‘আমার শারদোৎসব ✒️✒️ মধুপর্ণা বসু

Maa Durga Is A goddess of indian Religion.

‘আমার শারদোৎসব

মধুপর্ণা বসু

‘বাজলো তোমার আলোর বেনু’ এই সুরের সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের বাঙালী জীবনের নিবিড় অনুভব। পরতে পরতে সুন্দর শরতের নীলাভ অভিমান। কিছু খবর সব সঙ্কটকে মুহুর্তের জন্য ভুলিয়ে দিয়ে যায়, ভিজে ঘাসে, মুক্তো ঝরানো শিশির, ভোরের গন্ধে শিউলির সফেদ গেরুয়া, তুলো মেঘে বৃষ্টি ফোঁটার শেষ কিছু কথায়।এই আলোর বেণু আমাদের জানিয়ে দেয় মা আসছেন।শরতের এই ডাক আমাদের নিয়ে যায় ছোটবেলার কত সুখের স্মৃতিতে।ভোরের আগেও ছিল আর এক নৈসর্গিক ভোর,শিউলিতে ভরে থাকতো আমাদের সাবেক দুমহলা বাড়ির পেছনের বাগান।শিশিরের হীরের দ্যুতি ছুঁয়ে কুড়িয়ে নিতাম সেসব মণিমুক্তা।আমাদের কোন ভাই ছিলনা,ছোট হয়েছে অনেক পড়ে।তাই চার তুতোবোনে শিশির ঝরা ঘাসের গন্ধে ভরে নিতাম বুক,দুর্গাপূজার গন্ধ পেতাম সেই শিউলি তুলে।কতবার হয়েছে এই শিউলী ফুল আর ঢেঁড়স রঙে ছাপিয়ে তুলেছি সাদা রুমাল।জানিনা সেদিন কি ছিল এমনই? নিশ্চয় নয়,এতো আড়ম্বর ছিলনা,আয়োজন ছিলনা,প্রাচুর্য ছাড়াও ছিল মনের আনন্দে ভরপুর। আকাশে নীল দিগন্তের সীমা ছাড়িয়ে চোখ যতদূর যায়, সাদা মেঘের পানসি, ট্রেনের গতির সাথে মাঠে মাঠে ফুটে থাকা কাশফুলের দুলুনি, পুকুরে মাঝে নানা রঙের পদ্ম শালুকের বাহার বলতে অপেক্ষা রাখেনি তিনি আসছেন। গ্রামের পথে বাউল বোষটমের গলায় রামপ্রসাদি সুরে উমা মায়ের আগমনী, জীবন ছিল যেমন সহজ সরল অথচ আনন্দ আর শান্তিতে উদার আকাশের বিস্তার।
দুর্গাপুজোর শুরুও হয়েছিল সেই কোন এক আদিকালে, ইংরেজ আমলে ক্লাইভের বিজয় উৎসব হিসেবে,তারপর এই পুজো কলকাতায় শুরু হয়েছিল জমিদার সাবর্ণ রায়চৌধুরী এবং শোভা বাজারের জমিদারদের উৎসাহে।তারপর আমাদের বাঙালী জীবনের নিবিড় অঙ্গ হয়ে উঠল এই উমামায়ের আগমনের উৎসব।আপামর বাঙালী জাতি আর আজকের একবিংশ শতকে তা হয়ে উঠেছে এক আন্তর্জাতিক উৎসব।ছোট বেলার দুর্গাপুজো ছিল এক অলৌকিক আনন্দের শারদ উৎসব।পাড়ায় পুজো প্যাণ্ডেলের বাঁশ পড়ত যখন বুকের মধ্যে আনন্দের দুরুদুরু ঢাক বাজতে শুরু করে।তারপর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা মহামায়ার মঙ্গল ধ্বনি বেজে ওঠার,মহালয়ার ভোর সেই “জাগো দুর্গা, জাগো দশপ্রহরণ ধারিনী” তিনি আলোর বেণু বাজিয়ে আসছেন, মনে পড়ে যায় আমার ছোট মা, ভোর সাড়ে চারটেয় আমাদের তুলে জল ঢালতেন সদর দ্বারে।বাড়ির সব ঘরের দরজায় সিঁদুর দিয়ে স্বস্তিক চিহ্ন আঁকতেন।ঘুম চোখে শুরু হত মহালয়ার অনুষ্ঠান শোনা দাদুর আমলের রেডিওতে। আর ভাবলে ভীষণ বুক মুচড়ে ওঠে যখন দেখি আমাদের ছেলেমেয়েরা অনেকেই জানেওনা মহালতার মহিষাসুর মর্দিনী অনুষ্ঠানের বিষয়ে।কী ভীষণ আনন্দ আর উত্তেজনা ছিল দর্জিকে দিয়ে নতুন জামা তৈরির,বাটার নতুন জুতো কেনার উদ্দীপনা।আর পুজো প্যান্ডেলে ঠাকুর আসার সেই মহার্ঘ্য মুহূর্ত।ভোরবেলা আসতো কুমারটুলি থেকে রমেশ পালের, সনাতন পালের প্রতিমা। লড়ির চাকায় আনন্দের ঢাক বেজে উঠতো আর এক বছরের অপেক্ষা শেষে সেই ঢাকের কাঠি পড়তো আমাদের মনে প্রাণে।পাঁচ দিনের এই শারদোৎসব ছিল সারাবছরের অধীর অপেক্ষার সোনার ফসল।শুধু নতুন জামা জুতোর আনন্দে বিভোর নয় আকাশে ছিল সাদা পেঁজা তুলোর মতো মেঘের মিনার, চারিদিকে কেমন দুগগা ঠাকুরের সাজসাজ গন্ধ। ডাকের সাজে, প্যান্ডেলের কাপড়ে, চন্দনগরের টুনি আলোর রকমারি ছবি জ্বলে উঠত আসমানী নীলের সীমানা ছাড়িয়ে।কী এক অধীর আগ্রহে আমাদের নাগালের মধ্যে আসতো পুজোর কটা মিলনের দিন।প্রবাসী কাকা, জেঠাদের দেশে ফেরা,হোস্টেল থেকে পড়ুয়াদের হইচই করে মায়ের কোলে ফেরার সে এক মহামিলনের দিন।বড় অল্পে আনন্দে মাতোয়ারা হবার বার্ষিক উৎসব এই শারদোৎসব।
সবই আছে, দিনের সাথে যুগের চলাচলে আমরা আরও আধুনিক বিশ্বের সাথে নিজেদের যুক্তি প্রযুক্তিতে এগিয়ে চলেছি।একচালার প্রতিমার পরে এসেছে অনেক বড় আর পৃথকভাবে ঠাকুর গড়ার চল আর তারপর আমাদের সময়ের দুর্গা পুজোর সাবেকি ঘরানার সাথে যুগের চিন্তায় জনপ্রিয় হয়ে উঠল থিম পুজো। পৃথিবীর নানা প্রান্তে ঘটে যাওয়া ঘটনা,বিখ্যাত বস্তু প্রাসাদ সৌধের নকল করে মণ্ডপ তৈরী,দেশের মধ্যে সাড়া জাগানো নানা সংবাদের অনুকরণ,আলোকসজ্জায় পড়লো অতি আধুনিকতার ছাপ।দেবী মূর্তির নির্মানেও এসে পড়ল অনেক আশ্চর্যজনক উদ্ভাবনী শক্তির নিত্যনতুন ভাবনার প্রতিফলন। সেই মা চিন্ময়ী নানা রূপে নানা ভাবে নতুন মূর্তিতে ধরা দিলেন গ্রাম ও শহরের শিল্পীদের হাতের পটুত্বে।উপচে পড়ছে মানুষের ঢল, উড়ছে কোটি কোটি টাকা, এই উৎসবে ভেতরে প্রাণের টান যেন হারিয়ে গেছে।মনের ভক্তির নিবিড় অনুভব যেন জাঁকজমক, সাজসজ্জায় প্রাচুর্যে সারা বিশ্বব্যাপী এক হিন্দু মহা উৎসবের আকার নিয়েছে আজ।শুধু আর বাংলার নিজস্ব উৎসব নয়, আন্তর্জাতিক ফেস্টিভ্যাল তকমা পড়ে সমস্ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ল আমাদের দুর্গোৎসব। এটা হয়েতো নিঃসন্দেহে গর্বের এবং গৌরবের যে আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড এর ঘোষণা অনুযায়ী বাংলার দুর্গা পুজা এখন পৃথিবীর অন্যতম সেরা উৎসব হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে তবে আজ মনের মধ্যে একটা সংশয়ও দানা বেঁধে উঠছে, আমাদের প্রাণের শারদোৎসব যেন তার কৌলিন্য কিছুটা হলেও হারিয়েছে।দূর্গা দুর্গতিনাশিনী উমার সাবেক সিংহবাহিনী দশভুজা রূপটি আজও আমাদের চোখের সামনে বর্ণময় উজ্জ্বল। পুজোর সময়ে কিশোর,আশা,লতা,মান্না দের আধুনিক গানগুলো আজও মনে গুনগুন… মাইকে যখন বেজে ওঠে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের মহিষাসুর মর্দিনী, আজও চোখে জল বাঁধ মানেনা।ফিরে যাই ফেলে আসা সুখের স্মৃতিতে। একশো আটটি পদ্ম ফুটিয়ে, একশো আটটি প্রদীপ জ্বালিয়ে রাতভর জেগে সন্ধি পুজোর আরতি।অপটু হাতে শাড়ি সামলানো কিশোরীর প্রথম মহাঅষ্টমীর অঞ্জলি।পাড়ার লাজুক ছেলেটির দুরুদুরু বুকে এগিয়ে দেওয়া কুচো ফুলের নিঃশব্দ বার্তা,হালকা হাসিতে ফাঁসিয়া যাওয়া কতশত তরুণের কম্পিত হৃদয়।প্রসাদ বিতরণের ফাঁকে চোখে চোখে কত না-বলা কথা।তারপর শুজিয়ে যাওয়া ফুলের মতো ঝরে পড়া বিজয়াদশমী। আজও একই ভাবে আছে সবই, তবে মননে অনুভব এখন অনেক প্রকাশ্য, অনেক সাড়ম্বরে, সেখানে রাখঢাক নেই,অব্যক্ত শিহরণ ধরা দিয়েছে কলকাকলীতে।মুখরিত আজকের দুনিয়ায় আমাদের দুর্গোৎসবও এগিয়েছে একুশের অত্যাধুনিক অঙ্গসজ্জায়।পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে দুর্গাপূজা এখন শুধু সাংস্কৃতিক আর কৃষ্টির প্রকাশ নয়, চূড়ান্ত ব্যবসায়ীক আদানপ্রদানের,বিজ্ঞাপনের অর্থাৎ জগৎ জুড়ে প্রমোশানেরও সুযোগ এই উৎসব। এখন খুঁটিপুজো থেকে বিজয়াদশমীর কার্নিভাল চমকপ্রদ এক প্রদর্শনী। পুজোকে কে কেন্দ্র করে মেলা, প্রদর্শনী, প্রতিযোগিতা আর কয়েক হাজার কোটি টাকার ব্যবসায়িক লেনদেন।
তবুও আমরা আছি আমাদের সুখ স্মৃতি নিয়ে, মনে মনে আজও সুরে বলি ‘ওগো আমার আগমনী আলো ‘ আমাদের সব দুঃখ বেদনা, দ্বেষ, ক্ষোভ অভাব,ভুলিয়ে পৃথিবীর সব মানুষের হিতার্থে সবার জীবনে আশা ভরসার আলো জ্বালাতে তুমি এসো মা! শক্তিরূপিনী
শান্তিদায়িনী,মাতৃরূপী মা অম্বে, তুমি এসো মা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *