## গল্পের নাম : দর্পণ কলমে — মালা মুখোপাধ্যায়

## গল্পের নাম : দর্পণ

কলমে — মালা মুখোপাধ্যায়

—মাআআআআ,জলদি ,জলদি,নাআ, নাআ ,অতটা নয়,অল্প, অল্প ,যাস্ট অল্প, উঃ প্রতিদিন বলতে হবে? তোমাদের দিন আর নেই মা, স্লিম হতে হবে।
—বকবক করিস না তো,এর থেকে আর তুললে ,আর না খাওয়া ভালো। এইটুকু ভাত পাখিদেরও পেট ভরবে না।
—খুব হবে, সবগুলো যোগ করো তো। অফিসে গিয়েই কাজ করতে হবে। সৈনিকদের কখনও পেট ভরে খেতে দেওয়া হয় না জানো তো?
–তুই কি সৈনিক?
–অফকোর্স ‌‌। যুদ্ধ কি মাঠেই হয়? অফিসেও হয়,বুদ্ধির যুদ্ধ, কলিগকে টপকানোর যুদ্ধ, ও তুমি বুঝবে না, তুমি কবি মানুষ,নরম সরম স্বভাবের,বাদ দাও, আমি যা বলছি ,তাই শোনো, একটু হাঁটাচলা করো, দিনরাত ফোন নিয়ে বসে থেকো না।
–ও, আমি যদি ফোন নিয়ে বসে থাকি,তাহলে খাবার টেবিলে খাবার গুলো কি আকাশ থেকে আসে ? বুঝবি,যেদিন সংসার করবি,এখন তো গায়ে হাওয়া লাগিয়ে খাবার টেবিলে মাকে ডাকলেই খাবার পাওয়া যাচ্ছে।
—আমি,করবো সংসার? তোমাদের কে দেখবে ?
–বিয়ে করলেও কি দেখা যাবে না?
কি যে বলিস! বল কাউকে দেখে রেখেছিস কিনা,তাহলে যোগাযোগ করবো। একটার পর একটা বিয়ের দিন চলে যাচ্ছে, ভালো লাগছে না আমার, বুকের ভিতরটা কেমন ছটফট করছে রে।
–আমার বিয়ের জন্য তোমার বুকের ভিতর ছটফট করছে কেন?
–তোর বয়সটা কি কম হলো রে? এর বেশি হলে ,লাবন্য বলে কিছু থাকবে? কোনো ছেলে কি আর পছন্দ করবে?
—আলবৎ করবে‌। আমি চাকরি করি মা, তোমাদের যুগের কথা বাদ দাও।
—চাকরি করলেও ,তারা কি টাকাকে বিয়ে করবে? ছেলে হোক ,মেয়ে হোক ,একটু তো ভালোলাগা থাকতে হবে রে?
—টাকা দিয়ে সব ভালো লাগা কেনা যায়,এভিরিথিং, বুঝলে? সব বিক্রি হয়,সবাই বিক্রি হয়।
–ফালতু কথা। বড় বড় মনিষীদের কথা কি ভুলে গেলি?
–মনিষী কয়জন মা? সবাই তো সাধারণ মানুষ।
–বুঝলাম। অত জ্ঞান দিতে হবে না, সামনের মাসে তোর বিয়ে দেবো। একমাত্র মেয়ে, চাকরি করিস, আবার সমস্যা কোথায়?
—বিয়ে বিয়ে করো না তো,আর একটু ভালো চাকরি পাই, তারপর ভাববো।
—আবার ভাববি কিরে?
–ওঃ মা, সেই কবে দার্শনিক জঁ জাক রুসো বলে গেছেন,বিয়ে একটা সামাজিক চুক্তি।
–হ্যাঁ,মানলাম , সামাজিক চুক্তি,তাতে অসুবিধা কিছু আছে ?
—ভালোবাসা না থাকলে ঘর করা যায় কি? এক ছাদের নিচে ভালোবাসাহীন দুটো জীবনের অভ্যাস,এর নাম ভালোবাসা নয়।
–তোর কাছে নতুন করে শিখতে হবে রে? এই যে আমরা এতো বছর ঘর করছি,সেটা আগুন সাক্ষী রেখে বিয়ে, সেটাই তো ভালোবাসা।
—আলছালের সাক্ষী, এবার বলো, শাঁখা দিও না ভেঙে, সিঁদুর দিও না মুছে , যাত্রাপালা ,হা হা হা হা ,চিৎপুরের বিখ্যাত দল আসছে,দলে দলে যোগদান করুন।
–ভীষণ টকেটিভ তুই। মায়ের সঙ্গে ঐ ভাবে কথা বলতে হয় না। আমাদের কাছে শাঁখা সিঁদুরের দাম আছে। বিয়ের আগে বাবা মা আপন থাকে, বিয়ের পর স্বামী, মেয়েদের স্বামী ছাড়া আর কেউ আপন নয়।
—সেই তো ,স্বার্থের কথা চলে আসছে,আর তোমাকে তোমার মা বাবা পৃথিবীতে এনেছে,তা তারা দেখবে না তো কে দেখবে? আর বিয়ের পর বাবার দায়িত্বে এসেছো,এটা এমন কিছু বেশি নয়,অত্যন্ত সহজ সরল স্বাভাবিক ব্যাপার।
–এই সহজের মধ্যেই তো মানুষ বেঁচে থাকে রে, একা একা বাঁচা যায় না । দেখে আয় তো, সংসার বল,আর সঙ সার বল,আর নাট্যমঞ্চ বল , আর স্বার্থ বল, তুই যাই বল না কেন,এর মধ্যেই মানুষ বেঁচে থাকে, পাগল হয় না, একাকীত্ব রোগে ভোগে না।
–আমার তো ঘোড়া রোগ নেই মা। আমি চাকরি করি, বাবা সামান্য ব্যবসা করে,বাড়ির ছাদ নেই,টালির ঘর , ঠিকানা আমার ৫৪ নং হরিয়ালী বস্তি। এই ঘরে কোনো ভালো ছেলে মানে, তোমরা যে ভাবে ভাবো সেই অর্থে কোনো ছেলে আমাকে বিয়ে করবে না, আমার গায়ে বস্তির গন্ধ লেগে আছে মা।
—আমরা তো ওপার বাংলায় বস্তিতে ছিলাম না,ভালো বাড়ি ছিল।
—সে কথা শুনলে সবাই হাসবে,সবাই বলে,সবাই নাকি জমিদার ছিল ওপারে।
–হাসলেও তো সত্যিই।
–তবুও মা, আমি তোমাকে একটা সুন্দর ফ্লাট দেবো, বাবার নামে অনেক টাকা রাখবো।
–নারে মা,নাআআআ, আমাদের কিছু দরকার নেই মা, তুই সুখে থাকবি এটাই কাম্য।
—কবি মানুষ তুমি,সব ভুলে যাও, কলম যখন হাতে ধরেছো, সেটাকে তরোবারি বানাও। তোমার এই রুগ্ন শিরা ওঠা হাত আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
–এতো বেশি জীবনকে সিরিয়াস ভাবে নিস না,বেশ তো মাইনে পাস, ওতেই চলে যাবে।
–আমার চলবে না মা। রুগ্ন মা ,আর টাকা হীন বাবা, রুগ্ন বৌ, টাকা হীন বর বাজারে অচল। বাঁচতে গেলে বাঁচার মতো বাঁচো, ঐ সব কি লেখো ? ফুল,বেল পাতার কবিতা, “এই ষাড় সরে যা ফুল ছুঁড়ে মারবো ” বললে হবে না মা, পাথর ছুঁড়ে মারো, প্রতিবাদ আছে তোমাদের?
–কত প্রতিবাদ হয়,দেখতে পাস না, দিনরাত কম্পিউটারে থাকলে বুঝবি কি করে ? কি করে বুঝবি মা কি লেখে?
–জানি তো, তুমি ভালো লেখো, কিন্তু হচ্ছে না ঠিক,গর্জে ওঠো, কোথায় ভয় তোমার? আমাকে নিয়ে?
—তোর চাকরির ক্ষতি হতে পারে,অত কি বলা যায় দেশ নিয়ে?
—দেখলে তো, তুমিও আমার চাকরির নিরাপত্তার কাছে নিজেকে বিক্রি করে দিয়েছো, তাহলে তোমার লিখতে আসা কেন?
–মা হলে বুঝবি।
–ওসব সেন্টু মেরো না, তুমি পারবে না,ক্লীবলিঙ্গ হয়ে বেঁচে থেকে কোনো লাভ নেই, বীর্যহীন লেখা লিখে কোনো লাভ নেই।
—ফালতু বকছিস, কবিতা পাঠ করলে,শুনলে মানুষের কত মন ভালো হয়ে যায়, সেটার কি কোনো মূল্য নেই?
–অফকোর্স আছে,তাই বলে সত্যটা তুলে ধরবে না? কবিতা লিখবে না আজকের যুগের পড়ার কি হাল হয়েছে সেই নিয়ে? লিখবে না মানুষের শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে,প্রশ্ন করতে ভুলে গেছো? সব চলছে ,আর ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া চলছে না? এও একটা যুদ্ধ চলছে, না তোমার মেয়ে চাকরি করছে বলে তুমি প্রেমের কবিতা লিখবে!
—আবার, আমার কবিতাকে এ্যাটাক?
— না,বলছি ভাবো, তোমরা দেশের শক্তি, প্রেম একটা মানসিক রোগ,যার কোনোরকম অস্তিত্ব নেই, ভালো করে শুনে নাও।
—এ্যাই, প্রেম যদি না থাকে, তাহলে তুই সামাজিক চুক্তিতেই বিয়ে কর,নাতি নাতনির মুখ দেখি।
—ওঃ, খুব তো , আমার কথার প্যাঁচেই আমাকে ফেলছো।
–হ্যাঁ,সব বকবক ছাড়, অত আন্দোলন ফান্দোলন করতে পারবো না বাপু,যত যাই বল না কেন? “বড়” “বড়”দের পকেট ভর্তি হবে,আর এই নির্জীব কবি আমি চেঁচিয়ে মরি আরকি, আমি একটু শান্তিতে সবুজ ঘাসকে নীল রঙের দেখবো তাতে তোর অসুবিধা কি?
—মাতঃ তুমি মম ছোটতে এই টালির ঘরে শিখিয়েছিলে,” শিক্ষা আনে চেতনা, চেতনা আনে বিপ্লব ” আমি আমার চেতনা দিয়ে বলছি, অনেক দেরি হয়ে গেল, অবশ্য একটু আগে একটা মেসেজ এসেছিল, মিটিংটা একটু পিছিয়েছে,তাই তোমার সঙ্গে কথা বলার সময় পেলাম, তোমাকে বলব না তো কাকে বলবো?
–তা তো বলবিই, আমি তো ন্যাংড়া শালিক।
–যাহ্ ,কী যে বলো, তুমি আমার মা, তুমি আন্তর্জাতিক কবি,দিনে তারা দেখো, মেঘের উপরে শুয়ে থাকো আর কি যেন, সেদিন লিখলে ,প্রচন্ড শুষ্ক বায়ুর মধ্যেও বৃষ্টিতে নাকি ভিজে চলেছো,হা হা হা হা পারোও বটে,পাগল হলে নাকি?
—তুই বুঝবি না, আলাদা চোখ থাকে,ত্রিনয়ন।
—আমার বুঝে কাজ নেই মা, আমি তো টালির চাল,আর তারমধ্যে একটু একটু শেওলা দেখছি,আর শীতকালে চান করা যে কী কঠিন,তাতে আবার তুমি ভিজে যাচ্ছো বৃষ্টিতে।
—কথা দিয়ে ভুলিয়ে দিলে হবে না, কাজের কথা বল।
—এখন বিয়ে করবো না, আগে আমি নিজের বাবা মাকে দেখি, নিজেকে ভালোবাসি, আগে কেরিয়ার,পরে , পরে সব‌ —-
—-গার্জেন কে? এখনও তোর বাবা বেঁচে। খুব চিন্তায় থাকে, কখন কোথায় ফেঁসে যাবি।
–হা হা হা হা ,ফাঁসার বয়স পেরিয়ে এসেছি,আর এই যুগের মেয়েরা অত তোমাদের মতো ফাঁসে না, বাবাকে বলে দিও, এখন তো আমি তোমাদের গার্জেন।
—তাই নাকি?
—হ্যাঁআআআ, আমি তো আয়না গো।

মেয়ের হেঁয়ালি বুঝতে পেরেই ,মা হেসে উঠতেই, মেয়েও হো হো করে হেসে ওঠে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *