“প্রথম পত্র তাঁর কাছে ” মালবিকা
“প্রথম পত্র তাঁর কাছে “
মালবিকা
প্রিয়তমেসু ,
ঈশ্বর- এই প্রথম তোমাকে লিখছি হৃদয়ের গোপন কথা অবশ্য তুমি তো সবই জান। আমিই শুধু তোমার একান্ত অনুরাগী নই। তোমার অজুত নিযুত অনুরাগী সদা সর্বদা তোমাকে বেষ্টন করে আছে ।আমি একান্তই তুচ্ছ তৃণসম, তাই তোমার ছায়াতলে যেতে পারি না। কিন্তু কি আশ্চর্য দেখো সেদিন যখন তুমি তোমার ভক্তদের মাঝে তমাল তরুসম দাঁড়িয়েছিলে তখন তোমার অধরে ছিল মোহন হাসি আর হাতে ছিল মোহন বাঁশি ।আমি শুধু দূর থেকে নতমুখে দাঁড়িয়ে সমস্ত চেতনা দিয়ে তোমাকে অনুভব করছিলাম। তখন হঠাৎ যে আমার পানে চেয়ে তুমি মৃদুস্বরে বললে “মিষ্টি তোমার চাউনি দুটি “আমার সমস্ত অন্তরাত্মা হঠাৎ এক দীব্য আলোর স্পর্শে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। চকিতে মুখ তুলে দেখি হে ঈশ্বর তুমি তো সেই অনুরাগীর ভিড়ে তমাল তলে মোহন হাসি আর মোহন বাঁশি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছো, শুধু তোমার দেহের শ্যামল জ্যোতি কখন যেন কনক বরণ হয়ে আমাকে উজ্জ্বল করেছে। মনে পড়ল আমার আত্মীয়-স্বজন বলেছিলেন যে আমার কালো বরণ আমাকে কুরূপা করেছে। কিন্তু দয়াময় জানো আজ আমি জানলাম তোমার আলোর স্পর্শ পেলে কালোও আলোকিত হয়ে ওঠে।
দিনের পর দিন যায় আমি শুধু দিন যাপনের আলো অন্ধকার নিয়ে পড়াশোনা ,কাজকর্ম আর তোমাতে মগ্ন হয়ে আছি। একদিন তুমি আর তোমার ভক্তরা সবাই মিলে গেছো নদী তীরে বনভোজনে ।আমিও ছিলাম দূরে দূরে সংকোচে একটু আনমনা হয়েই বুঝিবা। নদীতীরে বালুচরে সবাই কলরব আর ছোটাছুটি করে বনভোজনের আয়োজনে ব্যস্ত। নদীর ওপারে দিগন্ত জুড়ে সরষে ফুলের সোনালী বিস্তার আর বিস্তার ।আকাশ জুড়ে আলোর মেলা ।টুকরো সাদা মেঘের আনাগোনা সমস্ত আকাশ জুড়ে কী আলো! কী আলো! হঠাৎ আনমনা আমাকে কে যেন বলে গেল “কি মিষ্টি তোমার কথা”। আবার আমার অন্তরাত্মা কি এক অপূর্ব আনন্দে শিহরিত হল ।পলকে দূরে তাকিয়ে দেখি হে ঈশ্বর ,তুমি কদম তরুতলে তোমার মধুর ভুবন ভোলানো হাসি নিয়ে অন্যদিকে চেয়ে আছো। শুধু আমাকে ঘিরে আছে এক অপূর্ব স্নিগ্ধ আলো। সে আলো বুঝিবা তোমার শ্যামল অঙ্গের আভা কখন যেন গলিত সোনার আলো নিয়ে আমাকে উজ্জ্বল করেছে। তখনই ঠিক তখনই মনে পড়ল আমার আশেপাশের সবাই বলেছিলেন আমার চলা-বলা সবই যেন কেমন কেমন। সেই অবজ্ঞা সেই অবহেলা কোথায় নিমেষে উধাও হয়ে গেল ।আমি এক মর্যাদাময়ী নারী হয়ে উঠলাম।
ঈশ্বর আমার তনুর অনুপরমানুতে মিশে আছো তুমি অথচ আমি তোমার কৃপা থেকে যোজন যোজন দূরে দাঁড়িয়ে আছি ।আশায় আশায় থাকি যে একদিন অবশ্যই আমি আমার আরাধ্য দেবকল্প মানব ঈশ্বরকে আমার সত্তায় অনুভব করব, কিন্তু সে কবে ?তবু তুমি মাঝে মাঝে আমাকে তোমার অনুরাগ দিয়ে ধন্য কর, তাতেই আমি উজ্জ্বলিত, উচ্ছলিত ,আনন্দিত। “তাই তোমার আনন্দ আমার পর”।
প্রভু, তোমা লাগি আঁখি জাগে;দেখা নাই পাই ,পথ চাই, সেও মনে ভালো লাগে।।
ধুলাতে বসিয়া দ্বারে , ভিখারি হৃদয় হারে
তোমারি করুণা মাগে।
কৃপা নাই পাই শুধু চাই ,সেও মনে ভালো লাগে।।
আজি এ জগত মাঝে কত সুখে কত কাজে
চলে গেল সবে আগে সাথী নাহি পাই
তোমায় চাই সেও মনে ভালো লাগে।
চারিদিকে সুধা ভরা ব্যাকুল শ্যামল ধরা
কাঁদায় রে অনুরাগে ;
দেখা নাই পাই, ব্যথা পাই সেও মনে ভালো লাগে।
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পূজাপর্যায়)
পরিশেষে হে ঈশ্বর- তোমার লক্ষ কোটি রাধা আছে আমি রাধা নই
-আমি তোমার অনুরাধা ।