“দ্বিতীয় পত্র তার কাছে” মালবিকা

“দ্বিতীয় পত্র তার কাছে”
মালবিকা

প্রিয়তমেসু,

তোমায় চিঠি না লিখে পারছি না। হৃদয়ে কত সংকোচ, কত শঙ্কা তবু সে সব ভুলে আমি লিখছি। এ চিঠি কোন ডাকঘরে যাবে না ।কোন ডাক হরকরা কোন ঠিকানায় পৌঁছাবে না। শুধু জানি বহুদূর থেকেও তুমি এ চিঠির প্রতিটি শব্দ,অক্ষর,ভাব সব জেনে যাবে। তাইতো সাহস করে লিখতে বসেছি ।

যেদিন প্রথম তোমায় দেখলাম সেদিন কি লগ্ন, রাশি, তিথি ছিল কে জানে কিন্তু আমার মনে হল রামধনুর সব রং বুঝিবা আকাশ হতে ধরায় নেমে এসেছে। হয়তো সম্পূর্ণ বলা হলো না।মনে হল বুঝিবা অরুণোদয়ের রক্তিম আলোয় ভুবন ভরে গেল আর আমার চেতনা শতদলের মতো শত পাপড়ি মেলে দিল। আমি ধন্য হলাম।

তারপর দিন কত গত হল। আমার দিবস রাত্রি নির্দিষ্ট কাজের ধারায় বয়ে চলল। এভাবেই একদিন বাদল এলো। বৃক্ষলতার পল্লব গুলো সব নবীন জলধারায় কেমন সতেজ, সবুজ হয়ে উঠলো। কত কদম ফুটল। নদীর জল কাজল কালো মেঘের বর্ণ ধার করে কেমন চিকন কালো হয়ে উঠলো। সেদিন তোমাকে হে ঈশ্বর তোমাকে দেখলাম অনেক অনুরাগীর মাঝে কেমন বাঁশি বাজাচ্ছো।অনেক দূরে থেকেও আমি ওই বাঁশির সুরে আমার নাম শুনতে পেলাম।বাঁশিওয়ালা,বাঁশিওয়ালা কেন বাজালে তোমার মোহন বাঁশি? আমি যে আকুল হয়ে গেলাম। আমার এত সৌভাগ্য! এত সৌভাগ্য! কোনদিন তো নয়নের ভুলেও আমার পানে চাওনি তবে কেন বাঁশিতে আমাকে ডাকলে? আমার ভুবন আলোয় উদ্ভাসিত হল।আমি ধন্য হে ঈশ্বর আমি ধন্য হলাম ।

সে রাত ছিল বাদল রাত আমি আমার একান্ত শয়নে ছিলাম। পুঞ্জ পুঞ্জ কালো মেঘের অন্ধকারে সবাই সুপ্তিমগ্ন। তখন মনে হয় জগতে কোন প্রাণীও জেগে নেই ঠিক তখনই আমার হৃদয় বীণায় কে যেন মধুর সুরের টংকার দিল। চকিতে আমি নয়ন মেলে দেখলাম কেউ কোথাও নেই, কেবল আমার হৃদপিন্ডের অশান্ত শব্দ আমাকে সুপ্তি থেকে ফিরিয়ে আনলো মনে হল কে যেন আমায় ডেকেছে–
বিশ্ব যখন নিদ্রামগন,গগন অন্ধকার,
কে দেয় আমার বীণার তারে এমন ঝংকার।।
নয়নে ঘুম নিলো কেড়ে উঠে বসি শয়ন ছেড়ে-
মেলে আঁখি চেয়ে থাকি,পাইনে দেখা তার ।।
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আমার এ মিনতি শোনো হে বাঁশিওয়ালা, আমাকে আর বাঁশিতে ডেকো না।আমি আনন্দে পুলকে কখন যে মরেই যাব জানিনা ।তোমার উদাসীনতা বরং আমার ভালো ছিল। কেন জানো? তোমার বাঁশির সুর শুধু আমাকে স্পর্শ করে কিন্তু তুমি তো পরশ দাওনা আমাকে আর মেরো না তুমি হে ঈশ্বর আমাকে বাঁচতে দাও।

কত কাজ, কত পড়াশুনা সবই আমার এলোমেলো হয়ে যায়। আমার সময় যেন আর আমার নয়,সবই তোমার। আমি যখন বই পড়ি আমার বইয়ের পাতায় পাতায় তোমারি নাম লেখা থাকে,যখন কাজ করি তখন সব কাজ যেন তোমার জন্যই করি। আমার সকাল আমার বিকেল এখন শুধু আনমনা আর আনমনা যায় ।আচ্ছা বলোতো আমি কি চন্দ্রাহত হলাম? সারা জীবন যৌবন আমার কি এমন ধারায় যাবে?সেদিন নদীতে গেছি নাইতে নয় শুধু একটু নদীর জলে পায়ের পাতা ভিজিয়ে হাঁটতে কিন্তু কি হল জানো! আমি জলে পা ছোঁয়াতেই দেখি তুমি জলের অতলে আছো তোমাকেই দেখলাম কিন্তু তুমি তো আমায় দেখলে না ।চাইলে না আমার দিকে। শুধু আমি ত্বরিতে পা সরিয়ে নিয়ে তাকিয়ে দেখি কোথাও কেউ নেই একি আমার চোখের না মনের ভুল! সে তুমিই জানো।আমি শুধু জানি যে আমার মরণ ঘনিয়েছে ।মরণ সেও তো ভালো আমার কাছে যদি তুমি সাথে থাকো। ঈশ্বর কেন আমার সাথে তোমার এত ছলনা এত নিষ্ঠুরতা কেন ঈশ্বর কেন? আমি একান্তভাবেই সেই নবদূর্বাদলশ্যামের জন্য বাঁচি। না না মরিও প্রভু মরে যাই। এবার আমার সত্যিই মরন ঘনালো। কতদিন তুমি আমার দিকে তাকাওনি কতদিন আমাকে একটু ভালো বলনি আমি যে তোমার ধ্বনি শোনার কাঙাল সেটা জেনে আমাকে একটু দয়া করো ।একটু দয়া করো ।আমার আকুতি আমার মিনতি কি তুমি শুনতে পেয়েছো দয়াময়? যদি শুনেই থাকো তবে একটু কথা বলো ঈশ্বর একটু কথা-
ইতি-
অনুরাধা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *