।।। পরিযায়ী।। শান্ত্বনু ভুঁইয়া
।।। পরিযায়ী।।
শান্ত্বনু ভুঁইয়া
নাহ্,এবার বোধহয় রথীন বাবুর কথাটা মেনে নেওয়াই ভালো। আর তো পারা যাচ্ছে না। শুধু তো নিজের জন্য নয়, ছয় বছরের ছোট মেয়েটা আর ষাট ছুঁই ছুঁই শাশুড়ি মা সবাই মিলেই ভোগান্তি। একা হলে দেবশ্রী ঠিক লড়াই করতো, কিন্তু..
একমনে বসে কত কথাই ভাবছিল দেবশ্রী! দু’বছর আগে মানুষটা মারা যাওয়ার সময় হাত দুটো ধরে পৃথিবীর শেষ সম্বল এই মানুষগুলোকে আগলে রাখার অনুরোধ করেছিল। আর তারপর থেকে চলছে এই জীবন যুদ্ধ। এমনই এক বৃষ্টির সন্ধ্যায় সুজয়ের অ্যাক্সিডেন্ট দেবশ্রীর ছোট পৃথিবীটা গন্ডগোল করে দিয়েছিল। স্বামীর ব্যবসার ব্যাপারে কিছুই জানতো না দেবশ্রী, জানার প্রয়োজনও বোধ করেনি কোনদিন। কিন্তু ওই নিষ্ঠুর দূর্ঘটনা দেবশ্রীকে বাস্তবের নিষ্ঠুর জগতে এনে ফেলেছিল। ব্যবসা থেকে বিশেষ কিছুই পায়নি। সুজয়ের সহৃদয় বিজনেস পার্টনার রথীন বাবু বলেছিলেন,”ব্যবসায় মন্দা চলছে, অনেক ধার হয়েছে তবুও সব আমি সামলে নেব”। সামান্য কিছু জমানো টাকা, সুজয়ের এলআইসি আর শাশুড়ির পেনশন কে অস্ত্র করে সংসার সামলাচ্ছে দেবশ্রী। মাস ছয়েক আগে শাশুড়ির হার্টের সমস্যায় গয়নাগুলোও শেষ আর সংসারের ফাঁকফোকর গুলো বড় স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তবুও সব হারানো বৃদ্ধাকে সে কিছুতেই আর হেরে যেতে দেবে না। ছাদের দু-একটা টালি ভেঙেছে। সারাবছর একরকম কিন্তু বর্ষাকালে বড্ড কষ্ট হয়। গতবছর শুধু দেবশ্রীর ঘরে আর এ বছর শাশুড়ির ঘরেও জল থৈ থৈ করছে। রথীন বাবু অবশ্য সময়-অসময় কিছু সাহায্য করেন। যদিও দেবশ্রীর বিশ্বাস সব ব্যবসাটা গ্রাস করে এখন পাপস্খলন করছেন। রথীন বাবু গত বছরেই বলেছিলেন,”এত কষ্ট করছেন কেন মাসিমা? সবাই মিলে আমার বাড়িতে চলে আসুন। আমি একা, কয়েকদিন না হয় আপনাদের সাথেই সংসার সংসার খেলব।”সুজয় এর থেকেও অনেক বড় মানুষটার এই সুচিন্তার পেছনে লুকিয়ে থাকা ইশারা বুঝতে অসুবিধা হয় না দেবশ্রীর। অনেকদিন ধরেই লোকটার কুনজর রয়েছে তার প্রতি। তার দিকে তাকিয়ে এমন ভাবে হাসে যে গা ঘিন ঘিন করে ওঠে দেবশ্রীর।
“বৌমা, গত সাতদিন ধরে ঘর উঠোন ভর্তি জল আর এক বেলা খাওয়া, আমি বুড়ি মানুষ কিন্তু তোমাদের কষ্ট তো সহ্য হয় না। যাবে নাকি রথীনের বাড়ি?” শাশুড়ির গলা শুনে চমকে উঠেছিল দেবশ্রী। গত সপ্তাহেই এসেছিলেন রথীন বাবু। মিষ্টি করে প্রস্তাব দিয়ে গেছেন,”মাসিমা আমার দুটো ঘর তো পড়েই আছে চলে আসুন”, আর দেবশ্রীর দিকে বিশ্রী ভঙ্গি করে বললেন”সুজয় আমার বন্ধুর মতোই ছিল, তাই বন্ধুর অবর্তমানে তার সবকিছুর খেয়াল তো আমাকেই রাখতে হবে। হা হা হা। চলে এসো বাড়িতে, খাবে -দাবে ,আরামে থাকবে,সব দায়িত্ব আমার।”
আরো দুটো দিন কাটলো, তারপর দায়িত্ব-কর্তব্যের কাছে হেরে গেল দেবশ্রীর নারীমন। মেয়ে শাশুড়ির হাত ধরে উঠে এলো রথীন বাবুর বাড়ি। প্রায় এক মাস.. মেয়ে খুশি, শাশুড়ি খুশি, শুধু দেবশ্রীর মনে হয় একমাস এতটা দীর্ঘ! এত কষ্ট!। প্রায় প্রতিটি রাত এক জঘন্য মানুষের কাছে নিজের কাছের মানুষগুলোর সুখ কেনার জন্য আত্মসমর্পণ।
বৃষ্টি শেষে আজ এক ঝকঝকে আকাশে বাড়ি ফিরল তিনটে প্রাণ। ঘরে আর জল জমে নেই, ঘর এখন বাসযোগ্য। শুধুমাত্র একরাশ অব্যক্ত যন্ত্রনা জমে আছে দেবশ্রীর মনে। নিজেকে যেন আজ এক পরিযায়ী পাখির মত মনে হল দেবশ্রীর, পার্থক্য, নিজের নয় অন্য কারো সুখ আনতে আত্মহূতি দিয়ে ফিরেছে নিজের ভালোবাসার মানুষের স্মৃতি মাখা নিজের ছোট্ট বাড়িতে।