যদিও দুপুর তবুও রাত্রি এখন ✒️✒️ ম ধু মি তা বে তা ল
যদিও দুপুর তবুও রাত্রি এখন
ম ধু মি তা বে তা ল
(৪)
“রাজনীতিতে মহিলায়ন”
রাজনীতি একটা বিরাট বিন্যস্ত বিষয়। ভারতের ক্ষেত্রে তা ত্রিস্তর পঞ্চায়েত, মিউনিসিপ্যালিটি, বিধানসভা ও লোকসভায় প্রসারিত। এ প্রসঙ্গে বলা যায় যে মহিলাদের রাজনৈতিক অধিকার বলতে শুধুমাত্র ভোটাধিকারেই নয় বা একজন নারী ভোটদাত্রী বা ভোটপ্রার্থীই শেষ কথা নয়। রাজনীতির সকল পরিসরে তাঁদের ক্ষমতায়ন জরুরি। স্থানীয় জনপ্রশাসন তথা বৃহত্তর সরকার পরিচালনা, পরিকল্পনা ও নীতি নির্ধারণের মতো সবক্ষেত্রেই নারীশক্তির সক্রিয় অংশগ্রহণ এখন আর নতুন নয়। তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও অমূল্য অবদানের বাস্তব রুপায়ন কর্মে, তথ্যে ও তত্ত্বে তুলে ধরতে হবে। উপেক্ষিত অথবা অবমাননার হীনস্থানের বিশৃঙ্খল দুরবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে গেলে নারীশক্তিকে দেশের রাজনীতির সঙ্গে বলিষ্ঠভাবে, সার্বিক আকারে অঙ্গীভূত করে নিতে হবে। এদেশে জাতীয় রাজনীতিতে সর্বপ্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ইন্দিরা গান্ধী এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের সর্বপ্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী পদে নির্বাচিত হয়েছেন ঠিকই, তবুও নারীদের যে বিপুল রাজনৈতিক অংশগ্রহণ তা কিন্তু আজও সুনিশ্চিত ও সুব্যবহৃত হতে পারেনি। তবে একথা অনস্বীকার্য যে নারীদের কর্মক্ষমতা, সততা দেশীয় রাজনৈতিক পরিবেশে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে।
“ছেলেরা বিয়ে করে, মেয়েদের বিয়ে হয়”
ভারতীয় নারীরা সবদিক থেকেই পিছিয়ে। নারীত্বের পূর্নাঙ্গ অধিকার স্বীকার করে নিতে ও ক্ষমতার মূল্যে বলীয়ান করে তুলতে সর্বিক ব্যবস্থা সকল পক্ষ থেকে গ্রহণ করতে হবে। নারীকে আপন ভাগ্য জয় করবার সমস্ত রকম অধিকার দিতে হবে। নারীর অক্লান্ত অবর্ণনীয় গৃহশ্রমের স্বীকৃতি ও মূল্য সমাজ কখনোই দিতে পারবে না বা দেও না। তাই বলবো শুধুমাত্র এই সু-দক্ষ গৃহশ্রমের কারণেও নারীকে এক উৎকৃষ্ট শ্রম-শ্রেণির মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
তাই সমাজে শিক্ষার ক্ষেত্রে ছেলে-মেয়েদের সমান গুরুত্বের সঙ্গে শিক্ষাদান করা হোক। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে ছেলেদের চাকরির বিষয়টা যতটা গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হয়, মেয়েদের বেলায় কর্মক্ষেত্রে সাবলম্বী হওয়ার নিশ্চয়তাকে ততটাই ছোটো করে দেখা হয়। বিবাহের ক্ষেত্রেও ছেলেরা যতটা স্বাধীন মতামতের সুবিধাভোগী, মেয়েরা কিন্তু ততটাই বঞ্চিত। ছেলেরা উপার্জনশীল হলে তবেই বিয়ের কথা ভাবা হয়, কিন্তু মেয়েদের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিপরীত। কোনোরকমে সু-পাত্রস্থ করার বিষয়টাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। মনের বালাই না করেই শারীরিকভাবে বিবাহযোগ্যা হলেই মেয়ে মা-বাবার দুঃশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিবাহের মতো অনেক ক্ষেত্রেই এখনও মেয়েদের স্বাধীন মতামতের কোনো গুরুত্বই দেওয়া হয় না সে যতই উপযুক্ত ও সাবলম্বী হোক না কেন। এক্ষেত্রেও সেই একই বৈষম্য দেখা গেছে যে ছেলেরা বিবাহযোগ্য হওয়ার পরেও বিয়ে না হলে বলা হয় ছেলেটি বিয়ে করছে না বা করলো না। কিন্তু মেয়েটির ক্ষেত্রে বলা হয় বিয়ে হচ্ছে না বা হলো না। এই করা বা হওয়ার মধ্যেই সমাজিক ক্ষমতায়নে নারীরা ঘৃণ্য নেতিবাচক প্রক্রিয়ায় অবমাননার দলে চলে যায়, যা আদৌও কাম্য নয়।
“ওরা কাজ করে…”
পারিবারিক আর্থিক সহায়তার জন্যেই মহিলারা মূলত কর্মক্ষেত্রে আসে। কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের নানান সমস্যা। তারা নাকি এফিসিয়েন্ট নয়। এই অভিযোগ ছিল, আছে, থাকবেও। তবে এটাও ঠিক যে সমপরিমাণ, এমনকি বেশি কাজ করলেও পুরুষের চেয়ে তাদের মাইনে বা মজুরি কম। কিছু কর্মক্ষেত্রে ব্যাপক কায়িক বা মানসিক শ্রম দেওয়ার পরেও মহিলাদের প্রচণ্ডরকম অত্যাচারিত, লাঞ্চিত, নিপিড়িতও হতে দেখা যায়। নারীমুক্তির ক্ষেত্রে এটা একটা বিরাট সমস্যা ও সঙ্কট। কর্মক্ষেত্রে নারীর যৌনহেনস্থা তো সর্বজনবিদিত। ধানক্ষেত, ইটভাটা থেকে শুরু করে একদম মাল্টিন্যাশনাল ডিজিটাল হাউস পর্যন্ত একই দৃশ্য। সরকারি-বেসরকারি প্রায় সব অফিস-কাছারিতেই প্রতিনিয়ত নানা অছিলায়, এমনকি চোখরাঙানিতেও মহিলাকর্মীদের শারীরিকভাবে অপমানিত হতে হয়। কর্মক্ষেত্রে মহিলাকর্মীদের যৌনহেনস্থা রোধে বিভিন্ন শাস্তিমূলক আইন প্রণয়ন করা হলেও, তাদের বুড়ো আঙুল দেখানোর বিষয়টিও জল-ভাত কিন্তু। আর্থিক কারণে চাকরিজীবী মহিলারা সামাজিকভাবে সমাদৃত হলেও, তাদের পিছনে কিন্তু অন্যরকম কথাই চলে। এছাড়াও যেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার আগে ও কর্মক্ষেত্র থেকে ফিরে এসে নারীর গৃহশ্রম কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অটুট থাকে। তাই প্রশ্ন হলো কোন শ্রম আইন মহিলা-শ্রমের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য?
“বাঁধ ভেঙে দাও…”
এত লেখালিখি নিছক পুরুষ বিদ্বেষ থেকে নয়। পুরুষতান্ত্রিক ধর্ম ও শাস্ত্রতান্ত্রিক কাঠামো ও তার উপরিকাঠামো আজ ভেঙে ফেলার সময় এসে গেছে। আন্দোলনে এককাট্টায় সরব হতে হবে উচ্চ, মধ্য ও নিম্ন ভেদাভেদ ভুলে সকল স্তরের নারীকুলকে। অতএব সবার আগে দরকার প্রচলিত চেতনার দাসত্ব থেকে নারীর মুক্তি, সংস্কার প্রসূত নিকৃষ্ট চিন্তন-প্রক্রিয়া থেকে নারীর মুক্তি। এই দৃষ্টিভঙ্গিমা বাস্তবে সুনিশ্চিত করতে হলে নারীর চেতন-জগতে নীরব ও সরব বিপ্লব ঘটানো দরকার। সর্বক্ষেত্রে নারীকেই এগিয়ে এসে সু-যোগ্যতার সঙ্গে তার অধিকার ও জোর স্থাপন করতে হবে। এখানে একটা বিষয় আমি আলোচনার মাধ্যমে সামনে আনতেই পারি, তা হলো প্রতিমা তৈরি থেকে শুরু করে বিসর্জন পর্যন্ত যাবতীয় কাজ যেমন প্রতিমা নির্মাণ, সাজ-সজ্জা, চক্ষুদান, মণ্ডপে পুজোর আয়োজন, চণ্ডিপাট, হোম, আরতি পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ানো ইত্যাদি থেকে কেন আমরা মহিলারা অচ্ছুতের মতো দূরে সরে থাকব? শাস্ত্র নাকি পূজাপাঠে মেয়েদের অনুমতি দেয় না। মাটির দুর্গার অর্চনায় রক্ত-মাংসের দুর্গারাই ব্রাত্য। তাই ঠিক বিসর্জনের পর নিরঞ্জনের আগে মেয়েদের সুযোগ দেওয়া হয় প্রতিমা স্পর্শের, আলতা সিঁদুর পরিয়ে প্রতিমার বিদায় বেলাতে। যদিও এক্ষেত্রে আজকাল অনেক মহিলাই বিপুল বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে সাহসিকতার সঙ্গে এগিয়ে এসে এই পুজো, বিয়ে তথা বিভিন্ন সামাজিক ও মাঙ্গলিক কাজগুলোতে পুরোহিতের ভূমিকা পালন করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু সমাজের কাছে সেরকম স্বতঃস্ফুর্ত সমর্থনসূচক সহযোগিতা তাঁরা পাচ্ছেন না। আমরা জানি মন্দিরের পুরোহিত মানেই হবেন কোনো-না-কোনো পুরুষ ব্রাহ্মণ, মসজিদের ক্ষেত্রেও এই একই নিয়ম প্রযোজ্য। সেখানেও পুরুষ মৌলবীদেরই আধিপত্য। এ ক্ষেত্রে মহিলাদের কখনও যোগ্য প্রতিনিধি বলে ভাবাই হয় না। এই ধর্মতান্ত্রিক, শাস্ত্রতান্ত্রিক, সংস্কারবাদী ধারা বয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। আর এইসব ছুঁৎমার্গকে, যুগান্তকারী কুসংস্কারিক ধারাকে মহিলারা বুঝে বা না-বুঝেই তুমুল গুরুত্ব দিয়ে মান্যতা দিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং ভাবীকালের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আগামী প্রজন্মের সর্বক্ষেত্রের পরিচালনার প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচিত হওয়ার ক্ষমতায় উপযুক্ত হতে হলে সকল নারীকেই সার্বিকভাবে সচেতন, শিক্ষিত ও সাহসী হতে হবে। তাই পূরুষপোষিত ধর্ম, সংস্কার ও প্রথার প্রচলিত জগদ্দল কাঠামোকে ভেঙে ফেলার আন্দোলনে নারীকেই জেগে উঠতে হবে সর্বাগ্রে।
( চলবে )