গিরিশ চন্দ্রে নাট্যচর্চা ✒️✒️ পাপিয়া সাহা

গিরিশ চন্দ্রে নাট্যচর্চা

পাপিয়া সাহা

পূর্ব প্রকাশিতের পর
দশম পর্ব

গিরিশ চন্দ্র ঘোষ প্রায় নব্বই টি নাটক রচনা করেছিলেন। কয়েকটি নাটক শ্রীরামকৃষ্ণ ঠাকুরকে দর্শনের পূর্বে আর তার বেশির ভাগ নাটকই তার পরে লেখা।শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবধারা তিনি যেভাবে নাটকে অঙ্গীভূত করিয়াছিলেন তা সত্যিই বিস্ময়কর। ঠাকুরের সর্বধর্ম সমন্বয়ের আদর্শ, তার আধ্যাত্মিক শিক্ষার মূলভাব, বিশ্বাস, ভক্তি,আত্মনিবেদন, শিব জ্ঞানে জীব সেবা এবং ঈশ্বরের চরণে আত্মসমর্পণ, কখনও তার শ্রীমুখের অমৃত কথা সুকৌশলে নাটকে সংযুক্ত করিয়া নাটকের চরিত্রগুলি অঙ্কন করিয়াছিলেন। গিরিশ চন্দ্র তার নাটকের মধ্য দিয়া দেখাইয়াছেন কি ভাবে একজন প্রকৃত গুরু তার ভক্তকে পাপ ও প্রলোভনের হাত হইতে রক্ষা করেন ও তাদের রূপান্তর ঘটান। কখনও স্বামী বিবেকানন্দর সেবাদর্শকে তুলে ধরেছেন আবার কোথাও ঠাকুরের ভক্ত ও শিষ্যের জীবনাদর্শে চরিত্র সৃষ্টি করিয়াছেন।
অবতারের আবির্ভাবে শিক্ষা,সাহিত্য, শিল্প ধর্ম সমাজ সকল ক্ষেত্রেই এক নবযুগের সূচনা হয়। নতুন কৃষ্টি সংস্কৃতি ও সভ্যতার পুনর্জাগরণ হয়। অবতার মহাপুরুষের দৈবী ভাব দৈবী কর্ম, দৈবী জীবন ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের জীবনকেও প্রভাবিত করে ঠিক এই ভাবেই পুরানকাল হইতে ভগবান রামচন্দ্র, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভগবান বুদ্ধ প্রমুখ অবতারের জীবন ও কর্মপ্রবাহ এখনও পর্যন্ত সারা পৃথিবীর শিক্ষা,সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন শিল্পীদের অন্তরে প্রেরণা সঞ্চার ও উৎকর্ষতা দান করে চলেছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ ভারতের ইতিহাসে এক সঙ্কটময় মূহুর্তে জন্মগ্রহণ করেন।সে সময় পাশ্চাত্য শিক্ষা সংস্কৃতি ও সভ্যতার প্রভাব পরেছিল ভারতীয় সমাজ ও আধ্যাত্মিক জীবনে।খ্রীষ্টান মিশনারিরা ধর্মান্তকরণের উদ্দেশ্যে নানা প্রক্রিয়া ও প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল। কিন্ত এদিকে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের দিব্যজীবন এবং আধ্যাত্মিক শিক্ষা মানুষের হৃদয় স্পর্শ করেছিল এবং তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করেছিল। এটা সামাজিক ও ধর্মীয় নেতাদের উপর খুবই প্রভাব পরেছিল।
শ্রীরামকৃষ্ণ একজন জীবন্ত শক্তি। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যে শিল্পীসুলভ গুন পূর্ণ ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি বলতেন এই গুন ছাড়া কেউ প্রকৃত আধ্যাত্মিক মহিমা লাভ করতে পারেনা। যদিও অধিকাংশ সময় তিনি দিব্যভাবে বিভোর থাকতেন। তবুও শিল্পীজনোচিত সত্ত্বা ও প্রতিভা তার জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে ছিল। সেই সময়কার শিল্পী লেখক অভিনেতা গায়ক নর্তক সঙ্গীতবিদ সকলকেই তিনি উৎসাহ দিতেন। গিরিশ চন্দ্র বলতেন “নাটক তার কাছে শেখা,মহেন্দ্র (শ্রী ম)বলতেন মাষ্টারি তার কাছে শেখা আর নরেন্দ্র বলতেন বিজ্ঞান তার কাছে শেখা।অধ্যাপক নলিনী রঞ্জন চট্টোপাধ্যায় “শ্রীরামকৃষ্ণ ও বঙ্গ রঙ্গমঞ্চ ” নামে একখানি বই লিখেছিলেন। বাংলার অভিনেতা অভিনেত্রী ও সঙ্গীত শিল্পীদের ওপর শ্রীরামকৃষ্ণের গভীর প্রভাবের কথা উল্লেখ করিয়াছিলেন। সে সময় নাটকে স্ত্রী চরিত্রে অবতীর্ণ হইতেন বারবনিতারা, যারা সমাজে অত্যন্ত নিন্দনীয় ও ঘৃণ্য ছিল। কিন্ত ঠাকুর ঐ অভিনেত্রীদের পূর্ণ আশীর্বাদ দিয়েছিলেন। ফলে তারা সমাজ জীবনে স্বীকৃতি লাভ করিয়াছিল এবং ঠাকুর তাদের প্রতিভার স্বীকৃতি ও পূর্ণ আশীর্বাদ তাদের আত্মমর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং সেই সঙ্গে বঙ্গরঙ্গমঞ্চেরও পুনরুজ্জীবন ঘটেছিল

1884 সেপ্টেম্বর থেকে 1886র আগষ্ট পর্যন্ত গিরিশ চন্দ্র ঠাকুরের পুণ্য ও পরিপূর্ণ সংস্পর্শ লাভ করিয়াছিলেন। তিনি পাইয়াছিলেন ঠাকুরের সীমাহীন স্নেহ ভালবাসা ও অহৈতুকী কৃপা। গিরিশ চন্দ্র যখন থিয়েটার ছেড়ে সন্যাসী হতে চেয়েছিলেন তখন ঠাকুর বলেছিলেন “না না ও থাক ,ওতে লোকশিক্ষে হবে।” থিয়েটার জনসাধারণের কাছে বার্তা পৌঁছানোর এক শক্তিশালী মাধ্যম এইটি অনুভব করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ ঠাকুর। গিরিশ চন্দ্র ছিলেন অত্যন্ত প্রতিভাবান।গিরিশ চন্দ্র শুধুমাত্র অসাধারণ নাট্যকার নন,তিনি ছিলেন বিখ্যাত কবি,সঙ্গীত স্রষ্টা ,ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক ও গল্পবক্তা।গিরিশ চন্দ্র তার নিখুঁত পর্যবেক্ষণ শক্তি ও অনুকৃতির মাধ্যমে গুরুর ভাবধারা আত্মস্থ করে তা নাটকে সঞ্চারিত করার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। শ্রীরামকৃষ্ণের ঈশ্বরানুরাগ ও তীব্র বৈরাগ্যময় জীবনের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন গিরিশ চন্দ্র। “রূপ সনাতন”নাটকে সনাতনের চরিত্রে গিরিশ শ্রীরামকৃষ্ণের ভগবানের প্রতি ভালবাসা ত্যাগ, সত্যনিষ্ঠা ও আদর্শের ভাবেই ফুটাইয়া তুলিয়াছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ গিরিশের বকলমা নিয়ে তাকে আত্মধ্বংসের পথ হইতে রক্ষা করিয়াছিলেন। দুইটি দিক দিয়া ইহার গুরুত্ব অপরিসীম। গিরিশের মধ্য দিয়া ঠাকুর ত্রাণশক্তি প্রকাশ করেন অপরদিকে গিরিশ তা উপলব্ধি করিয়া মানব জাতিকে দেখাইলেন যে ভগবানে আত্মসমর্পণ করিলে পাপ হইতে মুক্তি লাভ ঘটে। শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃতে শ্রীম লিপিবদ্ধ করিয়াছিলেন ঠাকুর কিভাবে ভক্তদের আমমোক্তারনামা বা বকলমা দিতে শিখাইয়াছিলেন। power of attorney র পরিবর্তে ঠাকুর ঐ অদ্ভূত শব্দ দুটি ব্যবহার করিয়াছিলেন। কি অদ্ভুত অসাধারণ ঠাকুরের শব্দ সংযোজন। ঠাকুর যখন কোলকাতায় শ্যামপুকুরে চিকিৎসার জন্য আসিয়াছিলেন তখন একদিন গিরিশ চন্দ্র দেখিলেন ঠাকুর তার নিজের সূক্ষ্ম শরীরটা স্কুল শরীর হইতে বাহিরে আসিয়া বেড়াইতেছে।ঠাকুর হঠাত বলিয়া বসিলেন, “কেন এমন হল?দেখলুম তার পিঠময় ঘা হয়েছে। ঠাকুর ভাবিতে লাগিলেন, কেন এই শরীরে এসব হল। “আর মা দেখাইয়া দিতেছেন পাপী তাপী কত খারাপ কর্ম করিয়া লোকে ছোঁয়। অসহ্য যন্ত্রণা। ঠাকুর তার গলা দেখাইয়া বলিতে লাগিলেন কেন এইরূপ হইয়াছে? এই শরীর তো অন্যায় কিছু করেনি।তবে এত রোগ ভোগ কেন? শুনিয়া আশ্চর্য হইয়াছিলাম। বাস্তবিকই তবে একজন অপরের কৃতকর্মের ফল ভোগ করিয়া তাহাকে ধর্মপথে অগ্রসর করিয়া দিবার এই আশ্চর্য সম্মোহনী ক্ষমতা অর্জন করিতে পারেন। একমাত্র ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ছাড়া পৃথিবীতে এমন গুরু কমই আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ বলিতেন যে গিরিশের ন্যায় বুদ্ধিমান ব্যক্তি আর নাই। স্বামী ব্রহ্মানন্দ বলিয়াছিলেন যে ঠাকুরের সকল শিষ্যদের মধ্যে বিবেকানন্দ ও গিরিশের বৌদ্ধিক শক্তি ছিল সবচেয়ে বেশি। কিন্ত গিরিশের বুদ্ধি হার মেরেছে ঠাকুর যখন অখণ্ড ব্রহ্মের অনন্ত স্বরূপের কথা ব্যক্ত করিতেন। 1885 সালের বসন্ত কালে শ্রীরামকৃষ্ণ ঠাকুরের গলায় দুরারোগ্য ক্যান্সার রোগের সূত্রপাত হয়। সেপ্টেম্বর মাসে ভক্তরা ঠাকুরের চিকিৎসার জন্য দক্ষিনেশ্বর হইতে শ্যামপুকুর বাটিতে লইয়া আসেন।
6th ডিসেম্বর 1885। ঐদিন ছিল কালীপূজা। ঠাকুরের নির্দেশে ভক্তরা শ্যামপুকুর বাটিতে কালীপূজার আয়োজন করিয়াছিল। সেদিন প্রায় ত্রিশ জন ভক্ত উপস্থিত ছিল। ভক্তদের মধ্যে গিরিশই প্রথম ঈশ্বর জ্ঞানে শ্রীরামকৃষ্ণ পাদপদ্মে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করিয়াছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ ঠাকুরের স্বাস্থ্যের ক্রমাবনতি হওয়ায় চিকিৎসকদের পরামর্শে ভক্ত শিষ্যরা কাশীপুর উদ্যানবাটিতে লইয়া আসিলেন। শিষ্যরা সবাই মিলে ঠাকুরের সেবাযত্ন ও পরিচর্যার দায়িত্ব গ্রহণ করিলেন। এতে ক্রমশঃ খরচা পাতি বাড়তে থাকায় গৃহী শিষ্যরা তরুন ভক্ত শিষ্যদের প্রতি বেহিসেবী খরচ করার অভিযোগ আনিলেন।