মিরুজিন আলো ✒️✒️ বিজয়া দেব ।

উপন্যাস

মিরুজিন আলো

বিজয়া দেব ।

এক

-শুরু থেকেই যদি কথাগুলো বলে যাই তা হলে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে তোমার, কী হয় আমার জানি না মাঝে মাঝে মনে হয় শূন্যে ভাসছি। ভাসতে ভাসতে চলছি মহাশূন্যে। অন্ধকার আর বিষম ঠান্ডা। সেই বিপুল অন্ধকারে জ্বলজ্বলে সূর্য, সেটা পৃথিবীর সূর্য না কি অন্য সূর্য জানি না।
-এই অনুভূতিটা ঠিক কখন হয়? যখন তোমাকে বলি আর এসো না, তখন কি?
-সেসব বলতে পারব না। তবে এই মহাশূন্যে ভাসমান পৃথিবীতে অর্থহীন চক্রমণ আছে, সেটা নিয়ে যখন ভাবি তখন এমনটা মনে হয়। তোমার কাছে আসতে না পারলে আমার কোনও অসুবিধে হয় না জুহি। তোমার আমার সম্পর্কে কি আদৌ কিছু আছে আর?
-তাহলে আমরা এই পার্কে বসে আছি কেন? অন্তত দুঘন্টা হয়ে গেল আমরা এভাবে এলোমেলো কথা বলছি।
-এসব কথায় কথা জড়ানোর খেলা। এর বেশি কিছু নয়।
-তাই? তাহলে সে কথাগুলো একা একা অথবা অন্য কারো সাথে বললেই তো হয় পারিজাত।
-হয় তো। এই পার্কেই তো, সম্ভবত এই বেঞ্চেই এইভাবে এই সময়ে বসে আমি কথাগুলো আর কাউকে বলেছি নিশ্চিত।
-এ জন্মে? নাকি পূর্বজন্মে?
-আমাকে পূর্বজন্ম পরজন্ম এসবে কখনও বিশ্বাস করতে দেখেছ?
-তোমাকে কখনও অন্য কারো সাথে বসে কখনও মগ্ন হয়ে কথা বলতে তো দেখিনি!
-মগ্নতার সাথে তোমার পরিচয় নেই জুহি।
-বেশ। মেনে নিলাম।
-এখন তোমাকে জিজ্ঞেস করি – তুমি এতক্ষণ অকারণ আমার সাথে বসে আছ কেন?
-আজ আমার সময় কাটছে না তাই।
-সময় কাটছে না কেন?
-ফিজিক্স প্র্যাকটিকেল ক্লাস করতে গিয়ে দেখি নীলাভ আসে নি।
-নীলাভ তোমার প্রেমিক? স্যরি, বয়ফ্রেন্ড?
-তা বলতে পারো।
-ও তাহলে আমি কি নীলাভর প্রক্সি দিচ্ছি?
-হতে পারে।
পারিজাত উঠে দাঁড়ায়। লম্বা লম্বা পায়ে পার্ক ছেড়ে চলে যায়। ফিরেও তাকায় না। জুহিও পেছন থেকে আর ডাকে না। চারপাশে শূন্যতার আবহ বড় হচ্ছে। ভালো লাগছে না, কোনও সম্পর্ক ধরে রাখতে ইচ্ছে হচ্ছে না। অদ্ভুত এক গাঢ় ঘূর্ণাবর্তে আটকে যাচ্ছে সে, এমনি অনুভব হচ্ছে আজকাল।
**************************************’***
বাড়িতে আজ সকালে দুটো বুলবুলি এসে কাঁধ ঝাঁকিয়ে পারিজাতকে দেখল। পাখিরা মানুষকে বড্ড ভয় পায়। পাখির মাংস খেতে কিংবা খাঁচায় পুরতে মানুষের জুড়ি নেই। পাখি এসব বোঝে। এই তো সামনের পথ দিয়ে যেতে যেতে খাঁচাবন্দি ছোট ছোট পাখিগুলো কিচমিচ করে। নিজের ভালোলাগার ও ব্যবসা বুদ্ধির জন্যে এদের খোলা আকাশের স্বাধীনতা হরণ করে নেয় মানুষ। নিজেদের ভাষা শিখিয়ে তোতার বুলিতে অভ্যস্ত করতে চায়। এসব ভেবেও বুলবুলি দুটির দিকে এগিয়ে গেল পারিজাত। মুখে বলল – ভয় পাস না। তোদের ধরব না, শুধু একটু কথা বলব, শুনবি? আচ্ছা, তোরা শূন্য কেটে কেটে কতদূর এগোতে পারিস একটু বলবি? আশ্চর্য! পাখি কী মানুষের ভাষা বোঝে? তারা উড়ে গেল না। পারিজাতকে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। কিন্তু এসময়েই পারিজাতের পকেটে ফোনটা বেজে উঠতেই পাখিদুটো ত্রস্ত ডানায় উড়ে গেল।
ফোনে আসলে অ্যালার্ম বাজছে। ওটাকে বন্ধ করতে রোজ ভুলে যায় সে। কবে একদিন কী একটা কারণে অ্যালার্ম দিয়েছিল মনে পড়ে না। ঐ ভুলের জন্যে বুলবুলি দুটো উড়ে গেল বলে নিজের উপরেই রাগ হল তার। কিন্তু কী কথা বলত সে? বলত শূন্যতা নিয়েই। স্পেস… যে শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে ফুরিয়ে যাচ্ছে যাবতীয় তরঙ্গ। যে শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে প্রেম বিশ্বাস স্বপ্ন….
*************’********************’*******
জুহি হাঁটছে। আজ আর তাড়া নেই যেন কোথাও। তাকাতে তাকাতে যাচ্ছে। একটা বাড়িতে নারকেল গাছ সাফাই হচ্ছে। গাছের গায়ে লেগে থাকা শুকনো পাতা ছাল শুকনো গুল্ম রাস্তার ওপরেই ফেলছে লোকটা। কালো কুচকুচে সিড়িঙে কেঠো দেহ…সঞ্চরমান হাতে কাটারি…
– “জুহি?”, কী রে? কোথায় যাচ্ছিস?
রায়া। স্কুটি চালিয়ে যাচ্ছিল।  উল্টোপথে স্কুটি থামিয়ে একপাশে পা ঠেকিয়ে রেখেছে। জুহির বন্ধু। একসাথে ইস্কুলে পড়েছে। এখন সে ভিন্ন কলেজে, কমার্স নিয়ে পড়ছে।
এদিক ওদিক তাকিয়ে রাস্তা পেরিয়ে এল জুহি।
-বেশ হেলেদুলে চলেছিস, কোথায়?
-বাড়ি।
-সেকি রে! এত দেরি?
-প্রাকটিক্যাল ক্লাস ছিল।
অর্ধসত্য বলে জুহি। ক্লাশ ছিল ঠিক কিন্তু করেনি। নীলাভ আসেনি দেখে বেরিয়ে পড়েছে। তারপর নেতাজী পার্ক, ওখানে পুরনো প্রেমিক পারিজাত আর পারিজাতের ছড়িয়ে যাওয়া শূন্যতা। রায়া বলে – এত দেরি করে ফিরছিস। বাড়িতে কেউ কিছু বলবে না?
-নাহ্!
রায়া মুচকি হেসে বলে – মা তো সারাদিন ফোন করেই যাচ্ছে – কোথায় আছিস? কখন আসবি? বিরক্ত লাগে জানিস।
জুহির মুখের আলো নিভে গেল যেন কথাটা শুনে, মনে হল রায়ার। জুহির মা খুব ব্যস্ত সবসময়। পরোপকার করে বেড়ায়। কীসব সংগঠন আছে। জুহি ওসব খবর রাখে না। খবর রাখতে চায় বাবার, যে অনেক আগে তাদের ছেড়ে চলে গেছে। নাহ্ চলে গেছে মানে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া নয়, পৃথিবীতে আছে আর বহাল তবিয়তে আছে। জুহির খুব কৌতূহল প্রায় অচেনা বাবাকে নিয়ে।
রায়া বলে – পেছনে বসবি? তোর বাড়ির কাছে নামিয়ে দেব।
স্কুটি চলছে। রাস্তার পাশে পলিথিনের শিটের ঠেকনো দেওয়া ঝোপড়ির ভেতর এক মহিলা উনুনে রান্না করছে… দুটি মেয়ে লালপাড় শাড়ি পায়ে আলতা… ছবিগুলো সরে সরে যাচ্ছে। একের পর এক দৃশ্যের জন্ম হচ্ছে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে।
বাবা এখন ঝাড়খণ্ডের দুমকায় থাকে। বিয়ে করেছে। বাবার দুটো ছেলে আছে। বাবা যখন মা – কে ছেড়ে যায় তখন জুহির বয়েস আট। বাবা ও মা দুজনেই খুব আত্মসচেতন ব্যক্তি। খুব কথা কাটাকাটি হত দুজনে। কী নিয়ে হত জানে না জুহি। সে ছোট ছিল আর বাবা মা দুজনেই তার সাথে দূরত্ব বজায় রাখত এই ব্যাপারে। মা – কে জিজ্ঞেস করে কোন লাভ হয়নি। উপরন্তু প্রচুর বকুনি জোটে কপালে। বাবা নাকি দেখতে একদম ভালো নয় বিহারের এক মহিলাকে বিয়ে করেছে। বাবা কি খুব সুখে আছে? সুখ মানে কি? অনেকে সুখকে বলে সুখপাখি। সুখকে পাখি বলার কারণ হয়তো সে থেকে থেকে উড়ে যায়। হ্যাঁ, তুলনাটা খুব  লাগসই।আচ্ছা, কে বেশি ভালো তার জন্যে? নীলাভ না কি পারিজাত? নীলাভ বলেছিল আজ – তোর সঙ্গে কথা আছে। পার্কে যাব। আসেনি নীলাভ। কেন আসেনি? এমন মাঝে মাঝে করে নীলাভ। আরও দু’বার করেছে। আগে সে ফোন করে জানতে চাইত কারণ। নিজের কষ্টের কথা বলত। আজকাল আর সে ফোন করে না। মানে আজ করেনি। ভবিষ্যতেও করবে না। পার্কে এসে দেখে পারিজাত বসে আছে একা একা। গাছপালা দেখছে। পারিজাতকে দেখে খুশি হয়েছিল জুহি। কিন্তু একটু পরেই সেই নিরালম্ব অবস্থানে ঝুলতে থাকা পারিজাতকে অসহ মনে হচ্ছিল। জুহি লগ্ন হতে চায়। কোথাও খুব নিজের মত করে জড়িয়ে যাওয়া, সে হতে পারে মেয়েবন্ধু, পুরুষবন্ধু, আত্মীয় স্বজন, বৃদ্ধ বৃদ্ধা তাকে ফেলে যাওয়া বাবা, সেই বিহারের মা, সৎ ভাইরা এটাই আপাতত তার কাছে খুব দরকারি। নিজের মা ও তার মাঝখানে এক অদ্ভুত দেয়াল আছে। সেটি অতিক্রম করাটা খুব সহজ নয়। আর সে সেটা চায়ও না। পারিজাত ও তার যাপনচিত্র মোটামুটি একই রকম। পারিজাতের বাবা মা একসাথে থাকে না। কী হয়েছিল দুজনের মধ্যে পারিজাতও জানে না। পারিজাত লগ্ন হতে জানে না। অবিমিশ্র শূন্যতার নীল জগতে তার বিচরণ। ধীরে ধীরে জুহি ঐ সম্পর্কে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু নীলাভ আজও কথা দিয়ে এলো না। বাড়ির সামনে এসে রায়া তাকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। জুহি দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির কাছে। সদর গেটটার কাছে। বাড়ি আলোকিত। রায়কাকা আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে সারাবাড়ির। জুহি ঢোকার পর খুব যত্ন করে খাবার এনে দেবে। সারাদিন তার কীভাবে কাটল তার ফিরিস্তি নেবে জুহি আর লিখবে রায়কাকার জীবন গাথা তার খাতায়।
(ক্রমশ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *