#গল্পহলেওসত্যি মীনা দে
#গল্পহলেওসত্যি
মীনা দে
আজ থেকে প্রায়, বিয়াল্লিশ, তেতাল্লিশ বছর আগের কথা। নাম করা হোমিওপ্যাথি ডাক্তার , যিনি অল্প সল্প লেখালেখির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন, তখনকার অমৃত বাজার পত্রিকায় তাঁর লেখাও ছাপার অক্ষরে বেরিয়ে ছিল। ডাক্তার অসীম মুখার্জ্জীর মেয়ে নীলা মুখার্জ্জী‘ পাঁচ ভাই বোন আর মা বাবার ছোট্ট পরিবার থেকে এসে পড়ল, প্রায় কুড়ি বাইশজন সদস্যের এক একান্নবর্তী পরিবারে।
প্রেম করে বিয়ে। নীলার বাবা অসীম মুখার্জ্জী মত তো দিয়েছিলেন কিন্তু নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দেননি কারণ নীলা পছন্দ করেছিল একটি কায়স্ত পরিবারের ছেলেকে। তিনি হয়তো তখনকার সমাজ ব্যবস্থা অনুযায়ী সেই ঘটনা মেনে নিতে পারেন নি। যাইহোক নীলা বিয়ের পর মুখার্জ্জী থেকে দাস হয়ে শ্বশুরবাড়ি এলো। শ্বশুরবাড়ি খুবই ভালো । এতো লোকজন,নীলারা ছয় জা ভাসুররা সব এবং সকলকার ছেলে মেয়ে সর্বোপরি শাশুড়ী ঠাকরূণ। সবাইকে নিয়ে এলাহি ব্যাপার রোজই হাসি মজা হৈ হৈ করে দিন কেটে যায়। নীলা দেখে, যা হয় তাই বেশি বেশি।
নীলার শ্বশুরবাড়িতে তখন রান্না করার জন্য এক উড়িয়া বামুন ঠাকুর ছিল। দুই বেলা সেই রান্না করতো। সকলেই তাকে ঠাকুর বলেই ডাকতো। রান্না করা খেতে দেওয়া সবই তার কাজ ছিল। সকলের খাওয়া হয়ে গেলে সে নিজে খেতে বসত। তারপর তার ডেরায় ফিরতো। প্রায় তিনটে সাড়ে তিনটে বেজে যেত।
একদিন সকলের খাওয়া দাওয়া শেষ হবার পর ঠাকুর সবেমাত্র নিজের ভাতটা নিয়ে খেতে বসতে যাবে এমন সময়ে নীলা কিছু একটা নিতে বা রাখতে রান্না ঘরে পা দিতেই নীলার শাড়ির আঁচলের খুঁটটা একটুখানি লেগে যায় অসাবধানতা বশতঃ ঠাকুরের গায়ে। ব্যাস ঠাকুর তো রেগে অগ্নিশর্মা। অনেক কথা শোনালো নীলাকে। নীলার ছোঁয়া লেগে নাকি সেইদিনের মতো তার আর খাওয়া চলবে না। তার শরীর অপবিত্র হয়ে গেছে পুরো খাবার ফেলে দিতে হবে কায়স্তের ছোঁয়া ব্রাহ্মণ খেতে পারে না।
নীলার তখন অপমানের জ্বালায় সমস্ত শরীর কাঁপছে। কিছুই বলতে পারছে না শুধুই কেঁদে চলেছে সে। তার বড় জা কত করে ঠাকুর কে বোঝাবার চেষ্টা করছে যে আমাদের ছোট বৌও তো বামুনের ঘরেরই মেয়ে ওর ছোঁয়া খেলে তোমার কিছু হবে না। নাহ্ ভবি ভোলবার নয়। সে খাবার দাবার সব ফেলে দিয়ে হন হন করে হাঁটা দিল। নীলার একেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা। সে তো এমন ব্যাপারের সঙ্গে মোটেও পরিচিত নয় । তার কেবলই একটা কথাই মনে হচ্ছিল সে আজ নীচু জাতের মেয়ে হয়ে গেল!!তার কেবলই বাবার কথা মনে হচ্ছিল এটা তো তার বাবাকে অপমান করা হলো। তখন আর এসব কথা ভেবেই বা কি হবে! যা হবার তা তো হয়েই গেল। বাড়ির কেউই অবশ্য নীলার দোষ ধরেনি সবাই ঠাকুরের এই ব্যবহারে খুবই দুঃখ প্রকাশ করলো।শুধু নীলার মনে এই ঘটনা গভীর ছাপ রেখে গেল। কেন? কেন? কেন? অনেক কেনর ঊত্তর তখন সে খুঁজে পেল না।
তার পর তো নীলার চোখের সামনেই সমাজে অনেক পরিবর্তন এলো। সমাজ কিছুটা হলেও পাল্টালো কিন্তু সেদিনের সেই ঘটনা নীলা কোনদিন ভুলতে পারল না। আজও মাঝে মাঝে নীলার খুব কষ্ট হয় তার বাবার কথা ভেবে।