ইহাতে যুবক শিষ্যরা মনঃক্ষুন্ন হইলে গিরিশ চন্দ্র আগাইয়া আসিয়া সমাধানের দায়িত্ব গ্রহণ করিলেন। তিনি সকলের সম্মুখে হিসাবের খাতা পুড়াইয়া দিলেন। তিনি গৃহীভক্তদের তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী অর্থ সাহায্য করিতে বলিলেন আর ঘাটতি যাহা পরিবে তাহা নিজে পূরণ করিয়া দিবেন এই অঙ্গীকার করিয়া সমাধানের ব্যবস্থা করিয়াছিলেন।
1886 সালের 1লা জানুয়ারি । ঠাকুর একটু সুস্থ বোধ করায় কাশীপুর বাগানবাটিতে একটু হাঁটতে লাগিলেন। সেদিন ছুটি থাকায় বহু ভক্ত কলিকাতা হইতে ঠাকুর কে দর্শন করিতে আসিয়াছিলেন। হঠাৎ ঠাকুর গিরিশ কে জিজ্ঞাসা করিলেন-“গিরিশ তুমি যে সকলকে এত কথা( আমার অনেক অবতার সম্বন্ধে) বলে বেড়াও, তুমি ( আমার সম্বন্ধে) কি দেখেছ ও বুঝেছ “। গিরিশ মুহুর্ত মাত্র বিলম্ব না করিয়া ঠাকুরের পদপ্রান্তে হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া করজোড়ে ভক্তি গদগদ স্বরে বলিলেন- ” ব্যাস,বাল্মিকী যার ইয়ত্তা করিতে পারেন নাই, আমি তার সম্বন্ধে কি বলিব “।গিরিশের সরল বিশ্বাসের উক্তি শুনিয়া ঠাকুর মুগ্ধ হইয়া বলিলেন তোমাদের আশীর্বাদ করি, তোমাদের চৈতন্য হোক। তারপর অর্দ্ধবাহ্যদশায় একে একে ঠাকুর সকল ভক্তদের স্পর্শ করিলেন। ঠাকুরের দিব্যস্পর্শে ভক্তদের চৈতন্যের স্ফূরণ হল।আনন্দে উত্তেজিত গিরিশ ঠাকুরের কৃপা লাভ করিবার জন্য সকলকে ডাকাডাকি শুরু করিলেন। এমন কি রান্নাঘরের রুটিবেলা অবস্থায় রাঁধুনিকে পর্যন্ত টানিয়া লইয়া তাকেও ঠাকুরের আশীর্বাদ পাওয়াইয়া দিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ ঠাকুরের আধ্যাত্মিক স্পর্শে গিরিশের ভোগবাদী বস্তুবাদী মনোভাব সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তিত হল।জীবনের শেষ কুড়ি বছর তিনি মদ স্পর্শ করেন নি।তার বিশাল হৃদয় শোক,তাপ,আনন্দ, হতাশা, যন্ত্রণা হইতে সহজেই মুক্তি লাভ করিল। গিরিশ চন্দ্র উপলব্ধি করিলেন যে জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাই কবি ও নাট্যকারদের শিল্পকে জীবন্ত ও মর্মস্পর্শী করিয়া তুলিতে পারে। তিনি স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে উচ্চকণ্ঠে স্বীকার করিয়াছিলেন যে বেশ্যা থেকে পরমহংস পর্যন্ত আমি সবরকম চরিত্রের সংস্পর্শে আসিয়াছি এবং সহজেই তাহাদের সহিত মেলামেশা করিয়াছি।
প্রকৃত বন্ধুত্ব ও ভালবাসা লাভ করা ঈশ্বরের অনুগ্রহ। সাধারণত সমবয়স্কদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়। গিরিশ চন্দ্র বিবেকানন্দর থেকে প্রায় বিশ বছরের বড় ছিলেন। তবুও তারা নিজেদের মধ্যে সমবয়স্ক বন্ধুর মত আচরণ করতেন পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালবাসার মর্যাদা রেখে। দুই মহান আত্মার মধ্যে এরকম খোলামেলা সহজ সরল বন্ধুত্ব কদাচিৎ দেখা যায়। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাদের তর্ক ,বাকবিতণ্ডা মধুর ঝগড়া ও প্রাণবন্ত বার্তালাপ ছিল উপভোগ করার মত। দুজনেই ছিলেন প্রতিভাবান ও সৃজনশীল। দুজনেই তাদের দৈহিক ও বৌদ্ধিক শক্তির উপর আস্থাশীল।দুজনকেই কঠিন জীবন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। দুজনেই প্রকৃত গুরু অনুসন্ধান করিয়াছেন। দুজনেই একদিকে যেমন সন্দেহবাদী আবার অন্যদিকে ঈশ্বর বিশ্বাসী।এমতাবস্থায় পরিশেষে বিধাতা দুজনকেই শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে পৌঁছাইয়া দিয়াছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ ঠাকুরের বিশুদ্ধ নিঃস্বার্থ প্রেম ও আধ্যাত্মিক শক্তি দুজনকেই অভিভূত করিয়াছে। অবশেষে এই দুই বিদ্রোহী আত্মা শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্যত্ব গ্রহণ করিয়াছেন। বিবেকানন্দ গিরিশ চন্দ্রকে জি সি বলিয়া সম্বোধন করিতেন। উভয়ে উভয়কে গভীর ভাবে উপলব্ধি করিয়াছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের মহাপ্রয়াণের পর গিরিশ চন্দ্র দেখিতে যান নি। কিন্ত 1902 সালের 4th জুলাই স্বামী বিবেকানন্দর দেহ ত্যাগের পরদিন গিরিশ চন্দ্র বেলুড় মঠে গঙ্গার পারে বসিয়া তাহার সম্পূর্ণ দাহ কার্য প্রত্যক্ষ করেন এবং ভগ্ন হৃদয়ে আক্ষেপ করিয়া বলেন- ” নরেন তুমি বেঁচে থেকে আমার কথা বলে আমার মহিমা প্রচার করিবে ,তা নয়তো তুমি আমাদের কি দশায় ফেলিয়া রাখিয়া ঠাকুরের কোলে গিয়া ঠাঁই নিলে।
শ্রীরামকৃষ্ণ ঠাকুরের জীবদ্দশায় গিরিশ চন্দ্র প্রকাশ্যে তাকে অবতার বলিয়া ঘোষণা করিয়াছিলেন। ঠিক সেইরকম গুরুপত্নী শ্রীমা সারদা দেবীর প্রতি ছিল তার গভীর শ্রদ্ধা ও ভক্তি। একদিন বলরাম বসুর বাড়ির ছাদে শ্রী মাকে পদচারণা করিতে দেখিয়া সঙ্গে সঙ্গে পিছন ফিরিয়া বলিলেন ” আমার পাপ নেত্র। এমন করিয়া লুকাইয়া আমি মাকে দেখিবার না। এই বলিয়া তৎক্ষনাৎ উপর হইতে নীচে নামিয়া পরিলেন।
গিরিশ চন্দ্রের প্রতিভা অনুধাবন করিয়া জোনাথন সুইফ্ট লিখিয়াছিলেন- “এ জগতে প্রতিভাবান ব্যক্তির যখন আবির্ভাব ঘটে তার লক্ষণ হল সব অর্বাচীন ব্যক্তিরা তার বিরুদ্ধে দলবদ্ধ হয়। গিরিশ চন্দ্রের ক্ষেত্রেও তাহাই হইয়াছিল। “তার বোহেমিয়ান জীবন যাত্রার প্রতি তীব্র সমালোচনা ও আক্রমণ করা হইয়াছিল। তাহার তীক্ষ্ণ প্রতিভাকে লোকে ভুল ব্যখ্যা করিয়াছে। তার ওপর তার প্রিয়জনদের এক এক করে অসময়ে মৃত্যু তাহাকে মানসিক বিপর্যস্ত করিয়া তুলিয়াছিল ।ঈশ্বরের অস্তিত্বে সন্দেহ আনয়ন করিয়াছিল। এত সঙ্কট সত্ত্বেও জীবনের প্রতি পদক্ষেপে তিনি বীরের মত সংগ্রাম করিয়াছেন। নাটক রচনা ও অভিনয়ের প্রতি তার প্যাশান বা তীব্র অনুরাগ তার সৃজনী শক্তিকে জাগাইয়া তুলিত। মিসেস গ্রে হ্যালক শ্রীরামকৃষ্ণের এক হিন্দু শিষ্য ও বেদান্তের প্রবক্তা তিনি নিজে গিরিশ চন্দ্রের এই প্রতিভা ও সৃজনী শক্তির কথা স্বীকার করিলেন। প্রাচীন ভারতের প্রবীণ ধর্মশাস্ত্র গ্রন্থ হল বেদান্ত। সেই সাহিত্যের নানা তত্ব প্রয়োগে গিরিশ অভূতপূর্ব সব নাটক রচনা করিয়াছিলেন। তার সাহিত্য কর্মের সম্পূর্ণ অনুবাদ এখনো পর্যন্ত পাওয়া যায় না। যদি পাওয়া যাইত তাহলে তা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য কলার মতই সুদূরপ্রসারী হইত।
গিরিশ চন্দ্র জীবনে প্রচুর শোক পাইয়াছিলেন।তার শোকসন্তপ্ত জীবনের একমাত্র সান্ত্বণা ছিল শ্রীরামকৃষ্ণের শ্রী পাদ পদ্ম এবং তার কবিতা ও সঙ্গীত রচনা। শ্রী গুরুর উপর তার আত্মসমর্পণ ততই দৃঢতর হইয়াছে যতই তার শোক তাকে শেল রূপ বিদ্ধ করিয়াছে। তিনি তার চরিত্রগুলির সাথে একেবারে মিশিয়া গিয়া চরিত্রটি একেবারে প্রাণবন্ত করিয়া তুলিতে পারিতেন। একবার বিখ্যাত সুপণ্ডিত ও মানব প্রেমিক বিদ্যাসাগর মহাশয় আসিয়াছিলেন গিরিশের নাটক দেখিতে। গিরিশ চন্দ্রের এক অসচ্চরিত্রের অভিনয় দেখিয়া বিচলিত হইয়া অভিনেতার উদ্দেশ্যে নিজের একপাটি জুতা ছুঁড়িয়া মারেন। গিরিশ বাবুর সেটি মাথায় তুলিয়া লইয়া বলিলেন অভিনয় জীবনে এটি তার সর্বশ্রেষ্ঠ স্বীকৃতির উপহার। 1867 সাল থেকে 1912 সাল পর্যন্ত বঙ্গ রঙ্গমঞ্চে গিরিশ চন্দ্রের অভিনয় ও নাট্য রচনার প্রবাহ নিরবচ্ছিন্ন গতিতে চলিয়াছিল। অবশেষে তিনি অনুভব করিলেন তার জীবন তরী ওপারের হাতছানিতে সাড়া দিতে প্রস্তুত হইতেছে।গিরিশের অদম্য প্রাণশক্তি ও অবিস্মরণীয় প্রতিভা তাহাকে সফলতার শীর্ষে পৌঁছাইয়া দিয়াছিল। তাই কিছু না পাওয়ার আক্ষেপ তার বিন্দুমাত্র ছিল না। শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তমণ্ডলীতে তিনি ছিলেন বীরভক্ত। রঙ্গমঞ্চে তিনি ছিলেন একজন আকর্ষণীয় অভিনেতা। ব্যক্তিগত পরিধিতে তিনি ছিলেন কোমলপ্রান ও দায়িত্বশীল দূরদর্শী ও মহান। তার জীবন ছিল সর্বদা লক্ষ্যাভিমুখী। তিনি নিন্দা স্তুতি প্রশংসা ও সমালোচনা দুটো দিকেই ছিলেন অবিচল। তার আকর্ষনীয় ব্যক্তিত্ব সমালোচকদেরও দূর্বল করে দিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *