পারিজাত —– তপতী সাহা

পারিজাত
তপতী সাহা

পর্ব-১

অমর চক্রবর্তী রোড ধরে ছেলেটি হেঁটে হেঁটে যাচ্ছিল। ভোরের আলো ফুটতে এখনো বেশ খানিকটা দেরি। সামনে ল‍্যাম্পপোস্টের উপরে বসে থাকা একটি কাক কা কা স্বরে ডেকে উঠল। কোথাও কোথাও কয়েকটি কুকুর কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। প্রাতঃভ্রমণে লোকজন এখনও সেরকম ভাবে বের হয়নি। শাওন ভাবল, তা হোকগে এই সময়টাই তার পক্ষে উপযুক্ত। কারোর মুখোমুখি পড়তে হবে না। হাজারটা কৌতূহলের নিরসনও করতে হবে না তাকে।

স্ট্রিটল‍্যাম্পের আলোয় তার ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছিল। একটা ঠান্ডা শিরশিরে বাতাস চারিদিকে খেলে যাচ্ছে। গলার মাফলারটা ভালো করে জড়িয়ে নিল সে। প্রতিদিনই সে যে প্রাতঃভ্রমণে বেরোয় তা নয়। মাঝে সাঝে যখন বাড়িতে মন ভালো লাগে না, তখন একটু হাল্কা হওয়ার জন্য বের হয়। ভোরের এই নির্জন পরিবেশ তার বেশ লাগে। পুরো শহর এখন ঘুমে অচেতন। একটু পরেই হয়তো সব আলস‍্য গা ঝাড়া দিয়ে জেগে উঠবে সবাই।

বাবা মা চলে যাওয়ার পর সে একেবারে একা হয়ে গেছে। অবশ্য ওঁরা থাকতে যে তাদের খুব সাহচর্য সে পেয়েছে তা নয়। তবুও তো ছিল…
তবে তাঁরা কোনোকিছুর অভাব রাখেননি। তাকে দেখভাল করার জন্য দামোদরকে সবসময়ের জন্য রেখেছেন তাঁরা। ছোট থেকে দামোদরের কোলেপিঠে করেই তো সে বড়ো হয়েছে। আর এখন অতোবড়ো বাড়িতে দামোদর ছাড়া আর কোনো জনমনিষ‍্যি নেই। মাঝেমধ্যে মনে হয় পুরো বাড়িটা যেন তাকে গিলে খেতে আসছে।

মাঠে পৌঁছে খানিকক্ষণ হাঁটার পর চারপাশের স্পিকার গুলো থেকে গানের সুর ভেসে এল। শাওন ভাবল, প্রাতঃভ্রমণকারীদের বিনোদনের জন‍্য ব‍্যাপারটা বেশ ভালো করেছে। কেউ একা এলেও তার একা একা অনুভূতিটা আর হবেনা। বর্গাকার মাঠটির চারপাশে প্রাতঃভ্রমণকারীদের হাঁটার জন্য দুদিকে রেলিং দিয়ে রাস্তা ঘেরা। ভোরবেলা থেকে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এখানে মাঠের আশেপাশে গাড়ী ঘোড়া চালানো নিষেধ। শাওন মাঠে নেমে ঘাসের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটু দৌড়েও নিল। একজন রিকশাওয়ালা অসংলগ্ন ভাষায় গান গাইতে গাইতে রিকশা চালিয়ে যাচ্ছিল। বোধহয় বেশ খানিকটা টেনেছে। নেশাটা ভালোই চড়েছে মনে হচ্ছে।

খানিকক্ষণ জগিং করার পর সে ফেরার জন্য পা বাড়ালো। চলতে চলতে তার কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হল। চারপাশটা যেন নিমেষে বদলে গেছে। চারিদিকে পাখির কলতানে মুখর হয়ে গিয়েছে, হিমেল বাতাস সরিয়ে কোথা থেকে যেন বসন্তের মৃদু দক্ষিনা বাতাস বয়ে এসে তার প্রাণ জুড়িয়ে দিল। তার স্নায়ুজালে একসাথে অফুরান প্রাণের স্পন্দন অনুভূত হল। মুগ্ধ আবেশে সে চারপাশটা দুচোখ ভরে দেখতে থাকল। এভাবে দেখতে দেখতে হঠাৎ একদিকে তার চোখ আটকে গেল।

“বাঃ, কী সুন্দর! এমন তো আগে দেখিনি…”
একদৃষ্টে সে একটা ছোট চারাগাছের দিকে চেয়ে ছিল। ভাবল, গাছটা দেখতেই এতো সুন্দর, তার ফুল হলে না জানি কত মনোহর হবে। নীলচে পাতার ওপর সবুজ শিরার বাহারি নকশায় আলো পিছলে পড়ে এক অপার্থিব বর্ণচ্ছটা ছড়িয়ে দিয়েছে। শাওন গাছটার দিকে হাত বাড়াতেই যাবে, এমন সময়…
“আরে এই, হচ্ছেটা কী!”
চমকে সে চকিতে ফিরে চাইল। দেখল, একটা ছেলে তার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছে।
পরনে জামাকাপড় মলিন হলেও মুখখানি তার ভারি মিষ্টি। ফর্সা গা হাত পায়ে ধূলা মাখা, যেন সে এক হতশ্রী রাজপুত্র।
শাওন মিটিমিটি চেয়ে বলল,”নাম কী তোমার? এখানে একা একা কী করছ?”
“উহু, কথা ঘোরাবে না। আমি তো এই বাগানেই থাকি, তুমি এখানে কীভাবে এলে?”
বাগান? শাওন এবার চারপাশটা ভালো করে লক্ষ্য করল। হ‍্যাঁ, তাই তো বাগানই বটে। চলতে চলতে সে কখন একটা বাগানের প্রান্তে চলে এসেছে। এ বাগানে কোনো বেড়া নেই। তবে হঠাৎ হঠাৎ জেগে ওঠা গাছগুলোই ঠিক পাশের ঘাসজমি থেকে এই বাগানকে আলাদা করে রেখেছে। গাছগুলো একটু অদ্ভুত রকমের। কোন গাছই ঠিক অচেনা নয় কিন্তু আবার চেনাও নয়; যেমন ওই গাছটা এতোটা বড় হয় না, ওই গাছে ওইরকম পাতা গজায় না, এই ফুলটার পাপড়ি যেন বড্ড কম, এ বাবা! ওই ফলটা ওভাবে ঝুলছে কেন? তার মাথাটা কেমন গোলমাল হয়ে গেল। আবার সেই ছেলেটার কথায় সম্বিৎ ফিরল…
“কি হল উত্তর দিলে না যে?”
শাওন গলা খাকরে বলল,”ইয়ে, এই বাগানটা তো আগে দেখিনি।”
ছেলেটা সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,”তোমার মতলব কী বলতো?”
শাওন কিছু না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
ছেলেটা খানিক ভেবে নিয়ে বলল,”আচ্ছা, বাবা বলেছিলো একটা লোক আসবে। তুমি কি সেই লোক?”
শাওন অপ্রস্তুত হেসে মাথা নাড়ালো। সেই লোক হয়েই যদি বাগানটা দেখা যায় তাহলে আপত্তি কিসের?
“এদিকে এসো”, ছেলেটি হাতের ইশারায় তাকে আসতে বলল। এরপর ছেলেটির সঙ্গে বাগান ঘুরতে ঘুরতে আরও অনেক আজব সব গাছ নজরে এল। কিন্তু থেকে থেকেই ছোট বড় গাছগুলোর আড়াল সরিয়ে সেই ছোট্ট গাছটাই যেন তার সাথে লুকোচুরি খেলছিলো, তার মনও পড়ে রয়েছিলো সেই গাছটার কাছে। এই ব‍্যাপারটা সেই ছেলেটারও নজর এড়ায়নি। সে খিলখিল করে হেসে বলল,”বাবা ঠিকই বলেছিলো, যতই অন্য গাছ দেখাই না কেন ওই চারাগাছটা তুমি নজরছাড়া করতে পারবে না।”
তারপর সে হনহনিয়ে ঐ চারাগাছটির দিকে এগিয়ে যেতেই হঠাৎ পেছন ফিরে বলল,”দাঁড়িয়ে রইলে যে? চলো গাছটা তোমায় দেওয়ার ব‍্যবস্থা করতে হবে তো।”
শাওন তো শুনে অবাক হয়ে গেল। গাছটা তার বেশ পছন্দ হয়েছে। নেবার জন‍্য সে বলতও, কিন্তু এভাবে না চাইতেই যে পেয়ে যাবে ভাবতেও পারেনি। যখন সে পৌঁছলো, ততক্ষণে ছেলেটা গাছটাকে মাটিসুদ্ধ উপড়ে ফেলেছে। সে কাছে আসতেই তার হাতে ধরিয়ে দিল। শাওন পকেট থেকে আন্দাজ মতো একটা বড় নোট বের করে দিতেই ছেলেটা ভ্রু কুঁচকে বলল,”এ আবার কী?”
“তোমার বাবা কত দাম বলে গেছেন এটার?”
“দাম? কই দাম নিয়ে তো কিছু বলেননি?”
শাওন অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,”তা কি হয়? দাম তো একটা থাকবেই।”
“উহু,বাবা শুধু বলেছে যার জন্য রাখা আছে ঠিক সেই নিয়ে যাবে।” ছেলেটা আর কথা না বাড়িয়ে হনহন করে গাছগুলোর মধ্যে মিলিয়ে গেল।

দামোদর ভোরেই উঠে দেখে শাওন দাদাভাইয়ের ঘর খালি। কোথায় যেতে পারে সে? বন্ধুবান্ধব তো এখানে সেরকম নেই বললেই চলে। সেই কোন ছোট্ট থেকে আছে এদের সঙ্গে। গিন্নীমা ও কর্তাবাবার বদলির চাকরি। এখানে সেখানে ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে সাতপুরুষের এই ভিটেতেই থিতু হয়েছে। তাদের তো গত হওয়া কয়েকবছর হয়ে গেল। একা দাদাবাবু, তিনকুলে কেউ নেই। সে অবশ্য এ বাড়ির একজন হয়ে গেছে। দাদাবাবুকে ছেড়ে যাওয়ার কথা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারে না।

শাওন এসে দেখলো দামোদরদা চিন্তিত মুখে খালি ঘর আর বার করছে। তাকে দেখেই সে বলল,”কিগো কোথায় গেছিলে? আমাকে ডাকোনি কেন?”
“ইস্, সত্যি আজ আমার অনেক দেরী হয়ে গেছে। তোমাকে বলে যাওয়া উচিত ছিল। বড্ড ভুল হয়ে গেছে গো। আসলে তুমি তো ঘুমোচ্ছিলে তাই।”
“আচ্ছা আচ্ছা, আর মন ভোলাতে হবে না। কিন্তু তোমার হাতে ওটা কী? কীসের চারা?”
“ও হ‍্যাঁ, এটা কিনলাম, জানো দারুণ সস্তায় পেয়েছি। কী সুন্দর দেখো! দেখে লোভ হয়ে গেল। তাই নিয়েই ফেললাম বুঝলে।”
কিন্তু বাকি কথাগুলো আর বলল না শাওন। কী জানি দামোদরদা আবার কী ভাবতে বসবে। তাকে নিয়ে যে দামোদরদা বড়ই চিন্তাভাবনা করে।
“দামোদরদা এটা তো লাগানোর ব‍্যবস্থা করতে হবে। দেখো লাগানোর মতো জায়গা আছে কিনা। খুরপিটা নিয়ে এসো তো।”
“বাড়ি ঘর তো গাছপালায় ভর্তি করে ফেলেছো। কোথায় আর জায়গা খুঁজবো। তুমি পারোও বটে। গাছ ছাড়া আর কিছুই বোঝো না। এরপর বৌ এলে এগুলোকেই সে সতীন ভাববে…” এটুকু বলে দামোদর চুপ করে গেল। কী জানি দাদাবাবু অসন্তুষ্ট হলো নাকি! সে ভেতর থেকে খুরপি আনতে চলে গেল।

দামোদরদার কথা শুনে একটু হাসল শাওন। বৌ, সে আর কখনও আসবে না। একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বাগানের দিকে পা বাড়ালো। তারপর সে আর দামোদর মিলে বাগানের এক কোনায় সেই চারা গাছটি লাগিয়ে দিল। দামোদর অবাক হয়ে বলল,”এ কোথা থেকে এনেছো গো? এই রকম তো আগে কখনো দেখিনি।”
“তুমি তো বলতেই পারো দামোদরদা। আমি বোটানির ছাত্র, গাছপালা সমন্ধে জানি কিছু। তাই তো বুঝতে পারছিনা।”

দিন দুএকের মধ্যে পাশাপাশি বাগানের আর চারাগুলো সুন্দরভাবে বেড়ে উঠলেও ওই গাছটির খুব সুন্দর চিক্কন চিক্কন নীল রঙের পাতা ক্রমশঃ হলুদ হতে লাগল। একদিন দেখা গেল সব পাতা ঝরে গিয়ে গাছটা কঙ্কালসার হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। শাওনের মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। তার সঙ্গেই কেন এরকম হয়! কোনকিছুই কী নিজের মতো করে হবে না।

ছোট থেকেই তার সঙ্গী-সাথী তেমন নেই বললেই চলে। স্কুলে দুয়েকজনের সাথে অন্তরঙ্গতা হলেও তা ছিল সাময়িক। জানিনা কারো সাথে তার বন্ধুত্ব দীর্ঘস্থায়ী কেন হয় না। অবশ্য হবার সুযোগও ছিল না। কেননা তারা কখনও এক জায়গায় তো স্থায়ী হয় নি। তবুও হতেও তো পারতো। বড় হয়ে স্কুল কলেজে সহপাঠীদের সঙ্গে সম্পর্ক তার মৌখিক কথাবার্তার মধ্যেই সীমিত থেকেছে। সে যে মিশতে চাইত তো না, তা তো নয়। কিন্তু সবাই যেন তাকে এড়িয়ে চলত। সে দেখতো সবাই একসাথে হাসছে, খেলছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে। শুধু সেইই একলা, কোনো বন্ধু বান্ধব নেই। শাওন আর যাইহোক খুব আত্মাভিমানী ছেলে। হয়তো এটাই তার সমস্যা। কী জানি! তা হবে হয়তো।

ক্লাসের বাইরে তার বেশিরভাগ সময়টা কাটত লাইব্রেরীতে বইয়ের পাতায় মুখ গুজে। এভাবেই সে নিজেকে ব‍্যস্ত রেখেছে মনের কষ্টটা ভোলার জন্য। কেউ কেউ তাকে অহংকারী, আত্মকেন্দ্রিক, মিশুকে নয় এরকমটা ভেবেছে। কিন্তু সত্যিই কি তাই! কেউ যদি এগিয়ে এসে কাছে টেনে নিতো, তার দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিতো, তাহলে হয়তো এর উল্টোটাই দেখতো। না হলে শর্মির সঙ্গে তার বন্ধুত্বটা হলো কি করে!

মেয়েটি তার নীচের ক্লাসে পড়ত। স্বভাবে অবশ্য শাওনের উল্টোটাই। সবার সঙ্গে হইহই করে কথা বলা, সহপাঠী থেকে শুরু করে প্রফেসর সবার সঙ্গেই সে সাবলীল ভাবে মিশে যেতো। শাওনের হাতের কাজ খুব সুন্দর! একদিন কলেজের সোশ‍্যালে শর্মিষ্ঠা ওর আঁকা দেখে বলেছিল,” বাঃ, শাওনদা তুমি কী সুন্দর আঁকো গো!”
শাওন চমকে পেছনে তাকিয়েছিল। তারপর শর্মিষ্ঠার কথার ফুলঝুরির কিছুই তার কানে ঢোকে নি। কী সুন্দর একটা মায়াভরা চোখ। আর চেহারা যেন সদ‍্য প্রস্ফুটিত গোলাপের পাপড়ির মতো কখনো হাসছে, কখনো দুলছে। সে দেখতেই থাকে, দেখতেই থাকে। শর্মিষ্ঠার সেদিকে চোখ পড়তেই সে লজ্জা পেয়ে যায়। তারপর দুজনের কতবার দেখা হয়েছে। কথা হয়েছে। বন্ধুত্ব, তা থেকে সম্পর্ক অন‍্যদিকে মোড় নিয়েছে।

কিন্তু না, শাওন যা ভেবেছিল তা ঠিক নয়। সত‍্যিই কি সম্পর্ক অন‍্যদিকে মোড় নিয়েছিলো? শর্মিষ্ঠার মিষ্টি ব‍্যবহার, সুন্দর কথাবার্তায় সে মুগ্ধ হয়েছিল। ভেবেছিল সে হয়তো তাকে ভালোবাসে। কিন্তু সে তো সবার সাথে এমনি করেই মেশে। তাকে কেন সে ভালোবাসতে যাবে? শাওন কি সুন্দর করে কথা বলতে পারে, আর সবার মতো? অবশ্য তার কি দোষ? না, তার কোনো দোষ ছিল না। সত‍্যিই সে বড় ভালো মেয়ে ছিল।

নাঃ,আজ রাতে আর ঘুম আসবে না বলে মনে হচ্ছে। খানিকক্ষণ বিছানায় এপাশ ওপাশ করে উঠে দাঁড়াল শাওন। চাঁদের আলোয় বাইরেটা পরিষ্কার ভাবে দেখা যাচ্ছে। তার ঘর থেকে জানালা দিয়ে বাগানটা সুন্দরভাবে দেখা যায়। জানালায় দাঁড়িয়ে সে বাগানের দিকে তাকিয়ে থাকল। গাছগুলোকে আজ বড় বিষন্ন দেখাচ্ছে যেন। কোথাও কোন হাওয়া বাতাস নেই। তার মনটা কেমন করে উঠল। এই বিশ্ব চরাচরে তার আপনার বলতে কেউ কি নেই! মনের কথা ভাগ করে নেওয়ার জন্যও তো কাউকে একজন চাই। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবার সে শুয়ে পড়ল।

পর্ব–২

এরমধ্যে বেশ কয়েকদিন কেটে গেছে। শাওন বাগানের দিকে এ কদিন যায় নি বলতে গেলে। দামোদরদাই সব দেখভাল করেছে। ঐ সুন্দর গাছটির ঐরকম হাল দেখে আর বাগানের দিকে যেতে মন চায় নি।

একদিন সকালে দামোদরদার চিৎকার শুনে শাওনের ঘুম ভাঙ্গল।
“দাদাবাবু… দাদাবাবু… দেখবে এস, কী সুন্দর হয়েছে দেখো!”
এই বলে শাওনকে টেনে বাগানের দিকে নিয়ে গেল। সে দেখল সেই দুর্বল গাছটাতে সুন্দর লাল রঙের নতুন নতুন কচিপাতা গজিয়েছে। কতগুলো পাতা ইতিমধ্যেই নীলবর্ণ ধারণ করেছে।
তবে তার রঙ আগের মত অতো গাঢ় নয়। খানিকটা হালকা হয়ে গেছে। তা হোক তাতেই যেন আর সুন্দর দেখাচ্ছে বেশি। শাওনের মন আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল। তাহলে সবকিছুই তার কাছে অধরা হয়ে যায়নি। এরপর থেকে গাছগুলোর দেখাশোনায় শাওন বেশি ব‍্যস্ত হয়ে পড়ল। এখন দিনের বেশিরভাগ সময় সব কাজ ছেড়ে সে বাগানেই বেশি কাটায়। দামোদর তাকে কিছু বলে না। ভাবে, ঘরের মধ্যে কম্পিউটার আর বই খাতায় সারাদিন মুখ গুজে থাকার চাইতে এ বরং ভালো হয়েছে।

প্রতিদিন সকালে উঠে শাওন গাছটিকে নিত‍্য নতুন ভাবে আবিস্কার করে। এখন গাছটি বেশ বেড়ে উঠেছে। তাকে আর চারগাছ বলা যাবে না। ডালপালা মেলে সে সুন্দর ভাবে ছড়িয়ে গেছে। শাওনের কেন জানি মনে হয় গাছটি তার মনের কথা সব বুঝতে পারে, সাড়াও দেয়। এতোদিনের যাবতীয় সুখ দুঃখের কথা সে গাছের সঙ্গেই শেয়ার করে। সে ইন্টারনেট সার্চ করে দেখেছে, এরকম কোন গাছের উল্লেখ পায় নি। যাকগে ওই নিয়ে আর সে বেশি ঘাটায় নি। সে গাছটির নাম দিয়েছে পারিজাত। স্বর্গের উদ‍্যানের মতোই তার বাগানে গাছটি আলো করে আছে। ফুলের মিষ্টি গন্ধে বাগান তো বটেই ঘরও ম ম করে। অনেক দূর পর্যন্ত সেই গন্ধ ছড়িয়ে যায়। ফুলগুলোও কি সুন্দর দেখতে। রাতেই ফোটে ফুলগুলো, সাদা ও হাল্কা ঘিয়ে রঙের সংমিশ্রণে ফুলগুলো দেখতে ঝুমকোর মতো, অজস্র ফুটে থাকে। দিনের এক একটা সময়ে ফুলগুলো রামধনুর রঙের মতো পরিবর্তিত হতে থাকে। আর সেই ফুলের আকর্ষণে প্রজাপতি, মৌমাছি, কতরকমের পাখিরা এসে গুঞ্জন তোলে।

একদিন রাত্রিবেলায় শাওনের মিষ্টি সুরেলা আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল। শব্দের উৎস সন্ধান করতে গিয়ে জানালার দিকে সে তাকিয়ে অবাক হয়ে দেখল সেই গাছের নীচে কয়েকজন ছেলেমেয়ে হাত ধরাধরি করে নাচ গানে মেতে আছে! এরা কারা? কোথা থেকে এল? সেই সুরেলা মিষ্টি গানের আকর্ষণে মোহিত হয়ে সে ওইদিকেই যেতে থাকল। এরপর থেকে রোজই সেই আকর্ষণের নেশা তাকে পেয়ে বসল। আর দামোদর সকালবেলায় তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় বাগানে পেতে লাগল।

দামোদর তাকে জিজ্ঞেস করলে সে কিছুই বলতে পারল না। সে কি বলবে? কী করে সম্ভব এটা? শর্মিষ্ঠার কথা আজকাল খুব মনে পড়ে। কি দোষ ছিল মেয়েটার! তার বাবা মা যখন মনের খোঁজ নেয় নি, অন‍্য কারো কি দায় আছে তার কথা ভাববার? কিন্তু যখন সে শর্মিষ্ঠার কাছেই শুনল, সে একজনকে ভালোবাসে, সহ‍্য করতে পারেনি। সব কিছু ধ্বংস করে উলোট পালোট দিতে মন চেয়েছিল। এখন শর্মিষ্ঠার সঙ্গে একটিবার যদি দেখা হতো। কিন্তু সে তো আর সম্ভব নয়।

আজ শাওন ভাবল, সে আগেই গিয়ে আড়াল থেকে দেখবে কোথা থেকে আসে ওরা। না আজ আর চুপচাপ বসে দেখবে না। গানের সুরে ঘুমিয়েও পড়বে না। সবটা দেখবে। জানতে চাইবে, ওরা কারা? কোথায় থাকে?

সন্ধ‍্যে রাতেই খাওয়া সেরে নিয়ে একটা গাছের আড়ালে সে লুকিয়ে থাকল। আশেপাশের সব বাড়িতে যখন আলো নিভে গিয়ে চারিদিকে নিস্তব্ধ হয়ে গেল, শাওন দেখল গাছ থেকে টুপটুপ করে কী যেন ঝরে পড়ল। তার চোখের পলক পড়তেই দেখল ছেলেমেয়েগুলো হাত ধরে ধরে কী সুন্দর গান গেয়ে গেয়ে নাচ করছে। সে রোজ যেমন দেখে সেই রকমই অপূর্ব সে গানের সুর আর কী সুন্দর নাচের ভঙ্গিমা! যেন স্বর্গ থেকে অপ্সরারা নেমে এসেছে। গানের সুরে তার দুচোখ জড়িয়ে আসতে লাগল। কিন্তু আজ পণ করেছে কিছুতেই সে ঘুমোবে না।

একটু পরে যখন গান থামল, সে দৌড়ে ওদের কাছে যেতেই ওরা বলল,”এসো শাওন।”
শাওন অবাক হয়ে বলল,”তোমরা আমার নাম জানো!”
“আমরা সব জানি। তুমিই তো বলেছো এই গাছের কাছে এসে।”
“তোমরা কারা? কেন আস এখানে?”
“আমরা অন‍্য মাত্রা থেকে এসেছি। এই গাছের মাধ্যমে আমরা অন‍্য মাত্রার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারি। তোমার মনে খুব দুঃখ তাই না। তাই তোমার মনে একটু আনন্দ দিতে আসি। তোমার ঘুম আসে না, তাই গান গেয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিই।”
শাওন তো শুনে খুব আশ্চর্য হয়ে গেল। সে শুনেছে পাশাপাশি অনেক ডাইমেনশনের অস্তিত্বের সম্ভাবনার কথা। তাহলে এরা…সেই সঙ্গে ওদের কথাবার্তা শুনে তার খুব ভালো লাগল। এইরকম আন্তরিকভাবে তার সঙ্গে আজ অব্দি কেউ কথা বলে নি। সে বলল, “তোমরা আমার বন্ধু হবে। জানো আমার কোনো বন্ধু নেই?”
“আমরা সব জানি শাওন, একটু আগে তোমাকে বললাম যে। আমরা তো তোমার বন্ধুই, সেদিন খুব দুঃখ পেয়েছিলাম জানো, তুমি মরে যাওয়ার কথা বলেছিলে। জানো তো বন্ধুদের মনে কোনো দুঃখ দিতে নেই। বলো তুমি আর কোনোদিন ওইসব কথা ভাববে না।”
“কার জন্য বাঁচব আমি। আমার তো কেউ নেই।”
“তোমাদের এখানে সবকিছু আছে। তবুও তোমরা মরার কথা ভাবো। দেখো হতাশ হয়ো না। নিশ্চয় ভবিষ্যতে তোমার জন্য ভালো কিছু অপেক্ষা করে আছে। আর দেখো আমাদের দুনিয়াটা প্রায় ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে তবুও আমরা হাল ছাড়িনি। অন‍্য কোথাও বসবাস করা যায় কিনা সেই সন্ধানে আছি।”
“কেন? তাই যদি হয়, আমাদের এখানে থাকবে তোমরা। আমাদের বাড়িতে অনেক জায়গা আছে। আমরা সব বন্ধুরা মিলে একসাথে আনন্দ করে থাকব।”
“সত্যি শাওন! থাকতে দেবে আমাদের?”
“কেন দেবোনা? তোমরা তো আমার বন্ধু। আর বন্ধুর বিপদে পাশে দাঁড়ানো তো কর্তব্য।”
খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে ওরা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে বলল,”ঠিক আছে তাই হবে। আমাদের ওখানে তো কিছু কাজ আছে, সবকিছু সেরে, গুছিয়ে নিয়ে আমাদের আসতে একটু সময় লাগবে। তুমি অপেক্ষা করবে তো এখানে?
আবার ঘুমিয়ে পোড়ো না যেন। আমরা যদি নাও আসতে পারি, তুমি মন খারাপ করো না। তোমার বন্ধুকে ঠিক পেয়ে যাবে তুমি।”

ওদের কথামতো নির্দিষ্ট সময়ে শাওন বাগানে এসে বসে থাকল। সারারাত জেগে থাকতে থাকতে ভোরের দিকে কখন দুচোখের পাতা একটু এক হয়ে এসেছে। একটা নরম হাতের স্পর্শ পেয়ে সে ধড়মড় করে উঠে বসে বলল,”তোমরা এসে গেছো?”
তারপর সামনে শর্মিষ্ঠাকে দেখে ভারি অবাক হয়ে গেল। “কী ব‍্যাপার তুমি এখানে?”
“আমি তোমার কাছে বরাবরের জন্য চলে এলাম শাওনদা। তুমি থাকতে দেবে না?”
দামোদর বলল,” জানো দাদাবাবু ভোরবেলায় গেট খুলতে গিয়ে দেখি শর্মিষ্ঠা দিদিমণি গেটের কাছে দাঁড়িয়ে। আমি গেট খুলে দিতেই বলল, তোমার সঙ্গে দেখা করবে। তাই তো আমি নিয়ে এলুম।”
“হ‍্যাঁ, কিন্তু তোমাকে তো সেদিন চড় মেরে অপমান করেছিলাম! ভেবেছিলাম তুমি আর আমার মুখদর্শনই করবে না। তার ওপর এই ভোরবেলায়! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”
“রাহুল আমাকে ঠকিয়েছে শাওন। ও একজনের সাথে লিভ ইনে থাকা সত্ত্বেও আমার সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলেছিলো। তার পরেও আমার সাথে বিয়ের নাটক করেছে। আজ আমি সব জানতে পেরে চলে এসেছি…”
আজ আমার সঙ্গে কী সব হয়ে চলেছে। আমি কী স্বপ্ন দেখছি শুয়ে শুয়ে। শাওন গায়ে জোরে একটা চিমটি কাটল। না, সত্যিই তো! শর্মিষ্ঠাকে সামনে দেখে খুব খুশি হলেও পরক্ষনেই ওদের কথা মনে হতেই সে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। চারপাশে তাকিয়ে বলে উঠল,”তা হলে ওরা কোথায় গেল?”
দামোদর বলল,”দেখলে তো দিদিভাই, দাদাবাবু কেমন পাগলের মতো হয়ে গেছে। তোমাকে তখন বললাম তো সবকথা। এখন তুমি এসে গেছো সব সামলাও। এবার আমার ছুটি।”

হঠাৎ শাওনের গাছটির দিকে চোখ পড়তেই সে হাহাকার করে উঠলো,”ও দামোদরদা এরকমটা কী করে হল! কালকেও তো সবকিছু ঠিক ছিল।”
দামোদর তাকিয়ে দেখল, সত্যিই তো! এরকমটা হতে পারে! একরাতের মধ্যে গাছটা কেমন শুকিয়ে গেছে। শাওনের চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চাইল। কান্নাজড়িত কন্ঠে সে বলে উঠল,
“তাহলে, ওরা আর আসতে পারবে না…”
শর্মিষ্ঠা জিজ্ঞেস করল,”কাদের কথা বলছ তুমি?”
শাওন আর কোনো কথা বলল না। সে জানে এসব কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। তার সব মনের আশা পূরণ করে দিয়ে চলে গেছে তারা। তাহলে ওদের দুনিয়াটা কি ধ্বংস হয়ে গেছে এতোক্ষণে, এই গাছের সাথে সাথে। ওরা বলেছিলো এই গাছের মাধ্যমে ওরা জীবনীশক্তি সঞ্চয় করে নিয়ে যায়।

একথা সত্যি, এরপর থেকে শাওন আর ওদের কোনোদিনই দেখতে পায়নি। আর ঐ বাগানটাও খুঁজে পায় নি। এখন শাওন শর্মিষ্ঠাকে নিয়ে সুখে আছে। কিন্তু ওই গাছটি আর ওদের কথা ভেবে, শাওন আজও মনে মনে কষ্ট পায়।

সমাপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *