মাঝরাতের অতিথি ****** তপতী সাহা
মাঝরাতের অতিথি
তপতী সাহা
বাইরে তুমুল ঝড়বৃষ্টি হয়ে চলেছে। এখন প্রায় মাঝরাত। সাম্যময় টেবিল ল্যাম্পের আলোতে একমনে লিখে চলেছে। লেখার জন্য এই সময়টা
তার বড়ো পছন্দের, ছোটবেলা থেকেই তার দিনের বেলায় সেরম পড়াশোনা হতো না। রাত্রিবেলায় সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়তো, চারিদিকে নিস্তব্ধ, সেই সময়ে সে বইখাতা খুলে পড়তে বসতো।
কিন্তু আজ তার লেখা একদমই এগোচ্ছে না।
“নাঃ, একদম ভালো হচ্ছে না!” এই বলে মাঝে মাঝেই বিরক্তি সহকারে খাতার পাতা ছিড়ে গোল্লা গোল্লা করে টেবিলের পাশে ফেলছিল সাম্যময়। রাত যত বাড়ছে, ছেঁড়া কাগজের গোল্লার স্তুপটাও উঁচু হয়ে উঠছে।
“হবে না, হবে না।”
নির্জন রাতে এরকম একটা গমগমে কন্ঠস্বরে সাম্যময় চমকে পেছন ফিরে তাকাল।
“কে?” আশপাশটায় কাউকে দেখতে না পেয়ে আবার লেখায় মন দেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার আজ কিছুতেই মন বসাতে পারছে না!
“শুধু ঘরের মধ্যে বসে কি সাহিত্যচর্চা হয়? এক আধটু বাইরে বের হও। চারিদিকে এতো বিপদ, মহামারী, দুর্যোগ; তোমরা নিশ্চিন্তে ঘরে বসে থাকো কী করে!”
সাম্যময় এবারে দেখতে পেল সামনে দাঁড়িয়ে আছেন সাদা আলখাল্লা পরা একজন সৌম্যকান্তি পুরুষ। যার বুক অব্দি সাদা দাড়ি, মাথার সাদা সাদা চুলগুলো কাঁধ ছেয়ে গেছে। যেন একটা আলোর বলয়ের মধ্যে আবছায়া এক প্রশান্ত মূর্তি। সে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকল।
মূর্তিটি আবার বলে উঠল,” আমরা বাপু এরকম ছিলাম না। কারও বিপদ দেখলে তো স্থির থাকতে পারতাম না, একটু হলেও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতাম।”
সাম্যময় বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। খানিকক্ষণ মুখে কোনো কথা সরল না। বিস্ময়ের ঘোরটা কাটতেই কিছু একটা বলতে গিয়ে দেখল, কেউ কোথাও নেই। সে উঠে ভালো করে চারপাশটা দেখে নিল। নাঃ, কেউ কোথাও নেই তো! এ হয়তো মনের ভুল। ভাবতে ভাবতে তার মাথাটা একেবারে গেছে। রাত জেগে লেখাপড়া করার অভ্যেস তো আজ নয়। ভয়টা তার বরাবরই কম।
সে আবার এসে বসল, লেখাটা আজ শেষ করতেই হবে। কালই জমা দিতে হবে।
একটা খুট খুট শব্দে আবার মনসংযোগ নষ্ট হলো। এবার পেছন ফিরে সে দেখল,একজন রোগাপটকা চেহারার লোক। পরনে সাধারণ জামাকাপড়, কাঁধে আধময়লা একটি গামছা, ফ্যাকাশে মুখমন্ডলে তার মোটা গোঁফ জোড়াটি বড্ড বেমামান লাগছে। ভালো করে তার দিকে চাইতেই সাম্যময় দেখল সে মিটমিট করে হাসছে।
“বাবু মনে হচ্ছে খুব ফাঁপরে পড়েছেন।”
সাম্যময় সে কথার উত্তর না দিয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,”তুমি কে! আর এখানেই বা কী করছো?”
“আমি একজন হতভাগ্য বাবা হুজুর। মেয়েটা পা ভেঙে পড়ে আছে, চিকিৎসার টাকা যোগাড় করতে পারিনি।” একটু থেমে সে আবার বলল, “কোন অসুবিধেই হতো না জানেন, যদি ব্যবসাটা ভালো চলতো।”
“কেন ? কিসের ব্যবসা তোমার?”
“আমি ফুচকা বিক্রি করতাম। প্রতিদিন যা বিক্রি হতো তাতে আমাদের কষ্টেশিষ্টে চলে যেত। কিন্তু এখন লোকজন সেরকম বের হয়না। কী এক রোগ এসেছে যে বাইরের খাবার খেতেই ভয় পাচ্ছে। বিক্রি বাটা কমে গেছে,তাই আমাদের ব্যবসাও লাটে উঠেছে। অন্য কাজ তো কিছুই জানিনা। বাপ ঠাকুরদার আমল থেকে এই ব্যবসাই চলে আসছে।
মেয়ের চিকিৎসার খরচ যোগাড় করতে এই ঝড় জলের রাতে পথে বের হয়েছি।”
“ফুচকা!” এই বলে সাম্যময় একটু নড়েচড়ে বসল।
” ফুচকার কথা শুনে তো জিভে জল চলে এলো। তা তুমি কী কী ফুচকা বানাতে পার শুনি?”
“সে আর বলতে, দই ফুচকা, চাটনি ফুচকা,জেলি ফুচকা, জল ফুচকা, চুরমুর মাখা…আরও কত কী! আমি আর আমার বৌ দিপালী দুজন মিলে দিয়ে কুল করতে পারতাম না। এত ভিড় হতো, সবাই যে পাল্লা দিয়ে খেত! সে এক দিন গেছে। ওই ফুচকা বিক্রি করতে করতেই তো দিপালীর সঙ্গে পেরেম..”
“হুম, সে তো হলো। এখন বলো আমি কী সাহায্য করতে পারি?”
“কিছু টাকা পেলে মেয়েটার চিকিৎসা শুরু করতে পারতাম। আপনাকে না হয় ভালো করে একদিন ফুচকা খাইয়ে দেবো।”
“আমার কাছে তো বেশি টাকা নেই। দেখো এতে যদি কাজ হয়। না হলে পরে দেখা যাবে। তোমার নাম, ঠিকানা বলে যাও…”
“আমার নাম মধু, আপনাদের পাশের পাড়াতেই থাকি। ওই মোড়ের মাথায় যে পাকুড়গাছটা আছে, ওখানে গিয়ে ফুচকাওয়ালা মধু বললেই সবাই দেখিয়ে দেবে। আপনি যখন আমার এতো উপকার করলেন তখন ফুচকা না খাইয়ে তো ছাড়ছি না। হে হে…এখন চলুন।”
“তুমি কি পাগল হলে! এত রাতে কেউ ফুচকা খায়, তাছাড়া যা দিনকাল চলছে এখন বাইরের খাবার খাওয়া উচিত নয়।”
“কিছু হবে না বাবু, আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলছি।”
“সে না হয় হলো, সব উপকরণ পাবে কোথায়? এই যে বললে অনেক দিন হলো কোনো বিক্রি বাটা নেই।”
“ও আপনি ভাববেন না, সব ব্যবস্থা হয়ে আছে। এখন আপনি গেলেই হয়।”
মধু একেবারে নাছোড়বান্দা। ফুচকা খাওয়ার লোভও সাম্যময় উপেক্ষা করতে পারল না। যেন কোন অমোঘ টানে মধুর পিছু পিছু সে হেঁটে চলল।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে খানিকটা দূরে গিয়ে দেখলো সুন্দর সাজানো গোছানো ফুচকার ভ্রাম্যমাণ দোকান। মধু গিয়ে দাড়াতেই আরও কয়েকজন ঢ্যাঙা মতোন লোক ফুচকা খাওয়ার জন্য এসে দাঁড়ালো।
“এই তোরা এখন যা। এই বাবুকে আগে ভালো করে ফুচকা খাওয়াই। তোরা পরে আসিস।”
সাম্যময় তো ব্যবস্থাপনা দেখে খুব খুশি। বলল,
“তা কী ফুচকা খাওয়াবে আমাকে?”
“সবরকমই খান না।”
মধু এক এক করে ফুচকা হাতে তুলে দেয়, খেতে খেতে সাম্যময়ের চোখ বুজে আসে।
“আঃ, কী সুন্দর স্বাদ! কতদিন এইরকম ফুচকা খাই নি!”
সকাল বেলায় মায়ের ডাকে সাম্যময়ের ঘুম ভাঙে। “কী রে, তুই লিখতে লিখতে এখানেই ঘুমিয়ে পড়েছিলি? বিছানায় ঘুমোসনি?”
সাম্যময় চোখ মেলে দেখল, চারিদিকে রোদ উঠে ঝলমল করছে। অনেক বেলা হয়ে গেছে। ঘুম থেকে উঠে সে মনে করার চেষ্টা করল কাল রাতে কী ঘটেছে। আবছা আবছা মনে পড়লেও ভালো করে খেয়াল হলো না। খাতার দিকে চোখ পড়তেই অবাক হয়ে গেল। লেখাগুলো জ্বলজ্বল করছে! পৃষ্ঠা উল্টিয়ে দেখে গল্পটা লেখা শেষ হয়ে গেছে। কখন লিখল সে! প্রথম থেকে শেষ অব্দি এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলল। নিজের লেখায় নিজেই মুগ্ধ হয়ে গেল। এতো সুন্দর লেখা তার কলম দিয়ে বেরিয়েছে! কিন্তু… তাহলে কি লেখা শেষ করার পর ঘুমিয়ে পড়েছিলো! ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কি স্বপ্ন দেখেছে! মুখে হাত দিয়ে দেখল এঁঠো লেগে রয়েছে। ফুচকার স্বাদ এখনও তার জিভে লেগে রয়েছে। মধুর কথা মনে পড়ল। তড়িঘড়ি করে টেবিলের ড্রয়ার খুলে দেখল সেখানে রাখা টাকাগুলোও নেই।
এ তো স্বপ্ন নয়! তাহলে সে সত্যিই এসেছিল। তার সঙ্গে ফুচকা খেতেও সে গিয়েছে। তাহলে লিখল কখন! ভারি অদ্ভুত তো! কোনো কিছুই ঠিকঠাক মেলাতে পারল না। ওহ্ , ভাবতে ভাবতে কি এবার মাথাটা খারাপ হয়ে যাবে! অবশ্য রাতের সবকথা সকালে সবসময় মনেও আসে না। ধ্যুর,তার অতো ভাবার দরকার কি? লেখা যখন হয়েই গেছে আর দেরি করার কোনো মানে হয় না। পরে সেসব ভাবা যাবেখন। দ্রুত টাইপ করে ইমেলে সে লেখাটা পাঠিয়ে দিল।
এরমধ্যে দুদিন কেটে গেছে। লেখাটির কথা সে ভুলেই গেছিলো। এর আগে কতো লেখাই তো বিভিন্ন সময়ে পাঠিয়েছে। কাজের কাজ কিছু হয়নি। তাই ভেবেছিলো এবারেও… কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে তিনদিনের মাথায় মেসেজ এল আপনার লেখাটি মনোনীত হয়েছে। সাম্যময় খুশিতে পাগল হয়ে গেল। জানিনা কেন তার মনে হলো এর জন্য মধুর প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত। সে সত্যিই পয়া। সব মনে হতেই মধুর খোঁজে সে বেরিয়ে পড়ল। আজ যা মন চায় সে করবে। বাকি টাকাটাও দিতে হবে।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছুদূর যাওয়ার পর মোড়ের মাথায় একজনকে দেখে সে মধুর কথা জিজ্ঞেস করল।
” মধু মানে সেই? যে ফুচকা বিক্রি করত তার কথা বলছেন তো! কিন্তু সে তো…! বলেই লোকটা থেমে গেল।
“আপনি কি কিছু বলছেন?”
” না কিছু না, যান আপনি। গেলেই তো দেখতে পাবেন। ঐ যে দেখতে পাচ্ছেন সামনে গলি। ঐ গলির ভেতর ঢুকে সোজা চলে যান।” এই বলে লোকটি আর কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ না দিয়ে হনহন করে চলে গেলেন। সেদিকে তাকিয়ে সে বলল,”অদ্ভুত তো!”
সাম্যময় আরও কয়েকজনের সহায়তায় সেই বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলো। দেখলো সেখানে অনেক লোকজন। চারিদিকে যেন একটা শোকের আবহাওয়া, একটি বৌ অনবরত কেঁদে চলেছে। কোলে তার একটা বাচ্চা মেয়ে, পায়ে প্লাস্টার।তাকে জড়িয়ে কান্না যেন তার কিছুতেই থামছে না।
উঠোনের একদিকে কার যেন অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া চলছে।
সাম্যময়কে দেখে একজন এগিয়ে এলেন।
” কাউকে খুঁজছেন?
” এটা মধুর বাড়ি তো? ফুচকা বিক্রি করতো…”
“হ্যাঁ, আমি মধুর দাদা। কিছু বলবেন?”
সাম্যময় সব বলতেই সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,” আপনার সঙ্গে কবে মধুর দেখা হয়েছে বললেন?”
“কেন এই তো তিনদিন আগে। আজ তো শুক্রবার, গত মঙ্গলবার সে আমার বাড়ি গিয়েছিল। তখন প্রায় মাঝরাত, অনেক কথা হলো। মেয়ের চিকিৎসার কথা বলতে আমি কিছু টাকা দিলাম। বলেছিলাম, আমার কাছে তো আর নেই পরে দেব। আজকে এই যে আরও কিছু নিয়ে এসেছি।”
“আপনি দেবতুল্য মানুষ। না হলে কেউ বাড়ি বয়ে টাকা দিতে আসে!” লোকটা হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিল বটে, কিন্তু সেই সঙ্গে অবাক হয়ে বলল,” কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা। তা কী করে সম্ভব! সেদিন তো… মধু সেদিন সবকিছু নিয়ে বেরিয়েছিল বটে, কিন্তু আর ফিরে আসতে পারেনি। সেদিনের প্রচণ্ড ঝড় জলে গাছ উপড়ে পড়ে সে মারা যায়। আমরাই খবর পেয়েছি দশটা এগারোটার মধ্যে। অবশ্য তারও পরে এসে একজন টাকাগুলো দিয়ে যায়। কিন্তু তাকে আমরা চিনিনা। বলেছিল, মেয়ের চিকিৎসার জন্য মধু দিতে বলেছে। আপনার হয়তো কোথাও ভুল হচ্ছে।অপঘাতে মৃত্যু! তাই তিনদিনেই কাজ সারছি।”
সাম্যময় আর কিছু বলল না। ভুল! তাইবা কী করে হয়। তাহলে সেদিন অতোক্ষণ কার সাথে গল্প করল? ফুচকাই বা কে খাওয়ালো! আর ঐ ঢ্যাঙা লোকগুলো! তারাই বা কে?
নাহ্, মাথায় কোনো কাজ করছে না। সে কি পাগল হয়ে যাচ্ছে! হঠাৎ শ্রাদ্ধবাসরে ফুলের মালা দেওয়া ছবির দিকে চোখ পড়তেই, আরে এ তো সেই লোক। সেইদিনের মতোই আজও মধু মিটমিট করে হাসছে। “বাবু কী আবার ফাঁপড়ে পড়লেন?”
চমকে উঠলো সাম্যময়। এত লোকের মাঝেও শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। তার জীবনে এরকম অভিজ্ঞতা আগে কখনও হয়নি। কাউকে বললে কেউই হয়তো বিশ্বাস করবে না।
সে ভারি আশ্চর্য হয়ে গেল, মৃত্যুর পরেও মধুর মেয়ের চিকিৎসার জন্য চিন্তা ছিল। এমনকি টাকাটা পাঠানোর ব্যবস্থাও সে করে গেছে! মধুর পরিবারের জন্য সত্যিই খুব খারাপ লাগছে। এটুকু সাহায্য করতে পেরে সাম্যময়ের মন প্রশান্তিতে ভরে গেল। মধুর আত্মার শান্তি কামনা করে সে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ধীরে ধীরে বাড়ির পথে রওনা দিল।
*সমাপ্ত*