ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে (ষষ্ঠ পর্ব) ✒️✒️ সায়ন্তন ধর

ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে (ষষ্ঠ পর্ব)

সায়ন্তন ধর

এবারে হোটেল ছেড়ে গেস্টহাউসে শিফ্ট করা হলো। আইআইটির ভিতরেই পুরোনো গেস্টহাউসে। ওখানে দুটি গেস্টহাউস। নতুনটি বহুতল, একটা অন্যরকম আকর্ষণ থাকলেও পরে বুঝলাম পুরোনো গেস্টহাউসের গঠন শৈলী একেবারে অন্যরকম। আন্ডারগ্রাউন্ড রুম থেকে শুরু করে পাঁচতলা উঁচু টাওয়ার সবই রয়েছে এখানে। আইআইটিও ঠিক যেন ছবির মত। পাহাড় আছে। লেক আছে। অরণ্য মাঝে আছে সভ্যতার ছোঁয়া। মিটিং সেরে সন্ধ্যা নাগাদ ফিরেছি। তার পর একটু ঝিরঝিরে বৃষ্টি হলো। বৃষ্টি থামতেই বেরিয়ে পড়লাম বৃষ্টিভেজা রাস্তার আঘ্রাণ নিতে। হাঁটা পথেই একটু ঘুরে নিলাম সকলের সাথে। পরদিন সকালে আবার মিটিং। তার কিছু আগে গেস্টহাউস প্রাঙ্গণে ফুলেদের সাথে পরিচিত হচ্ছিলাম। হলুদ-কমলা সর্বজয়া ফুটে আছে লেকের ধারে। লেকের জলে ভাসছে ক্ষুদেশালুক নিম্ফয়ডিস। লুডুইজিয়া অক্টোভালভিস ও অ্যাডসেন্ডেন্সরা ভেসে রয়েছে হাত ধরাধরি করে। মরশুমি ডালিয়ায় সেজেছে মোরাম বিছানো পথের দু’পাশ। লেকের ধারে তালের সারি, যেন তারা প্রহরারত। গোলাপি সাধারণ ল্যান্টানা ক্যামারার সাথে দেখা মিলল অসাধারণ সাদা ল্যান্টানার। গেস্টহাউসের রূমে একটা ব্রোশিয়ার পেয়েছিলাম, তাতে দেখা গেলো গ্রীষ্মে লেকের ধারে সার বাঁধা গুলমোহরের লাল ফুলে যেন আগুন লাগে। কিন্তু এখন তো বসন্তকাল, তাই সে রূপ প্রত্যক্ষ করা থেকে বঞ্চিত হলাম। এখন নেড়া গুলমোহরের ডালে শুধু দু’তিনটে শুকনো ফল ঝুলে আছে। গেস্টহাউসের ভিতরেও কিছু অংশ বেশ উঁচু, নিশ্চিত রূপে ওগুলো ক্ষয়প্রাপ্ত টিলার অংশ। পরিসীমায় সাদা কালো তারজালি রেলিং। ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম কনফারেন্স রুমের উদ্দেশ্যে। সে পথেও লেকের ধার দিয়ে চলার পথে দেখা গেল বাঁশ সদৃশ সিমেন্টের রেলিং। টলটলে জলে হাওয়ার কারেন্ট। পাহাড়টা আরও কাছে দেখা যাচ্ছে। আবারও দীর্ঘ সময় ঠাণ্ডা ঘরে কাটিয়ে সন্ধ্যায় ফেরা। দিনের দৃশ্য একরকম, আর রাতের আলো ঝলমলে দৃশ্য বড়োই মায়াবী। সেদিন আমার কলিগদাদা চারটি সাইকেল জোগাড় করে ফেলল। সেই সাইকেলে করে পুরো ক্যাম্পাস ঘুরে ফেললাম। রাতের ক্যাম্পাস দেখে মন ভরে গেলো। পরে সাইকেল গুলো জমা করে এলাম লোহিত ছাত্রাবাসে। এরপরদিন মিটিং নেই, সকলে মিলে পাহাড়টায় চড়বো ভাবছি, গেস্টহাউসের রিসেপশনিস্টকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেসও করলাম। কিন্তু সে বলল যে শীতের শেষে নাকি লেপার্ড বাচ্চা দেয়। তিনদিন আগেই ওই পাহাড়ে লেপার্ড দেখা গেছে, তাই সেখানে যাওয়া নিরাপদ নয়, অগত্যা ভোরবেলায় গেস্টহাউসের টাওয়ারের ওপরে উঠে চারিদিকে দৃষ্টি বুলিয়ে নিলাম। আমি বরাবর প্রাকৃতিক দৃশ্যে মোহিত হলেও এবার এই প্রকৃতির মাঝে প্ল্যানমাফিক গড়ে ওঠা আইআইটি ক্যাম্পাসও মুগ্ধ করলো আমাকে। যেদিকে তাকাই বিস্মিত হই। তারপর একটু ফাঁকা রাস্তায় একাই হাঁটতে লাগলাম। লেকের ধারে শীত শীত আমেজ। সূর্যোদয় হলো পূর্ব আকাশ ও লেকের জলকে রাঙিয়ে। নিউ গেস্টহাউস থেকেও ঘুরে এলাম একটু। সেখানেও লাল জারবেরা, গোলাপি জিনিয়া ও ফ্লক্সের দল অভ্যর্থনা জানালো আমাকে। এরপর আবার দিনের বেলা একই রুটিন শেষে সন্ধ্যায় পথে ঘোরাঘুরি উদ্দেশ্যহীন ভাবে। পরদিন গেস্টহাউসের পিছনের দিকটায় এলাম। রাস্তা বা লেকের তুলনায় এ অংশটা বেশ উঁচু। মসৃণ করে কাটা মখমলী দূর্বাঘাসের ওপর দিয়ে হাঁটার থেকে গড়াগড়ি খেতে ইচ্ছে হয় বেশি। একজন মালি যত্ন নিচ্ছে এই বাগানের। সে ফুটিয়েছে ইউফরবিয়া মিলি, বোগেনভেলিয়া, রিও ডিসকালারদের। আমাকেও একটা সুন্দর ছবি তুলে দিল এ সুন্দর প্রেক্ষাপটে। রিওর পাতা থেকে তখনো মুছে যায়নি শিশিরের জল। অরোকেরিয়া কুকিরা লাইন দিয়ে বড় হওয়ার অপেক্ষায় আছে। আজ এসেছি অফিসে। অফিস থেকে দেওয়া ল্যাপটপটা ফিরিয়ে দিতে হবে। তারপর অফিসের গাড়ি আমাদের পৌঁছে দিল স্টেশনে। দুপুরের ট্রেন ধরে সন্ধ্যে নাগাদ ফিরে এলাম একরাশ স্মৃতির বোঝা নিয়ে।

(ক্রমশঃ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *