। কী করে বুঝলেন?
মেয়েটি চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল – কোনও ঠিকই আর ঠিক নেই কিনা তাই বুঝলাম। তা আপনি চিবোচ্ছেন যে দিব্যি?
পারিজাত এতক্ষণ পর নড়েচড়ে বসল।
বলল – কী করব বলুন, পেটের তো আর দাঁত নেই!
মেয়েটি গম্ভীরমুখে বলে – হুম। তা আর কতক্ষণ চলবে?
-সে বলতে পারছি না।
-হুম।
মেয়েটি একটা স্যুপের অর্ডার দিল। চিকেন ক্লিয়ার স্যুপ।
-আচ্ছা মুরগির জন্ম হয় কেন বলতে পারেন?
পারিজাতের প্রশ্নে মেয়েটি সপাটে উত্তর দেয় – পরার্থে।
-ঠিক। “একটি মোরগের কাহিনি” পড়েছেন?
-হ্যাঁ শুনেছি। আবৃত্তি শুনেছি ইউ টিউবে।
-আবৃত্তি শোনেন?
-না! ঐ একদিন মুরগির রেসিপি শুনতে গিয়ে সার্চ বাটনে ভুল করে আঙুল ছোঁয়াতে চলে এল। ভাবলাম শুনে নিই। আবৃত্তিতে কে ছিল এখন মনে পড়ছে না। তবে এরপর কবির আরও কিছু কবিতা শুনলাম। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। খুব প্রিয় কবি। আপনার প্লেটে অনেকটা পড়ে আছে। এগুলো শেষ করতে করতে অনেকটা সময় পেরিয়ে যাবে। ততক্ষণ এরা অ্যালাউ করবে?
-অত ভাবছেন কেন? কথা বলতে বলতে খান। ভালোই লাগবে।
মেয়েটি এবার মৃদু হাসল।
-সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা নিয়ে অতঃপর ভাবলেন?
-অবশ্যই ভেবেছি।
-কি ভাবলেন?
-ঐ মুরগিটি প্রতীকায়িত। কিশোরীবেলায় একটা সাদা মুরগি ঠিক এমনি আমাদের বাড়ি পথ ভুলে এসেছিল। আমরা তাকে খুব যত্ন করে রেখেছিলাম। তারপর একদিন সে চিকেনকারি হয়ে খাবার টেবিলে উপস্থিত। খেয়ে সব উগড়ে বের করে দিয়েছিলাম। খুব কষ্ট হয়েছিল। তারপর কী করে যেন সব রপ্ত হয়ে গেছে। এখন তো খাই। চোখে জল আর আসে না।
-কবিতা লেখেন?
-নাহ্। আমি সাহিত্যের ছাত্রী। ইংরাজি সাহিত্য।
-বাংলা সাহিত্য পড়েন তাহলে?
-কিছু কিছু। তবে আলোচনা করতে চাইছি না এখন।
-ওহ! কেন?
-সেটাও বলতে চাইছি না। আমি আসলে একটু একা একা থাকতে চাইছি।
-ওহ। দাঁড়ান। কোনও টেবিল কি খালি হল? দাঁড়ান দেখে নি।
-আপনার এখন এই টেবিল ছেড়ে দেওয়া উচিত।
পারিজাত মৃদু হাসল।ওয়েটার ছেলেটি অদূরে দাঁড়িয়ে শুনছে। এগিয়ে এসে মেয়েটিকে বলল – আপনি কি বসবেন কিছু সময়? তাহলে টেবিল কিছু সময়ের জন্যে বুক করতে পারেন। স্যার এটা সন্ধে অব্দি বুক করেছেন।
মেয়েটি বলে – ওহো স্যরি। আমি জানতাম না। বেশ আমি চলে যাচ্ছি। আমার অর্ডার?
-আনছি ম্যাম। একটু অপেক্ষা করতে হবে।
-আপনি এখানে চুপচাপ সময় কাটাতে পারেন ইচ্ছে করলে। আমি চুপ করেই থাকব নাহয়।
-সেটা খুবই অদ্ভুত দেখাবে।
-কেন? আমরা তো কেউই কাউকে চিনি না।
-তাহলেও।। ঐটা হয় না।
পারিজাত এবার বলে – টেবিলটা আমি বুক করেছি ঠিকই, তবে আপনাকে এটা ছেড়ে দিয়ে চলে যেতেও পারি, তবে অনেকটা সময় বাকি।
-কীসের?
-ছাত্র আসার।
-কীসের ছাত্র?
-ছাত্র আবার কীসের? আমার!
-ও। ছাত্র পড়ানো হয়। আপনি আবার কী পড়াবেন?
-মানে?
-এলোমেলো সব। ছেড়ে দিন ওদের।
-কী করে বুঝলেন এলোমেলো?
-ওসব বোঝা যায়।
দেয়ালে বড় একটা টিভি। অ্যানিমেল প্ল্যানেট। শব্দহীন চলছে। পারিজাত ওদিকে তাকিয়ে। সবুজ অরণ্য। একটা বাঘ। জল খাচ্ছে।
-এভাবে অচেনা মানুষের সম্পর্কে কিছু না জেনে মন্তব্য করা কি ঠিক?
-কী জানি! অন্য কেউ হলে করতাম না।
-মানে?
-অনেক কথার কোনও মানে হয় না মশাই।
ওয়েটার চিকেন ক্লিয়ার স্যূপ রেখে গেল।
পারিজাত এবার কফির অর্ডার দিতে গিয়ে মেয়েটিকে বলল – কফি চলবে?
মেয়েটি মাথা নেড়ে সায় দেয়।
একটু অবাক হল পারিজাত। যাহোক, দুটো কফির অর্ডার দিল। একটা ছোট্ট ধন্যবাদ দিয়ে আর কোনও কথা না বলেই তারিয়ে তারিয়ে কফি খেতে খেতে মেয়েটি ঐ নিঃশব্দে চলমান টিভি দেখছে। আইনের চোখে ধুলো দিয়ে হাতে বন্দুক এক গুপ্ত শিকারি জঙ্গলের ভেতর ঢুকে পড়েছে। আর তাকে ধরতে অরণ্যআইন রক্ষক আর একটি লোক নিঃশব্দে এগোচ্ছে। পারিজাতও টিভিতে তাকিয়ে। ধীরে চুমুক দিচ্ছে কফিতে।
-এই আবহেও একটা চাপা আলো। কেমন অপূর্ব নিস্তেজ একটা চাপা আলো। নিশ্চয়ই আপনারও চোখে পড়ছে।
পারিজাত দেখল একটা চাপা নৈসর্গিক আলো.. তার ভেতর দিয়েই এগোচ্ছে শিকারি.. পেছনে আইনরক্ষক…
(ক্রমশ)