ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে (পঞ্চম পর্ব) সায়ন্তন ধর
ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে (পঞ্চম পর্ব)
সায়ন্তন ধর
তিস্তা পাড় থেকে ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে যেতে যতগুলি ট্রেন আছে তার মধ্যে নামের দিক থেকে সবচেয়ে সামঞ্জস্যপূর্ণ ট্রেন দুটি। আমার ট্রেনে প্রথম চড়া বা পথের পাঁচালীর অপুর মত প্রথম ট্রেন দেখার অভিজ্ঞতার আগেই সে ট্রেনদুটি একবার নিউজপ্রিন্টের ফ্রন্টপেজের হেডলাইন হয়েছিল। সেটা ছিল ২রা আগস্ট, ১৯৯৯। অভিশপ্ত গাইসাল দুর্ঘটনার খবর পড়ে জেনেছিলাম অবোধ আসাম এক্সপ্রেস ও ব্রহ্মপুত্র মেইল এর নাম। সেই ব্রহ্মপুত্র মেইলে যাত্রা শুরু হলো। জলপাইগুড়ি রোড স্টেশনে এই ট্রেনের রাইট টাইম সকাল ছয়টা হলেও তা সবসময়েই বেশ লেট করতো। তবে এবার তার টাইমিং বেশ ভালো ছিল, মাত্র ১ ঘন্টা লেটে সাতটায় ছাড়লো। আমার টিকিট কাটা ছিল কামাক্ষা জংশনের কারন অফিসিয়াল মিটিং অ্যাটেন্ড করতে আমাকে যেতে হবে আইআইটি গুয়াহাটিতে। তাই গুয়াহাটির পরিবর্তে কামাক্ষায় নামলে তাড়াতাড়ি পৌঁছতে পারবো। যাত্রাপথেও ট্রেন লেট করেনি একদম। কিন্তু সমস্যাটা দেখা দিল গন্তব্যের ঠিক আগে। আগিয়াঠুরি বা অগথোরি স্টেশনে দাঁড়িয়ে পড়লো ট্রেন। সিগন্যাল নেই। ছোট্ট স্টেশন। স্টেশন না বলে হল্ট বলাই ভালো। দূরপাল্লার ট্রেনের স্টপেজ নেই। প্লাটফর্মটাও অত্যন্ত নীচু, নামতে গেলে ট্রেনের সিঁড়ির সাহায্য নিতে হয়। তবে প্রাকৃতিক দৃশ্যে পরিপূর্ণ। উত্তরে দেখা যাচ্ছে কালি পাহাড়। আর বেশ কিছু জলাভূমি। এখানে প্রায় আরও একঘন্টা লেট করে অবশেষে গ্রীন সিগন্যাল পেলো আমাদের ট্রেনটি। আমি কিন্তু সেবার একাই গিয়েছিলাম। কোন বিশেষ কারণে উত্তরবঙ্গে পোস্টেড অপর কলিগ পরেরদিন আসবেন। সেই প্রথম দিনে দিনে ব্রহ্মপুত্র পার হলাম সরাইঘাট ব্রীজ দিয়ে। একপাশে কামাক্ষা পাহাড়ের প্রতিবিম্ব পড়েছে। যদিও রেলব্রীজের রেলিঙের জন্য ছবি তোলা হয়নি। এরপর কামাক্ষায় নেমে ওলা ধরে আইআইটির পথে যেতে দ্বিতীয়বার ব্রহ্মপুত্রকে ক্রস করলাম। সূর্য তখন পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। তার স্বর্ণালী আলো ব্রহ্মপুত্রের জলে গলন্ত সোনা ঢেলে দিয়েছে যেন। চক্রাকারে ঘুরে ওঠা ফ্লাইওভার পড়লো যাত্রাপথে। আমাদের সেদিনের মত থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল আইআইটির কাছেই একটা হোটেলে। দু’দিন পরে গেস্টহাউসে শিফ্ট করার কথা। হোটেলে চেকইন করলাম পাঁচটায়। পূর্বোত্তরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক কলিগ এসে পৌঁছেছে। আমার রূমমেট ছিল মিজোরামের। আমার চেয়ে অনেকটাই বড়। তবে কেন যেন এখানে অনেকেই অনেককে নাম ধরেই ডাকে। আমিও তাই করলাম। কারণ সে দাদা কথাটির অর্থ তো বুঝবেই না, এমনকি হিন্দি ভাইয়াও তার পক্ষে বোঝা অসম্ভব। ইংরাজি তে ব্রো বলা যেতেই পারতো তবে ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগে। আসলে তিনি মিজো ভাষা ব্যতীত শুধু ইংরাজি জানে। দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে পোস্ট গ্রাজুয়েশন করলেও হিন্দি কি করে শিখলেননা সেটাই আমার কাছে আশ্চর্যের। তবে একদিকে ভালোই হল আমার ইংরাজিতে কনভার্সেশনটা ঝালিয়ে নিলাম। এদিকে আমার তখনও বেশ কিছু কাজ বাকি। প্রথমবার মিটিং অ্যাটেন্ডের জন্য আর চরম অনভিজ্ঞতার কারণে কাজগুলো কি করে সম্পন্ন করব, সেটাই বুঝছিলাম না। যাইহোক সে রাতে আমার কোন ল্যাপটপ না থাকায় কিছু করাও হয়নি। আমার সবচেয়ে কাছে যাঁর পোস্টিং, তাঁর সাথে কথা হলো ফোনে। বুঝলাম আগিয়াঠুরি স্টেশনে নেমে গেলেই পারতাম। ওখান থেকে নাকি হাঁটা পথেই আইআইটি। আসলে সবকিছুতেই অভিজ্ঞতার প্রয়োজন। যাইহোক, পরদিন সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার। সকাল থেকেই সূর্যের দেখা নেই। ঘুমও ভাঙলো দেরীতে। তারপর স্লাইডিং জানালা খুলে দেখি সামনেই পাহাড়। ভীষণ ভাবে ন্যাড়া আর রুক্ষ। মাটি ও পাথরে লালের ছোঁয়ায় মনে করিয়ে দেয় এ সবই ছোটনাগপুর ও মেঘালয় মালভূমির সম্প্রসারিত ও বিচ্ছিন্ন অংশ। মার্চ মাসেও শীত শীত করছে বেশ। সকাল সকাল আরও কয়েকজন কলিগ এসে পৌঁছেছেন। এরপর অফিসের গাড়ি ফোর্স ট্রাভেলারে করে পাড়ি দিলাম অফিসের উদ্দেশ্যে। আমি এর আগে গুয়াহাটি এলেও নিজের অফিস দেখলাম সেই প্রথম। অফিসের বসের সহায়তায় একটা ল্যাপটপ পেলাম আমি। বেশ কিছু কাজ এগিয়ে রাখলাম অফিসে বসেই। সেদিন রাতেই সমস্ত কাজ শেষ। আমি যখন কাজ করছি অনেকেই তখন অল্প কাজ, অল্প আড্ডা এই হিসেবে চলছে। কারণ তখনো আরও একদিন হাতে আছে মিটিং শুরুর। এদিকে সেদিন রাত থেকেই ওয়েদার আরও খারাপ হলো। মুষলধারায় বৃষ্টি সাথে ঝড়। আর ফলস্বরূপ রাত থেকেই লোডশেডিং। সকাল থেকে সবার কর্মব্যস্ততা লক্ষ্য করলাম। আমি টুকটাক রিভিশন করে গুটিয়ে রাখলাম কাজ। স্লাইডিং জানালার সামনে চেয়ার নিয়ে বসে উপভোগ করতে লাগলাম বৃষ্টি। ন্যাড়া পাহাড় জলে ভিজে যেন কিছুটা রূপশ্রী পেয়েছে। উস্কোখুস্কো চুলে তেল দিলে যেমনটা দেখায় ঠিক তেমনটা। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে অনেকেই কাজ শেষ করে ফেললেও কিছুজনের মাথায় হাত। কারেন্ট তখনো আসেনি। এদিকে ল্যাপটপের চার্জ তলানিতে। সন্ধ্যে নাগাদ বৃষ্টি কমলো। ম্লান আলোয় দেখলাম সাদা মেঘগুলো পাহাড়ে যেন ধাক্কা খাচ্ছে। অপূর্ব সে ক্ষণ ক্যামেরাবন্দী করলাম। এরপর অন্ধকারে সবাই মিলে আড্ডা। যাঁরা কাজ কম্প্লিট করতে পারেনি তাঁরাও বসকে পরিস্থিতি জানিয়ে অব্যাহতি পেয়েছেন। অবশেষে রাত ১১ টা নাগাদ কারেন্ট এলো। পরদিন আমরা সবাই লাগেজ নিয়ে গেস্টহাউসে শিফ্ট করবো। এরপরের কাহিনী না হয় অন্যদিন বলবো কারণ স্থান, কালের সাথে সাথে ওয়েদার ও চেঞ্জ হতে লাগলো।
(ক্রমশঃ)