❤️ পোলিশ তরুনীর প্রতি পত্র 💙 সায়ন্তন

❤️ পোলিশ তরুনীর প্রতি পত্র 💙

সায়ন্তন

❤️প্রিয়,
মারিয়া ম্যাগডালেনা,

তুমি আমাকে চিনবে না, আবার আমারও তোমার সাথে পরিচয় নেই তবু দেখা হয়ে গেল। জানো আমার বাবার পছন্দের দেশ জাপান। আমার পছন্দের দেশ তোমার প্রতিবেশী জার্মানী। কিন্তু আমার মায়ের প্রিয় দেশ? আমরা সমাজে মায়েদের কথা তেমন ভাবিনা। এটা আমাদের কোন দোষ না, এটা সমাজের দোষ। তাঁরাও যে তাঁদের পছন্দের কথা মুখ ফুটে বলেনা। তখন ছোট ছিলাম, মা কে জিজ্ঞেস করলাম তাঁর পছন্দের দেশের কথা। মা বলল পোল্যান্ড তাঁর পছন্দের দেশ। পোল্যান্ড বা পোলস্কা কি আদুরে নাম না? তাই ফুটবল খেলায় কখনো লাল সাদা জার্সির এই দেশটাকে দেখলে মাকে দেখাতাম আর বলতাম, “এই দেখো তোমার প্রিয় দেশ।” কিছুদিন আগে অন্য দেশ নিয়ে লেখায় একজন বেশ প্রতিবাদ করে উঠলো। বলল তার নিজের দেশই সবচেয়ে প্রিয়। অথচ জানো আমিও আমার দেশকে কম ভালোবাসিনা। আমার দেশের জাতীয় সংগীত গাইতে গেলে, জাতীয় পতাকাকে উড়তে দেখলে আমারও চোখে জল আসে, গায়ে কাঁটা দেয়। এখনও বৃটিশ শাসনের দিনগুলি মনে করলে বা ইতিহাসে সে বর্ণনা পড়তে গেলে ভীষণ রাগ হয়, আবার তাদের বিরুদ্ধে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সাফল্যে চোখে আনন্দাশ্রু বয়। কিন্তু সৌন্দর্য্যের প্রশংসা করতে তো বাঁধা নেই। আমার দেশের ছোট গন্ডীতে আটকে না থেকে আমার পৃথিবী ভাবতেই তো বেশী ভালো লাগার কথা বলো? কাল দরকারী কিছু কাজ সেরে অনেকটা অবসর ছিলো। কিছু করার নেই তাই টিভি খুললাম। এর আগে সেই ২০০৪ এথেন্স অলিম্পিকের কিছু খেলা দেখেছি, তারপর আর তেমনভাবে অলিম্পিক দেখা হতনা। হকিতে ভারতের দুর্দিন চলছিল, অলিম্পিকে ভারত মানেই শ্যুটিং, তিরন্দাজী, ভারোত্তলন, কুস্তি, বক্সিং আর অবশ্যই লিয়েন্ডার পেজ, শরথ কমল, মেরি কম। খবরের কাগজের খেলার পাতায় চোখ রেখে পড়তাম অতি আগ্রহে। ভারত যে খেলায় নেই সে খেলা তেমন দেখাও হত না। এবার অতিমারিকে জয় করে জাপান আয়োজন করেছে “দি গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ”। কাল ছিল হিরোসিমা দিবস, এ এক সমাপতন হয়তো। ইভেন্টের সূচনায় টিভি স্ক্রিনে মাউন্ট ফুজিয়ামা। দর্শকশূণ্য ইভেন্ট গুলিতে এক মায়াবি সংগীতের আবহ। এতবার হ্যান্ড স্যানিটাইজের ফলে ঘরে সন্তুর হ্যান্ড ওয়াশের সুগন্ধটা ভরে রয়েছে। অপূর্ব সেই ক্ষণে লাল সাদা জার্সিতে কালো কোমরবন্ধনী ও হাতে জ্যাভলিন নিয়ে তোমার প্রবেশ। আর আমার মন জিতে, রূপো জিতে প্রস্থান তোমার। যখন তোমাকে টিভির পর্দায় প্রথম দেখি, তখনই মনে হয়েছিল তুমি কোন না কোন পদক জিতবেই। তখনও তো কোন স্ট্যাটিস্টিক্সই জানিনা। আসলে ক্রিকেট সর্বস্ব দেশের নাগরিক হয়ে এই খেলাগুলোর খবরই রাখা হয়না যে। আমি জানি এটা আমার খুবই অন্যায়। যাক কাল তোমাকে দেখে আগ্রহ পেলাম। একটু এই ইভেন্ট সম্পর্কে জানতে গিয়ে পেলাম আমাদের দেশের নীরজ চোপড়ার নাম। তিনিও জ্যাভলিন থ্রো তে দেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন। আজ তাঁর খেলা দেখবো, রইলো শুভকামনা। আবার আসি তোমার কথায়। কোথায় বাড়ি তোমার রৌপ্য কণ্যা ? পোলস্কার কোন অপরূপ স্থানে তোমার বাড়ি? সুয়ালকি তে ? রাজধানী ওয়ারশ থেকে সুদূর উত্তর-পূর্বে পোডলস্কি রাজ্যের সুয়ালকি কাউন্টি। লিথুয়ানিয়া সীমান্তের সেই শহরে তোমার বড় হয়ে ওঠা। হয়তো সেখানকার কোন মখমলের মত বিস্তীর্ণ মাঠে চলতো তোমার জ্যাভলিন প্রশিক্ষণ। তোমার দেশে এই অঞ্চলটায় তুষারযুগের হিমবাহের ক্ষয়কার্যে সৃষ্ট ভূমিরূপ দেখা যায়। ফিনল্যান্ডের মত সহস্র হ্রদের দেশ মাসুরিয়ান লেক ডিস্ট্রিক্ট। প্রায় ২০০০ টি হ্রদ রয়েছে এখানে। সেভাবে কোন নদী না থাকায় অষ্টাদশ শতকে নির্মিত মাসুরিয়ান ক্যানেল দিয়ে প্রতিটি হ্রদ একে অপরের সাথে যুক্ত। বাল্টিক সাগরের সাথেও এই ক্যানেলটি যুক্ত। তাই বাল্টিক সাগর থেকে সেই কয়েকশো হ্রদ পেরিয়ে কোন একদিন তোমার শহরে পৌঁছাবোই। পথে দুচোখ ভরে দেখবো স্নিয়ার্ডি (পোল্যান্ডের বৃহত্তম) হ্রদের চোখ জুড়ানো দৃশ্য। তারপর তোমাকে সঙ্গে করে ঘুরবো তোমার আর আমার মায়ের প্রিয় দেশের এক সীমান্তবর্তী কাউন্টি। তুমি আমাকে নিয়ে যাবে তোমার প্রাক্টিস গ্রাউন্ডে। তরঙ্গায়িত সে মখমলী প্রান্তরে একদিকে চুপ করে বসে দেখবো তোমার জ্যাভলিনের কারসাজি। তারপর যাব ওক, বীচ, ম্যাপল, ফার, স্প্রুস, পাইন সমৃদ্ধ অগাস্টো প্রাইমেভাল অরণ্যের মধ্য দিয়ে। উইগ্রি হ্রদে কায়াক বানিয়ে ভেসে পড়বো দুজনে। তারপর সূর্যাস্ত না হওয়া পর্যন্ত ভাসতে থাকবো স্ফ্যাগনাম সমৃদ্ধ অগভীর জলে। পশ্চিম আকাশ রাঙীয়ে যখন সূর্য যাবে অস্তাচলে তখন একটু ছমেছমে পরিবেশ তৈরী হবে বৈকি। এই রামসর সাইট নেকড়ে ও বীভারদের বাসস্থান যে। তবে বীভাররা যদি নারনিয়ার মত অতিথিবৎসল হয় তবে নিশ্চই একটা অতিথি নিবাস মিলে যাবে আমাদের। পরদিন ভোরে কাঠের ব্রীজের রেলিং এ হেলান দিয়ে সকালের চায়ের সাথে সূর্যোদয় দেখে বীভার পরিবারকে জানাবো বিদায়। নারনিয়া থেকে আবার বাস্তবে পা রাখা। তুমি প্রায় সমবয়সী আমার তাই তোমায় বন্ধু সম্বোধন করলাম। চলো বন্ধু এরপর তোমার দেশের দক্ষিণে যাবো, তাত্রা পর্বতশ্রেণীর সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে। তুষারমন্ডিত গিরিশিখরের পাদদেশে নীল জলরাশি, স্বচ্ছ হ্রদের জলের তল অবধি পরিষ্কার দৃশ্যমান। তোমার দেশের তৃণভূমিগুলো কি সুন্দর তরঙ্গায়িত আর মখমলী ঘাসে ঢাকা। ছোট ছোট হাইকিং হাট রয়েছে। পাথরের দেওয়াল, টালির চাল আর একফালি বারান্দায় কাঠের ফেন্সিং। স্বচ্ছ কাঁচের জানালা দিয়ে দেখাযায় প্রাকৃতিক নৈসর্গিক দৃশ্য। ফায়ারপ্লেসের চিমনি দিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছে, সে এক অপূর্ব দৃশ্য। পোলস্কা দেশের রূপসী কন্যা একটু দাঁড়াও তোমাকে একটা ধন্যবাদ দেওয়ার আছে। আজ তোমার জন্যই জানতে পেরেছিলাম ভারতের জ্যাভলিন ইভেন্টে অংশ নেওয়ার কথা। চিঠি লেখায় ছেদ পড়েছিল সে জন্য। আর জানো ফল কি হয়েছে ? আমাদের নীরজ সোনা জিতেছে, হ্যাঁ হ্যাঁ সোনা। ট্র্যাক এণ্ড ফিল্ডে এই প্রথমবার অলিম্পিক পদক। ১৩ বছর পর আবারও ব্যক্তিগত ইভেন্টে সোনা। সত্যিই আমি বলেছিলাম না আমি জাতীয় সংগীত হলে কেঁদে ফেলি, আজও তাই হল, জাপানের মাটিতে যখন তিরঙ্গা উঠছিল, আর জাতীয় সংগীত বাজছিল, আমার চোখের কোণ ভিজে গিয়েছিল। যাক তুমি রূপো পেলে আর আমার দেশ পেল সোনা। আচ্ছা চলো আবার ঘোরায় মন দিই। হাইকিং পথের ধারে ধারে উপত্যকায় ফুটে রয়েছে অসংখ্য বেগনী রঙের স্যাফরন, গোলাপী রঙের চ্যামেনেরিয়ন ফুল, বেগুনী অ্যাকোনিটাম ফারমাম, নীল রঙের ডেলফিনিয়াম ও জেন্টিয়ানা, হলুদ লিনারিয়া ভালগারিস, ডোরোনিকাম অষ্ট্রিয়াকাম, সাদা বুড়ির চুলের ন্যায় পুলসাটিল্লা স্লাভিকা, নীলচে বেগুনী ক্যাম্পানুলা কক্লিয়ারিফোলিয়া, লাল রঙে সজ্জিত রোডিওলা রোজিয়া, হলুদ ব়্যানানকুলাস, পাথরের খাঁজে জন্মেছে সাদা ড্রায়াসের দল। বেগুনী কার্ডাস ডেফ্লোরাটাসের ওপর বসে মধু পান করছে দুটি হলুদ প্রজাপতি। সেই পথ ধরে চলেছি আমরা, ওই দেখা যায় দুনাজেক নদীর গর্জ। চুনাপাথর ও ডলোমাইটে গড়া সে গর্জের মধ্য দিয়ে গর্জন করতে করতে ছুটে চলেছে নীল জলরাশি। প্রিয় বন্ধু, এরপর বিদায় জানানোর পালা তুমি ফিরে যাবে তোমার শহরে আমি ডুনাজেকের তীরে ধরে হাঁটব উত্তর অভিমুখে। কনিফেরাসের ছায়ায় ছায়ায় চলতে চলতে ডুনাজেক ভিস্চুলা নদীর সংগমস্থল। পোল্স্কার দীর্ঘতম এই নদী আমাকে পথ দেখিয়ে পৌঁছে দেবে বাল্টিক সাগরে যেখানে আমার নৌকো বাঁধা আছে। ফেরার পথে আরও একবার কৃতজ্ঞতা জানাই মারিয়া তোমাকে, তোমার সুন্দর দেশ আমাকে ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য। গানে গানে রইলো বিদায় সম্ভাষণ-

আজ দুই দেশ যাক মিলেমিশে
লাল সাদা তিরঙ্গা সবকটি রং
ওগো প্রিয় মোর দেখো চেয়ে ভোর
পৃথিবী যে সবার বিস্ময়।
ব্যর্থতা নয় আর সম্বল
উড়িয়ে দাও গর্বের সিম্বল
মেলে ধরো নিজেকে এবার
কম্পিত হোক কোটি হৃদস্পন্দন
সেরাদের পদধূলি ধন্য
জয়টিকা মাথায় আজ
পরে নাও পরে নাও পরে নাও

ইতি,
তোমার বন্ধু সায়ন্তন।
০৭/০৮/২০২১ 💙

1 thought on “❤️ পোলিশ তরুনীর প্রতি পত্র 💙 সায়ন্তন

  1. খুব সুন্দর হয়েছে লেখাটা। লেখার ভাষাও খুব সুন্দর। কোথাও হোঁচট খাচ্ছি না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *