ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে (অষ্টম পর্ব) ✒️✒️ সায়ন্তন ধর

ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে (অষ্টম পর্ব)

সায়ন্তন ধর

বৃষ্টির দৌরাত্ম্যে যখন বাইরে বেরোনোই বিলাসিতা, ঠিক তখনই আস্তে আস্তে বৃষ্টি কমল। খুব দ্রুততার সঙ্গে ঠিক করা হল সিনেমা দেখতে যাওয়া হবে। সিনেমা ব্যাপারটা আমি ঘরে শুয়ে বসে টিভি বা ল্যাপটপ, হালে মোবাইলেই দেখতে ভালোবাসি। হাতে গুনে কয়েকবার মাত্র সিনেমা হলে গিয়েছি আমি। উচ্চমাধ্যমিক দেওয়ার পর প্রথমবার সিনেমাহল দেখা, তাও আবার থ্রিডিতে দি অ্যাভেঞ্জার্স। আর এবারও সেই থ্রিডিতে স্পাইডারম্যান হোমকামিং দেখতে যাওয়া। আমার প্রথম ও শেষ সিনেমাহলে বসে দেখা সিনেমা দুটিই হলিউড থ্রিডি সাইফাই। শেষ বললাম এই কারনে যে নতুন বিশ্বে আর সিনেমা হলে যাওয়ার প্রয়োজন আমি অনুভব করিনা। যাই হোক, ভ্রমণ কাহিনীতে সিনেমা দেখতে যাওয়ার কথায় অদ্ভুত লাগতে পারে। তাই বলছি, সিনেমা দেখার আগেই আমাদের জীবনেও এক সিনেমার মত ঘটনা ঘটতে শুরু হয়েছিল। আসি সে কথায়। আমরা মোট এগারোজন কলিগ সিনেমা দেখায় রাজি হয়েছি। বাকিরা কেউ আলস্যের কারণে আবার কেউ স্থানীয় হওয়ায় সিনেমা দেখতে যাবে না। আমরা যেখানে ছিলাম সেখান থেকে মাল্টিপ্লেক্সের দূরত্ব প্রায় আট কিলোমিটার। দুটো ওলা ক্যাব বুক করা হল অনেক কষ্ট করে। নেটওয়ার্ক প্রধান সমস্যা। ন’জন কলিগ দুটি ক্যাবে করে রওনা দিয়ে দিল। আমি আর কলিগদাদা তখনও কিছু বুক করতে পারিনি। দাদা বলল যে দুটো ওলা বাইক বুক করলে কমে হয়ে যাবে। আমরা দুজনেই সেভাবে বুক করলাম। একটা বাইক এসে পৌঁছালো। দাদার মোবাইল থেকে বুক করা বাইকটা এসেছে। এদিকে ওই রাতে নতুন শহরে আমার ভয় লাগছে বেশ। মনের কথা বুঝতে পেরে দাদা বলল যে পড়ার সূত্রে গুয়াহাটি তার চেনা, তাই সে পরে আসবে। আমি তখন আমার বুক করা ওলা বাইকের ফোন নম্বরটা আর ওটিপি দাদাকে দিয়ে রওনা দিলাম। প্রথমে তো বাইকের পিছনে বসে আমি চোখ রেখেছি গুগল ম্যাপে। এদিকে বাইক কিন্তু নির্দিষ্ট পথে চলছে না। আমি একবার বললামও সে কথা। ততক্ষণে বাইক বেশ গর্জন করতে করতে উঁচু একটা টিলায় উঠছে। পাকা রাস্তা হঠাৎই লাল ইঁটের রঙ ধারণ করেছে। ড্রাইভার বললেন উনি চেনেন রাস্তা। কিন্তু সে রাস্তা হঠাৎই বন্ধ। রাস্তা চেনা সত্ত্বেও প্রবল অন্ধকারে রাস্তা ভুল করেছেন তিনিও। ইউটার্ন নিয়ে আবার গন্তব্যে যাচ্ছি, এমন সময় দাদার ফোন। তখনও নাকি ওই বাইক আসে নি। এমনকি ওই রাইড ক্যান্সেলও করে দিয়েছে। এদিকে আমার রাইড শেষ না হওয়া পর্যন্ত তো নতুন বাইক বুক করতে পারছে না দাদা। আমিও চলন্ত বাইকে বসেই চেষ্টা করেও পারলাম না। অগত্যা আমি যখন প্রায় পিভিআর সিনেমা সিটি সেন্টারের সামনে তখন দাদা আবার ফোন করে জানালো যে অন্য একজনের মাধ্যমে একটা ওলা বাইক বুক হয়েছে। দাদাও রওনা দিয়েছে। এদিকে আমার ড্রাইভার বলছে পিভিআর সিনেমা কিন্তু দুটো আছে, অল্প দূরত্বেই। আমি পড়লাম সমস্যায়। তাও অনুমানে ভর করে একটাকে বেছে নিলাম। যারা অলরেডি সিনেমা হলে পৌঁছে গেছে, তাদের ফোন করলাম। আয়ত্ত করা হিন্দি ইংলিশ নার্ভাসনেসের সময় বোঝা দুষ্কর হয়ে যায়। অগত্যা হোয়াটসঅ্যাপ এ ছবি তুলে পাঠানোয় তারা বলল যে আমি ঠিক জায়গাতেই এসেছি। সিনেমা শুরু হয়ে গেছে, আমি যেন তাড়াতাড়ি টিকিট কেটে চলে আসি। কাউন্টারে একজনের পরেই ছিলাম। সে সময়টায় আমার সঠিক ঠিকানায় আসার খবর আর দাদার জন্য টিকিট কাটবো কিনা জিজ্ঞেস করলাম। দাদা বলল যে এখনো অনেকটা পথ বাকি, সেই কেটে নেবে টিকিট। এরপর টিকিট কেটে আর এক ঝামেলা, মাল্টিপ্লেক্স তো ভুলভুলাইয়া আমার কাছে। একে তো সিনেমা হলের অভিজ্ঞতা কম। তার ওপরে ভাষা প্রবলেম। যাই হোক সঠিক ঘরে তো প্রবেশ করলাম, কিন্তু ভিতরে কোন গেটম্যান পেলাম না। এদিকে থ্রিডি পিকচার থ্রিডি চশমা ছাড়া দেখাও যায় না। আমার একমাত্র অভিজ্ঞতা বলে হলে ঢোকার মুহূর্তেই গেটম্যান চশমা ধরিয়ে দেয় হাতে। তাই আবার বেরিয়ে এসে বাইরে একজনকে বললাম সে কথা। তিনি বললেন একদম সামনে একটা টেবিলে চশমা রাখা থাকে। চশমা নিয়ে আন্দাজে একটা সিটে বসে দেখলাম ফার্স্ট হাফ। ইন্টারভ্যালে লাইট জ্বলে উঠলো। কলিগবন্ধুদের খুঁজে পেয়ে শান্তি এলো। এদিকে তখনও দাদার দেখা নেই। ফোন করলাম। ধরলো না, মেসেজ ঢুকলো হোয়াটসঅ্যাপে। দাদা বলল সেও পিভিআর সিনেমাতে গিয়েছিল কিন্তু সেখানে তো এই সিনেমা চলছে না। আমি বুঝলাম দাদা অন্যটায় গিয়েছে। দাদাকে বললাম সে কথা। দাদা বলল যে যেই সিনেমা দেখতে এসেছে সেই সিনেমা না দেখে কি ফেরা যায়? তাই অন্য কোন হলে দেখানো হচ্ছে জেনে সেখানে চলে গেছে। শো টাইম একটু পরে হওয়ায় ফিরতে দেরী হবে। ইন্টারভ্যালের পরের অংশটা ভালো মত দেখলাম। সিনেমার হিরোইন একদম আমাদের এক মেঘালয় নিবাসী কলিগের মত দেখতে। সেই নিয়ে মজা করতে করতে দাড়িয়ে আছি। দুটো ওলা ক্যাব বুক করা হয়েছে। এবারে আমিও ওদের সাথেই যাব, কারণ অত রাতে অতিরিক্ত প্যাসেঞ্জার তুলতে ক্যাবের ড্রাইভারদের কোন আপত্তি নেই। অবশেষে ফিরে এলাম আমাদের অস্থায়ী ঠিকানায়। তবে গল্পের শেষ এখনই নয়, গল্প যে সবে মধ্য গগনে। দুই সিনেমা হলের শো টাইমে আধ ঘন্টার মত তফাৎ। দাদা ফোন করলো। ডিনার সারতে সারতেই ফোন ধরলাম। দাদা বলল যে তার ফোন বন্ধ হয়ে যাবে চার্জ শেষ। পকেটে টাকাও নেই। এটিএম নিতে ভুলে গেছে। একটা ক্যাব যেন বুক করে দিই আমি। চেষ্টা করছি। রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে। একটা ক্যাবও পাওয়া যাচ্ছে না। বেশ কয়েক মিনিট পেরিয়ে গেলো। এদিকে ডিবিআইএম একটা ইন্স্টিটিউট, নির্দিষ্ট সময়ে গেট বন্ধ হয়। একদল গেল গেটম্যানকে ম্যানেজ করতে। মিনিট পাঁচেক পরেই আবার দাদা ফোন করল, আমি বললাম বুক করা যাচ্ছে না। তুমি কিছু একটা ধরে চলে আসো। আমরা গেটেই অপেক্ষা করবো। তার তখন নার্ভাস অবস্থা। এমন সময়েই ফোন কেটে গেল। তারপর যতবারই ফোন করি সুইচ অফ। এদিকে আর এক কাণ্ড হয়েছে। আমাদের থাকার ঘর গুলোতে ল্যাচকি গুলো ওয়ান ওয়ে। অর্থাৎ আগেকার টিপতালার মত। চাবি ছাড়া লক হবে কিন্তু খুলতে গেলে চাবি দরকার। টেনশনের মধ্যে দুজন কলিগ চাবি ঘরে রেখে দরজা লক করে দিয়েছে বাইরে থেকে। ভাগ্য ভালো রুম গুলোয় বিশাল বড় ফ্যানলাইট ছিল। অনেক কষ্টে সেখান দিয়ে ঢুকে তারপর দরজা খোলা হলো। ভাগ্য ভালো কেউ দেখেনি। এই করতে ঘন্টাখানেক কেটে গেলো। এদিকে তখনও দাদার আসার নাম নেই। একটা আননোন নম্বর থেকে ফোন এলো, ধরতে ধরতেই কেটে গেলো। সে নম্বরেও কলব্যাক করলাম, সুইচ অফ। এমন সময় একটা বাইক এসে দাঁড়ালো। দাদা নামলো সেখান থেকে। আমরা তো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। পরে দাদা বলল তার অভিজ্ঞতা। আমাদের সাথে কথা বলতে বলতেই ফোন ডেড হয়ে যায়। তাই ওলা বুক করা আর হয়ে ওঠে না। তাই দাদা একটু অপেক্ষা করে হাঁটবে ঠিক করে। এমন সময় ওই বাইকটা এসে দাঁড়ায়। অপেক্ষমান যাত্রী দেখে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে নেয়। ওটিপি চায় না। এদিকে দাদাকে ডিরেকশন জিজ্ঞেস করতে থাকে। দাদা বলে জিপিএস দেখে চালাতে। তখন সে বলে তার মোবাইলের চার্জ শেষ। তারপর দাদা নিয়ে আসে ডিরেকশন বলে। এদিকে দাদা ভেবেছিল আমরা কেউ বুক করেছি। কিন্তু আমরা তো আর বুক করতে পারিনি, সে কথা জানাতে ড্রাইভার বলল তাহলে আমার হয়তো অন্য যাত্রীকে আনার কথা ছিল। চার্জ শেষ হওয়াতে এই বিপত্তি। আমরা বললাম এক বিপত্তি তে যে অন্য বিপত্তি থেকে উদ্ধার করলে এটাই তো দৈবযোগ। পরে ওলার লামসাম হিসেব করে ন্যায্য ভাড়া নিয়ে সেই ড্রাইভার চলে যায়। পরদিন আবারো মিটিং ছিল, সেই রাতেই কাঞ্চনজঙ্ঘায় ফেরার টিকিট। সন্ধ্যা থেকেই আবার বৃষ্টি। সারা রাত বৃষ্টি হলো। ভোর সাড়ে ছটায় তিস্তাব্রীজ ক্রস করছি। আমাকে নামতে হবে, স্টেশন চলে এসেছে। দাদা এনজেপিতে নামবে, তাই বিদায় জানিয়ে এলাম দরজার কাছে। তিস্তা থেকে জলপাইগুড়ি রোড স্টেশন সংলগ্ন পুরো এলাকাটাই জল থৈ থৈ। তখনো বৃষ্টি হচ্ছে। পরের কদিনের টানা বৃষ্টিতে অসমে বন্যা হলো। কাজিরাঙার প্রাণীরা বিপর্যয়ের শিকার হলো। হয়তো সেদিন অত ঘটনা ঘটানোর জন্যই বৃষ্টিতে সাময়িক বিরতি ছিল।

(ক্রমশঃ)

1 thought on “ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে (অষ্টম পর্ব) ✒️✒️ সায়ন্তন ধর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *