আজ অবেলায় কিছু কথা *** রত্না রায়

আজ অবেলায় কিছু কথা

রত্না রায়

শ্রীচরনেষু বাবা,
অনেকদিন বাদে আবার খাতা-কলম টেনে নিয়ে লিখতে বসেছি। জানি, এ লেখাও আমার অন্যসব লেখার মতোই কোনদিনো পোস্ট হবে না। প্রাপকের ঘরে মরচে ধরা সিন্দুকে তালা চাবি বন্ধ হয়েই থেকে যাবে। তবুও মাঝে মাঝে বদ্ধঘরের‌ও শুধুমাত্র নিজের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে শুনতে দমবন্ধ হয়ে আসে। ইচ্ছে করে ওই দূরের ঘুলঘুলিতে যদি একটু আলো আসে। মনের ক্যানভাসে এঁকে যাওয়া জলছবির দাগগুলো যদি একটু ছুঁয়ে নেওয়া যায়। তাতে শান্তি না আসুক একটুতো আরাম হবে। তুমি যে আমার সেই ঘুলঘুলি বাবা। যার কাছে নিশ্চিন্তে জমা রাখা যায় আমার জমিয়ে রাখা নিশ্বাসটুকু।

ছোটপিসি আমায় বলেছিল আমার রূপসী মা আমাকে চায়নি। আসলে মা কোনোদিনই মা হতেই চায়নি। তোমাদের বিয়েটা মায়ের পচ্ছন্দে হয়নি। শুধু মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। পাড়ার ছেলেদের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে বিধবা দিদুন কোনরকমে বিড়াল পার করেছিল। তোমার মত ছোট্ট মুদির দোকানের মালিকের কাছে এ হলো লটারীর ফার্স্ট প্রাইজ জেতা। তাই স্বাভাবিক ভাবেই মায়ের সমস্ত রাগের উৎসস্থল‌ই ছিলে তুমি। তোমার কেন শখ হয়েছিল বামন হয়ে চাঁদকে হাতের মুঠোয় নেওয়ার! এতো কুঁজোর চিত হয়ে শুতে চাওয়ার ইচ্ছের মতো।

নাতির বদলে নাতনি দেখে ঠাকুমাও খুশী হয়নি। তার‌ ওপরে এইরকম ক্যাঙলাপারা মেয়েসন্তান।
বলে উঠেছিল, “এ আবার কি, মানুষের ছা না পাখির ছা!”

অপুষ্টিতে ভোগা রুগ্ন মেয়েটার সেই থেকে নাম পাখি। শুধু তোমার কাছে সে ছিল সোনপরী। তুমি যখন আমাকে সোনপরী বলে ডাকতে, আমার সুন্দরী মায়ের ঠোঁটে একটা বাঁকা হাসি খেলে যেত। অবিকল তোমার মতো কালো, বেঁটে, সবকিছু মুখবুজে মেনে নিয়ে, মুখফুটে কাউকে কিছু না বলতে পারা এক অতি সাধারণ মানুষের নাম পরী! এর চেয়ে আশ্চর্যজনক ঘটনা জগতে আর কিছু আছে নাকি! সত্যি বাবা, পাখি কি করে সোনপরী হয়!

জানিনা তুমি কোনোদিন লক্ষ্য করেছো কিনা, একটা অসন্তুষ্টির কালচে আভা হালকা পাউডারের ছোঁয়ার মতো মায়ের মুখে সবসময়েই লেগে থাকত। শুধুমাত্র মায়ের পিসতুতো দাদা অভীক মামা এলেই মায়ের দেবী প্রতীমার মতো মুখ যেন গর্জনতেলের স্পর্শে ঝিলমিলিয়ে উঠতো। মিথ্যে বলবো না বাবা , মাকে তখন খুব ভালো লাগতো। একদিন তো থাকতে না পেরে, মায়ের আঁচলের তলায় মুখ লুকিয়ে মাকে বলেছিলাম,
“মা অভীক মামাকে এখানেই রেখে দাওনা। ”
মা আমাকে ঠাস করে চড় কষিয়ে বলে উঠেছিল, “পাকা মেয়ে ভাগ এখান থেকে।”
সেদিন আমার দোষটা কি ছিল আমি ঠিক বুঝতে পারিনি।

অভীকমামা এলেই তোমাদের শোবার ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে যেতো। ওদিকে তখন বারণ নামক পাহাড়াদারের নজরদারি।
তুমি কোনোদিন জানতে পারোনি বাবা, কতদিন আমি তোমাকে দেখেছি। একটা হেরো মানুষ মাথা ঝুঁকিয়ে ওই দরজার সামনে থেকে ফিরে যাচ্ছে।

জানো বাবা,তখন আমার চৌদ্দ বছর বয়েস বোধহয়। সেদিন রবিবার, বাড়িতে ঢোকার মুখেই অভীকমামার সাথে ধাক্কা। মামা আমাকে জড়িয়ে ধরে প্রচণ্ড আদর করেছিল। আমার মনে হচ্ছিল সর্বাঙ্গে একটা ঘিনঘিনে জোঁক ঘুরে বেড়াচ্ছে। মায়ের গলার আওয়াজ পেয়ে আমাকে ছেড়ে দিয়ে হঠাৎই বলে উঠেছিল,” বাহ্ সোনালী, আমাদের পাখি সোনা দেখছি বড়ো হয়ে গেল।”
আমি ছুটে বাথরুমে ঢুকে যাই। প্রবল ওয়াক শব্দে তুমি ছুটে এসেছিলে।
তারপর থেকে অভীকমামা এলেই আমি লুকিয়ে পরতাম। হাজার ডাকাডাকিতেও সামনে যেতাম না। আমি জানিনা তুমি কিছু বুঝতে পেরেছিলে কিনা! কিন্তু আমি বুঝতে পারতাম একটা স্নেহঝরা চোখ সেদিনের পর থেকে আমাকে সবসময় আগলে রেখেছে।

কি আশ্চর্য বলতো বাবা, আমরা দুজনে শুধু এক‌ইরকম দেখতেই নয়, আমাদের দুজনের স্বপ্ন‌ও একেবারে এক। সাতসুরে বাঁধা । দুজনেই আমরা গানপাগল। গান গাইতে বসলে তোমার মতোই আমি ও সবকিছু ভুলে যেতাম। সমস্ত না পাওয়া যন্ত্রণা সুর হয়ে ঝরে যেতো। বিখ্যাত সঙ্গীত আ্যাকাডেমিতে আমি গান শিখতে যেতাম। তোমার হাত ধরে বিভিন্ন কম্পিটিশন, রেডিওর অডিশন, বিভিন্ন ফাংশন। নানা জায়গা থেকে পুরস্কার, প্রশংসা। সে বড়ো সোনালী সময়, বড়ো আনন্দের, বড়ো আহ্লাদের।

আমার বড় ননদ‌ও গান ভালবাসে। আমার গান শুনেই মুগ্ধ হয়ে ভাইএর সম্বন্ধটা নিয়ে আসে। অভীকমামার কিরকম যেন চেনাজানা। আমার মতো সাদামাটা মেয়ের জীবনে এতো রূপকথা। ছেলের বয়েসটা একটু বেশি, কিন্তু সরকারি চাকরি, দোতলা বাড়ি, বিবাহিত দুই ননদ, বাড়িতে অসুস্থ শ্বশুর। শ্বাশুড়িহীন সংসারে আমি একেবারে রাজরানী।
উচ্চমাধ্যমিকের টেস্ট হয়ে গেছে। সামনে হায়ার সেকেন্ডারির ফাইনাল পরীক্ষা। এইসময়ে আমার বিয়ের কথায় আপত্তি তুলেছিলে তুমি। কিন্তু অভীকমামার জোরালো স্বর ঘোষণা করে পাত্রের এক দিদি হাই স্কুলের টিচার আর অন্যজন গানের জগতের উঠতি নাম। তারা বাড়ির ব‌উকে লেখাপড়া, গান এসব শেখাবে না, এটা আবার হয় নাকি! আর তাছাড়া কাউকে সোনপরী বলে ডাকলেই তো সে পরী হয়ে যায় না। এই তো কোলাব্যাঙের মতো চেহারা। সময় থাকতে থাকতে বিয়ে দিয়ে দেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ। আর যেখানে পাত্রপক্ষের কোনো দাবীদাওয়া নেই। সেখানে এইরকম পাত্র হাতছাড়া করার মতো বড়ো মূর্খামি আর জগতে হয় না।

তোমার মতামতের তোয়াক্কা না করেই তোমার মেয়ের বিয়ের আয়োজন সব হয়ে গেল। আমার বিয়ে হয়ে গেল বাবা। পরিপাটিভাবে, সুসম্পন্ন।
দুমাসের অন্তঃসত্ত্বা আমি শ্বশুড়বাড়ি থেকেই পরীক্ষাটা দিয়েছিলাম। ফিসফাস কথা ওড়ে বাতাসে, “কপাল বটে পাখি কালিন্দীর, বর একেবারে আঁচলে বাঁধা। একরাত‌ও ব‌উ ছেড়ে থাকতে পারে না। যেদিন তুমি আমাকে একেবারে ছেড়ে গেলে সেদিন‌ও আমাকে ওর সাথে বাড়ি ফিরে আসতে হয়েছিল। সে রাতেও ওর পাশবিক ক্ষিদে মেটাতে আমাকে বিবস্ত্র হতে হয়েছিল।

ঝলমলে আলোর অন্ধকারে হারিয়ে গেল গান, লেখাপড়া, সবটুকু সবুজ। শুধু ধূসর বিকেলের গায়ে লেগে র‌ইলো অসুস্থ শ্বশুরের সেবা, ননদদের সংসারে জোগাড়ের কাজ, আর স্বামীর ফাইফরমায়েস খাটা এক নিদ্রাহীন রাত্রির একঘেয়ে আলাপন।

তবুও আমি বেঁচে র‌ইলাম। আমার সন্তানকে বুকে চেপে, দাঁতে দাঁতকামড়ে। আমার সন্তান, আমার সোনার টুকরো ছেলে, আমার সুখ, আমার আনন্দ, আমার একটুকরো পৃথিবী। লোকে বলে আমি রত্নগর্ভা। চোখ ধাঁধানো রেজাল্টের জোরে আজ চারবছর আমার থেকে অনেক দূরে সাত সাগরের পাড়ে। প্রথম প্রথম প্রতিদিন দুবার করে ফোন। তারপর সপ্তাহে একটা , এখন মাসে একটা।
শুধুই আমি ভালো আছি মা।
না, না বাবা ওর কোনো দোষ নেই। আমায় ও এখনও সেই আগের মতোই ভালবাসে। আসলে কেরিয়ার নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। অন্যদিকে মন দেওয়ার মতো সময়েই নেই। এই দ্যাখো না, আজকে ওর জন্মদিন। আমি সকালবেলায় ওকে টেক্সট করেছিলাম। ও কোনো রিপ্লাই দেয়নি। তারপরে একটু বেলায় ওকে ফোন করলাম। ও তখন জন্মদিন সেলিব্রেশন করবে বলে বন্ধুদের সাথে বাইরে কোথাও খেতে যাচ্ছিল। আমার সাথে কথা বলার সময় পায়নি তখন। ফিরে এসে ফোন করবে বলেছে। আমিও ওকে আর বিব্রত করতে চাইনি। সেই আগের মতো আমার কথা ওকে বলতে পারিনি। বলতেই পারিনি ক’দিন ধরে আমার জ্বরের কথা, আমার প্রবল শ্বাসকষ্টের কথা। কি হবে বলো ওকে বলে? এতোদূর থেকে ওতো কোনো সমাধান দিতে পারবে না। শুধু শুধু আজকের দিনের আনন্দটা নষ্ট হবে।
শুধু ওকে কেন! আজ তিরিশ বছর সংসার করেও ওর বাবাকেও কি বলতে পেরেছি আমার কষ্টের কথা, আমার অসুস্থতার কথা! বরফের প্রাচীরের দুদিকে আমরা দুজন দাঁড়িয়ে আছি, সেই প্রথমদিনটার মতোই আজ‌ও অচেনা অজানা অপরিচিত দুজন মানুষ।

চারদিকে বড়ো অন্ধকার বাবা, বড়ো কষ্ট, সমস্ত শরীর জুড়ে ভয়ানক ক্লান্তি। কোথাও একবিন্দু বাতাস নেই। গুমোট গরমে দমবন্ধ হয়ে আসছে। একটু ঘুমতে চাই বাবা, একটু বিশ্রাম। সেই ছোটবেলায় আমার জ্বর হলে তুমি যেমন সারারাত আমার পাশে জেগে বসে থাকতে। আমার মাথায় তোমার ঠান্ডা হাতটা রাখতে। আমার সমস্ত অসুখ, সমস্ত কষ্ট, সমস্ত দুঃখ নিমেষে কোথায় যেন মিলিয়ে যেতো। আর একবার রাখবে বাবা, আমার কপালে তোমার হাতটা আজ,। আমি তোমার সেই ছোট্ট মেয়েটা হয়ে যাবো, আর একবার। তোমার সেই ছোট্ট সোনপরী।
তোমার পরীমা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *