তুমি নির্মল করো মঙ্গল করে …. ✍©ডরোথী দাশ বিশ্বাস

তুমি নির্মল করো মঙ্গল করে ….

✍©ডরোথী দাশ বিশ্বাস

সপ্তাহব্যাপী নির্মল বিদ্যালয় অভিযান চলছে, প্রার্থনা সঙ্গীত ও শপথবাণীর পর, ঐ প্রার্থনাসভাতেই এক একদিন এক একজন শিক্ষিকার উপর ভার- নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর কিছু বলার। সেরকমই আজ আমার উপর দায়িত্ব ছিলো। বিষয় প্লাস্টিক পরিহার ও জলের সঠিক ব্যবহার। সময় দশ- মিনিট। ঐ সময়ে ছাত্রীদের বোঝার উপযোগী করে সহজভাষায় যতটা সচেতন করা যায়। প্রতিদিন যতটা পারা যায় এই সুন্দর মুহূর্তটি ক্যামেরাবন্দী করেছি আমি। আমার আজকের বক্তব্য বিষয়টি ছিলো নিম্নরূপ—

১৷ প্লাস্টিক জৈবভঙ্গুর নয় অর্থাৎ সহজে বিক্রিয়াও করে না, প্রাকৃতিকভাবে ভাঙেও না। ফলে প্রকৃতিতে এটি ক্রমশঃ জমতেই থাকছে। ফলে জল বেরিয়ে যেতে পারছে না, বর্ষার জলও জমছে, বন্যা হচ্ছে, মশা মাছির বাড়বাড়ন্ত হচ্ছে, ডেঙুর মত রোগ ঘুরে ফিরে আসছে।

২৷ প্লাস্টিক জমে জমি চাষের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। সেই জমিতে নস্টক, অ্যানাবিনার মত উপকারী অণুজীবও আর বসবাস করতে পারছে না।, ফলে নাইট্রোজেন চক্র বিঘ্নিত হচ্ছে।

৩৷ ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক ক্রমশঃ বিবর্ণ হয়ে যায় ও বহুদিন পর ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায়। বিজ্ঞানীদের বক্তব্য প্লাস্টিক মাটির নীচে অন্ততঃ তিনশো বছর একই রকম থাকতে পারে। প্লাস্টিক বিয়োজিত করে এমন কোন জীবাণু প্রকৃতিগতভাবে নেই। তবে জীবাণু আবিষ্কারের চেষ্টা চলছে জেনেটিক ইঞ্জিনীয়ারিংএর মাধ্যমে যা অত্যন্ত ব্যায়সাপেক্ষ।

৪৷ আমাদের দেশে ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক বর্জ্যের ৮০% পুনঃপ্রক্রিয়াকরণের জন্য সংগৃহীত হয়। পেটের তাগিদে এ কাজে সহায়তা করে হাজার হাজার জঞ্জালকুড়ুনি ও ফেরিওয়ালা। তবে কয়েকবার প্রক্রিয়াকরণের পরই তা ব্যবহারের অনুপযুক্ত হয়ে যায়। এ ভাবে তৈরি প্লাস্টিকের গুণগত মান যেমন খারাপ, স্বাস্থ্যের পক্ষেও তা ক্ষতিকর।

৫৷ পলিথিন ক্যারিব্যাগ পরিবেশবিদদের মাথাব্যথার কারণ। কালো রঙের প্লাস্টিক সবচেয়ে ক্ষতিকর। এতে টাইটেনিয়াম ডাই অক্সাইড, ক্যাডমিয়াম ও সীসাযুক্ত পদার্থ থাকায় এটা খুব বিষাক্ত। এইরকম পলিব্যাগ ও অন্যান্য রঙীন পলিব্যাগে কোন খাবার রাখলে ঐ প্লাস্টিকের ক্ষতিকারক উপাদানগুলো খাবারে মিশে বিষাক্ত করে তোলে। তাই সরকারী ঘোষণায় সাদা বা স্বচ্ছ পলিব্যাগ ব্যাবহার করার কথা বলা হয়।

৬৷ প্লাস্টিক বর্জ্যের ক্যালোরিগত মান বেশি হওয়ায় জ্বালানী হিসেবেও একে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্লাস্টিক পোড়ালে ধোঁওয়ার সাথে ক্ষতিকর ডাইঅক্সিন ও ফিউরান বাতাসে মিশে ব্যাপক দূষণ ঘটে। এতে মানুষের শ্বাসকষ্ট বাড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ডাই অক্সিন মানুষের ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদান। এটি শরীরের হর্মোনগ্রন্থিরও ক্ষতি করে। ডাই অক্সিন ও ডাই বেঞ্জো ফিউরান খাদ্যশৃঙ্খলের মাধ্যমে উদ্ভিদ ও প্রাণী মারফৎ শেষে মানুষে পৌঁছায়।

৭৷ জিনের ওপর প্রভাব ফেলে প্লাস্টিক। কোন কোন প্লাস্টিক তৈরিতে বিসফেনল এ নামের একটি সাদা রঙের কঠিন যৌগ থাকে, যা গর্ভস্থ ভ্রূণের জননাঙ্গের ক্ষতি করতে পারে। ইস্ট্রোজেনের স্বাভাবিক কাজে বাধা সৃষ্টি করে এই বিসফেনল এ, এর ফলে সন্তানসম্ভবা মহিলার গর্ভপাত হওয়ার বা সন্তানের ডাউন্স সিন্ড্রোমে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বাড়ে।

৮৷ সমুদ্রে ভাসমান প্লাস্টিক সামুদ্রিক প্রাণী যেমন কচ্ছপ, তিমি ভুল করে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করলে প্লাস্টিক তাদের অন্ত্রে ও অন্যান্য অংশে আটকে গিয়ে মৃত্যুর কারণ হয়। বহু গবাদিপশুর মৃত্যুর কারণ প্লাস্টিকে মোড়া সব্জির অবশিষ্টাংশ।

৮৷ আরো দুর্ভাবনার বিষয় হল প্রধান খাদ্য হিসেবে যে চাল ব্যবহার করা হয়, সেটাও প্লাস্টিক পালিশ করা হচ্ছে।

৯৷ পেট্রোকেমিক্যাল শিল্পের উপজাতদ্রব্য হিসেবে একদিন যে প্লাস্টিকের যাত্রা শুরু হয়েছিলো, আজ সেই প্লাস্টিক দানবের আচ্ছাদনে শিশুর হাসির মত পবিত্র পরিবেশ শ্বাসরুদ্ধ। তাই আজ সময় এসেছে ব্যক্তিগত সুবিধার উর্ধ্বে গিয়ে সার্বজনীন মঙ্গলসাধনের জন্য প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহারকে চিরতরে বিদায় জানাবার।

জল …

অতিরিক্ত প্লাস্টিক ব্যবহারে মাটির সচ্ছিদ্রতা নষ্ট হচ্ছে, বৃষ্টির জল মাটিতে প্রবেশ করতে পারছে না, ভৌমজলস্তর শেষ হয়ে যাচ্ছে, অর্থাৎ প্রকৃতির জলচক্র বিঘ্নিত হচ্ছে,

অজ্ঞতাজনিত কারণে জনসংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়ছে,

মানুষের গৃহ নির্মাণের প্রয়োজনে জলাভূমি ভরাট করা হচ্ছে, ফলে পানীয় জলের উৎস কমে যাচ্ছে।

শিল্পাঞ্চলে কলকারখানার বর্জ্য: যেমন ক্লোরিন, কস্টিক সোডা, ফেনল সায়ানাইড, আর্সেনিক, ফ্লুরাইড, অ্যামোনিয়া, সীসা- এইসব অতিরিক্ত রাসায়নিক পদার্থ জলে মিশে জল দূষিত করছে।

কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার, কীটনাশক- বৃষ্টির জলে ধুয়ে পুকুর ও নদীতে গিয়ে মিশে জলকে খাবার অনুপযুক্ত করে তোলে।

গ্রামবাংলা, পাহাড়ি অঞ্চলে এখনো মানুষ খাবার জলের জন্য পুকুর ও ঝোড়ার জলের ওপর নির্ভর করে। এই দূষিত জল খেলে জলবাহিত নানা রোগ যেমন: পেটের অসুখ, টাইফয়েড, জন্ডিস হয়।

দেখতে পাচ্ছি বহু জায়গায় জলসংক্রান্ত এতগুলি সমস্যা বর্তমানে আমরা ফেস করছি, তাই জল ব্যবহারে সচেতন না হলে অদূর ভবিষ্যতে সমুহ বিপদের সম্মুখীন হবো আমরা সবাই। তাই আজ এই মুহূর্ত থেকে শপথ নেবো: “প্লাস্টিক বর্জন করবো আর সঠিক ভাবে জলের ব্যবহার করবো। অযথা জল নষ্ট করবো না।

হেল্থ ইজ ওয়েল্থ- স্বাস্থ্যই সম্পদ
এই হোক আমাদের প্রতিদিনের শপথ
স্বাস্থ্যবিধান মানবো
বিদ্যালয়কে নির্মল করবো।
সময়ের কাজ সময়ে করি,
এসো নির্মল স্কুল গড়ি।
রাস্তাঘাটে বর্জ্য নয়,
তাতে শরীর মলিন হয়।
পরিষ্কার বিশুদ্ধ জল পান
এই হোক আমাদের আহ্বান।
সাবান দিয়ে হস্ত পরিষ্কার
করবো মোরা অঙ্গীকার।
প্লাস্টিক ফেলবোনা যত্রতত্র
নির্মল রাখবো বিশ্বগাত্র।
নির্মল বাতাস, স্বচ্ছ জল
এগিয়ে চলো শিক্ষার্থীদল….

✍©ডরোথী দাশ বিশ্বাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *