দেবজিতের ডায়রি ‘যুদ্ধ’

দেবজিতের ডায়রি
‘যুদ্ধ’

মিডল বার্থের লোকটা কামরূপ এক্সপ্রেসে লাম্বডিং স্টেশন থেকে উঠেছিল I সঙ্গে একটা ভি আই পি এটাচি আর ত্রিপলের একটা ব্যাগ I লোকটা সাত সকালে উঠেই ব্যাগ থেকে সেভিং কিট বার করে বাথরুমে গিয়ে সেভিং ব্রাশ করে এসে সিটের নীচে ব্যাগে কিট রেখে উশখুশ করতে করতে বার্থের সবার ঘুম ভাঙিয়ে দিল I উপরের বার্থে থাকার কারণে আমি তখনও শুয়ে রইলাম I ট্রেন কিছুক্ষণের মধ্যেই গৌহাটি ঢুকবে I মিডল বার্থের একজন তো বিরক্তির সুরে বলেই ফেললো ‘আরে দাদা আপনার ঘুম নেই বলে কী কেউ ঘুমাতে পারবেনা !’ লোকটি হতভম্ব হয়ে কথাটা শুনে কোনো উত্তর না দিয়েই শান্ত হয়ে বসে রইলো I উপর বার্থ থেকে শুয়ে শুয়ে নীচের দিকে মুখ বাড়িয়ে দেখলাম প্রায় পঞ্চাশোর্ধ একজন লোক ত্রিভঙ্গ মুরারীর মত নীচের সিটের এক কোনায় বসে রয়েছে I নীচের লোকটি তখনও শুয়ে থাকার কারণে ওনার মিডল বার্থ এখনও নিচে নামানো হয়নি I সেই কারণেই লোকটি কোনরকমে নীচের বার্থের এক কোনায় শুয়ে থাকা লোকটির পায়ের কাছে বসে রয়েছেন I

কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন গৌহাটি ঢুকলো I বাইরের আকাশে আলোর মেলা I প্ল্যাটফর্মে হকাররা হাঁক দিচ্ছে I বাধ্য হয়েই উপর থেকে জিমন্যাস্টদের মত লাফিয়ে নেমে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে উদ্দ্যেশ্যহীন ভাবেই মুখ বাড়িয়ে স্টেশন দেখে বেসিনে মুখে চোখে জল দিয়ে এসে দেখলাম ততক্ষণে নীচের বার্থের লোকেরা উঠে বসেছে I মিডল বার্থ নীচে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে I লোকটি হকারদের কাছ থেকে চা কিনে জামার ভেতর বুকের কাছ থেকে একটা সবুজ রঙের বটুয়া বার করে হকারকে চায়ের পয়সা মেটাচ্ছেন I বটুয়াটি গলায় ঝোলানো I বটুয়ার সবুজ রঙ আর চুলের ছাঁট দেখে বুঝতে অসুবিধা হলনা যে , লোকটি ফৌজি I ফৌজি ভাই হয়তো ছুটি যাচ্ছে I মাথার চুলে ভালোরকমের সাদা রঙ ছড়িয়ে গিয়েছে I

গৌহাটি স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়তেই লোকটির সাথে পরিচয় হলো I সুবেদার জগদীশ প্রসাদ I ছুটি নয় , কর্মসূত্রে উনি কোলকাতা যাবেন I পোস্টিং মিজোরামে I কিছুক্ষণের মধ্যেই লোকটির সাথে এক কথা দু কথা হতে হতে লোকটি জানালেন উনি পেনশনের কাগজ তৈরী করতে যাচ্ছেন কলকাতা ইস্টার্ন জোনের হেড কোয়ার্টারে I ফোর্সে জয়েন করেছেন ঊনিশ শ’ সত্তর সালে I এত বয়েসেও এখনো শরীরের কাঠামোয় কোনো রকমের শিথিলতা নেই I গলার আওয়াজও বেশ দরাজ I

ট্রেন ব্রহ্মপুত্র নদীর শঙ্করাচার্য ব্রিজ পেরিয়ে আমিনগাঁও স্টেশন পার করে ফেলেছে I জানালার বাইরে সবুজ ধানের ক্ষেত আর দিগন্তে আবছা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ের সারি I ফুরফুরে হাওয়া আর ট্রেনের দোলুনিতে চনমনে হয়ে লোকটিকে প্রশ্ন করলাম ‘এত বছর ফৌজে জীবন কাটিয়ে ঘর যেতে কেমন লাগছে আপনার !’
লোকটি মৃদু হেসে চুপ করে রইলেন I মুখের ভঙ্গিমা দেখে বুঝতে পারলাম একটা বেদনার রেশ ওনার চোখে মুখে I খানিক নীরব থেকে বলে উঠলেন , ‘চল্লিশ বছর ধরে যে ঘরটাতে জীবন কাটালাম সেই ঘরটা ছেড়ে যেতে কষ্ট তো হবেই স্যার I’
স্যার সম্বোধন করাতে লোকটির সরলতা চোখে মুখে ফুটে উঠলো I কৌতুহলী হয়ে সাংবাদিকের মত জিজ্ঞেস করলাম , ‘কী অভিজ্ঞতা নিয়ে যাচ্ছেন !’
নড়ে চড়ে বসে উত্তর দিলেন , ‘ব্যাস বেশ কয়েকটা মেডেল আর ভীষণ ভয়ানক কিছু স্মৃতি বুকের মধ্যে জমা রইলো !’ কথাটা বলেই চোখের দিকে তাকালেন উনি I এবার আর শহুরে বুদ্ধিমানের মত প্রশ্ন না করে সহজভাবেই বললাম , ‘ভীষণ ভয়ানক স্মৃতি ! অসুবিধা না থাকলে বলুন না !’

জানালার বাইরের দিকে তাকালেন I পেছনের দিকে হেলান দিয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন , ‘সত্তর সালে ট্রেনিং করে গোয়ালিওরে পোস্টিং হলাম I কিছুদিনের মধ্যেই ভারত পাক যুদ্ধ বাধলো I যুদ্ধের কথা কী আর শব্দে বলা যায় ! তারপরে এতগুলো বছর কাশ্মির থেকে শুরু করে বহু জায়গায় কাটিয়ে দিলাম I নর্থ ইস্টে এগারো বছর I’ আশেপাশের যাত্রীরাও ততক্ষণে ওনার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে শুরু করেছে I
সব থেকে বেশি বিরক্ত হয়েছিল যে লোকটি তিনি জিজ্ঞেস করলেন , ‘মিজোরাম তো অনেক সাংঘাতিক জায়গা I ওখানে থাকা তো বড় মুস্কিল ব্যাপার !’
সুবেদার জগদীশ ওনার দিকে তাকিয়ে বেশ উত্সাহী হয়ে উত্তর দিলেন , ‘সে তো হবেই স্যার I এখন তো আইজলে আছি I তেমন কোনো অসুবিধা হয়না I কিন্তু ঊনিশ শ’ বিরাশি সালে যখন ছিলাম তখন মিজোরাম জ্বলছে I তখন যেখানে থাকতাম সেখান থেকে ছুটি যাওয়া আসাটাই তো মহাভারত I ছুটি যেতে হলে নব্বই কিলোমিটার পথ পায়ে হাঁটতে হতো !’
প্রশ্নকর্তা চমকে উঠে বলে উঠলেন ‘নব্বই কিলোমিটার !’
সুবেদার জগদীশের চোখে মুখে উত্তেজনা ছড়িয়ে গেল I উত্তরে বললেন , ‘হ্যাঁ স্যার ! নব্বই কিলোমিটার হাঁটতে হতো ! আমাদের কোম্পানি ছিল খুরলিয়ং I সেখান থেকে পঁচিশ কিলোমিটার হেঁটে বিকেলে পৌঁছাতাম সামফুলন ক্যাম্পে I পরের দিন ভোরে সামফুলন থেকে হাঁটা শুরু হতো I কুড়ি কিলোমিটার হেঁটে পৌঁছাতাম ফুলন ক্যাম্পে I সেখানে পৌঁছে পরের দিনে আর যাওয়া হতো না I একদিন থাকতে হতো I কারণ তার পরের যাত্রা ছিল সব থেকে কঠিন I একদিন থেকে পরের দিনে রওনা দিতাম সেতওয়াল এর উদ্দ্যেশ্যে I স্যার ফুলন থেকে সেতওয়াল পাক্কা চল্লিশ কিলোমিটার I মাঝে কারো কোনো ক্যাম্প না থাকার কারণে রাত্রে কোনো জায়গায় হল্ট করতে হতো I পরের দিনে আবার হাঁটা শুরু হতো I সেদিনেও সেতওয়ালে পৌঁছাতে পারতাম না I রাত্রে হল্ট I পরের দিনে দুপুর নাগাদ পৌঁছাতাম সেতওয়াল ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার I সেখান থেকে কনভয়ে আইজল I আইজলে অস্ত্র জমা করে ছুটির লিভ সার্টিফিকেট নিয়ে বাড়ি যাওয়া হতো I ’

এতক্ষণ পর্যন্ত বলেও সুবেদার জগদীশ শান্ত হলেন না I আবার শুরু করলেন , ‘স্যার ছুটি আসতেই গায়ে জ্বর আসতো I বিশেষ জরুরি না হলে সবাই বছরে একবারই দুই মাসের ছুটি যেত I শুধুই কী তাই স্যার ! ঘরে কিছু হয়ে গেলেও যাওয়ার উপায় ছিল না I বেশিরভাগ সময়েই ঘরে কেউ মারা গেলে সময়ে জানতেই পারতাম না I টেলিগ্রাম আসতো আর্মির APO-56* এর মাধ্যমে I এতটা রাস্তার জন্য এক আধ জন তো আর যাওয়া আসা করতে পারত না I তাই সঙ্গে সঙ্গে ছুটি যাওয়াও সম্ভব হতো না I অপেক্ষা করতে হতো I বেশ কয়েকজন একসাথে না হলে যাওয়া আসা করা যেত না I মাসে এক থেকে দুইবার পার্টি আসা যাওয়া করতো I ওদের হাতেই চিঠির লেনদেন I শরীরে এত ক্লান্তি থাকতো যে ছুটি যাওয়ার সময়ে বহু ফৌজিকে ট্রেনে খাবারের সাথে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে সব জিনিসপত্র চুরি করে নিত I আমরা ছুটি যাওয়ার সময়েও একসাথেই থাকতাম I চুরির হাত থেকে বাঁচতে ট্রেনে সেন্ট্রি ডিউটি করতে করতে যেতে হতো I ’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে সুবেদার জগদীশ বলে উঠলেন , ‘স্যার ট্রেন এবার রঙ্গিয়া স্টেশন ঢুকছে ! চলুন কিছু খাওয়া যাক !’ কথাটা বলেই সিটের নীচ থেকে ত্রিপলের ব্যাগ থেকে তিন তলা স্টিলের টিফিন বক্স বার করে খুললেন I আলু সয়াবিনের তরকারী আর পরঠা বার করে আমাদের দিকে বাড়িয়ে দিলেন I

সুবেদার জগদীশের জীবনের গল্প শুনতে শুনতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলাম I এমন জীবন যে কেমন সেটা গ্রাম শহরে থাকা মানুষেরা জানতে পারেনা I এদের মধ্যেও সদ্য বিয়ে করে ফেরা লোকেরাও থাকতো ! মাসে এক আধবার চিঠির লেনদেনেই প্রেমালাপ চলতো I কারো প্রিয়জনের বিয়োগের খবরও সময়ে পেতো না I এমন জীবনের মুখোমুখি করে এরা হয়তো সিদ্ধ পুরুষ হয়ে উঠেছে I আমরা যারা ফৌজি মানেই লড়াই আর যুদ্ধ করতে থাকা বর্দীধারী সৈনিক বুঝি তারা হয়তো বুঝতেই পারিনা জীবনে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করার বাইরেও এমন জীবন কাটানোটা কোনো যুদ্ধের থেকে কম নয় !

খোয়াথং …মনিপুর …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *