#বাঘবন্দী #কলমে: অর্ণব পাল

#বাঘবন্দী
#কলমে: অর্ণব পাল

পর্ব ১:

১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাস। শীত তখনো বেশ জাঁকিয়ে বসে আছে বঙ্গভূমি তে। কুষ্টিয়ার কায়াগ্রামে সেদিন বিরাট হইচই। তার দুটি প্রধান কারণ। উমেশ্চন্দ্র মুখুজ্যের বিধবা স্ত্রী শরৎশশি ও তাঁদের সুযোগ্য পুত্র যতীন ফিরে এসেছে। আবার একটি মানুষখেকো বাঘ প্রাণ অতিষ্ট করে রেখেছে গ্রামবাসীর। যতীনের যথেষ্ট নাম ডাক ছিল সাহসী ও ডাকাবুকো বলে। সবাই যতীনকে অনুরোধ করলো বাঘের হাত থেকে রেহাই দিতে। যতীন এক কথায় রাজি। একটি গোর্খা কুকরি নিয়ে সে জঙ্গলে বাঘ খুঁজতে নামল। বাঘের মুখোমুখি হতেই সে খালি হাতে বাঘের সঙ্গে সম্মুখ সমরে নামলো এবং অচিরেই কুকরি দিয়ে বাঘকে মেরে ফেলল। কিন্তু বাঘের নখের আঁচড় তার সারা শরীর বিষাক্ত করে দিয়েছিল। কলকাতার বিখ্যাত সার্জেন সুরেশ প্রসাদ নিজে দায়িত্ত্ব নিলেন রুগীর চিকিৎসার। যতীনের বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে তিনি কাগজে একটি আর্টিকেল প্রকাশ করলেন। ব্রিটিশ সরকার একটি রূপার মেডেল দিয়ে সম্মান জানালো যতীনকে। নাম দিল, ” বাঘা যতীন”!

পর্ব ২:

বাংলার বিপ্লবীদের সঙ্গে জার্মান সরকারের যোগাযোগ ধরা পড়ে গেলো ব্রিটিশ সরকারের সামনে, যেদিন কলকাতার হ্যারি অ্যান্ড সন্স দোকানটি তে পুলিশ রেড করলো। চার্লস তেগার্টের নেতৃত্বে বিশাল বাহিনী ছুটলো উড়িশার বালেশ্বরের দিকে। ঐখানেই লুকিয়ে আছে প্রবল পরাক্রমী বিপ্লবী বীর, যুগান্তর দলের সর্বাধিনায়ক বাঘা যতীন!
খবর যথাসময়ে পৌঁছে গেলো যতীন দার কাছে। কিন্তু তিনি নিরেন ও জতিশকে ছেড়ে কিছুতেই যাবেন না। মূল্যবান সময় নষ্ট হয়ে গেল। ব্রিটিশের চোখে ধুলো দিয়ে তাঁরা আশ্রয় নিলেন বুড়িবালামের তীরে, চাশাক্ষণ্ডার এক গভীর ট্রেঞ্চে। শুরু হলো ভীষণ লড়াই। একদিকে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল ধারি ব্রিটিশ পুলিশ, অন্য দিকে মাউসার পিস্তল হাতে জনা পাঁচেক বীর বাঙ্গালী বিপ্লবী। কে বলে বাঙালি ভীরু?? ৭৫ মিনিট ধরে লড়াই চললো। চিত্তপ্রিয় যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ হয়ে গেলেন। মনোরঞ্জন ও নীরেন ধরা পড়লেন কারণ তাঁদের গুলি ফুরিয়ে এসেছিল। যতীন দা ও যতিশ মারাত্মক আহত। বালেশ্বর হাসপাতালে যতীন দা কে তেগার্ট জল সাধলেন। মৃত্যু পথযাত্রী যতীন দা ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করলেন সে জল। সারা ভারত জানলো বাঙালি ভীরু নয়। ভারতের স্বাধীনতার জন্য সে নিবেদিত প্রাণ! যতীন দা, অমর রহে!!

পর্ব ৩:

সুন্দর বনের একটি ছবির মত গ্রাম মালতিপুর। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে মাতলা। সরল গ্রাম্য জীবন হঠাৎ করে সন্ত্রস্ত। কিছুদিন যাবৎ একটি বাঘের উৎপাত খুবই বেড়েছে। সন্ধ্যার মুখে মুখে বাঘের উৎপাত বাড়ে। রহস্যজনক ভাবে গ্রাম থেকে যুবতী মেয়েদেরকেই বাঘ বেছে বেছে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। কোনোভাবেই বাঘকে ধরা যাচ্ছে না। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে ফরেস্ট অফিসার অপূর্ব রায় ছুটে এলেন মালতিপুরে। অনেক পরিশ্রম করে তিনি কিছু ক্লু জোগাড় করলেন। কিন্তু তাঁর পুলিশের সাহায্য দরকার মনে হলো।

পর্ব ৪:

ফাঁড়ির ইনচার্জ পতিতপাবন পাত্র। তা তিনি পুলিশ কম, জলের জালা বেশী। বিশাল বপু নিয়ে সারাদিন খাওয়া ও ঢোলা ছাড়া বিশেষ কাজ তাঁর কখনোই করা হয়ে ওঠে না। অপূর্ব বাবু শত চেষ্টাতেও পতিত বাবুকে তদন্ত করাতে সমর্থ হলেন না যে বেছে বেছে মেয়েরাই কেনো শিকার হচ্ছে।
সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। গ্রামের দোকানপাট বন্ধ। রামি ধোপানির মেয়ে লতিকা গাঁয়ের আল দিয়ে ছুটে ছুটে আসছিল। সন্ধ্যে হয়ে গেছে। পাশের গাঁয়ে মেলা দেখে ফিরতে গিয়ে দেরী হয়ে গেছে। হঠাৎ বাঘের ডাক। এবং তার শরীরে সে অনুভব করলো কিছু নোংরা হাতের স্পর্শ। আতঙ্কে তাকিয়ে দেখে, ওখানকার ক্ষমতাসীন দলের নেতার ভাই, স্বপন! স্বপন হিস হিসিয়ে বললো, ” চল মাগী ! এমন গতর দেখলে শেঠ আমায় লালে লাল করে দেবে।” অপূর্ব বাবু তখন কি কারণে ওই পথ দিয়েই ফিরছিলেন। তিনি ছুটে আটকাতে যাবার আগেই পেটের কাছে বন্দুকের নল টের পেলেন।

পর্ব ৫:

বারবার করে পতিত দারোগা কে বলেও স্বপন ও স্বপনের দাদার নামে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট বার করা গেলো না। অপূর্ব বাবু হতাশ হয়ে পড়লেন। বুঝলেন, মুখ্যমন্ত্রীকে এখুনি জানানো দরকার আসল ঘটনা টা। তিনি সেইদিন রাতেই ফাইল বগলে করে ছুটলেন কলকাতার উদ্দেশ্যে। কিন্তু বিধি বাম। পথ আটকালো পতিত দারোগা ও স্বপনের দলবল। পতিত দারোগা বলে উঠলো, ” শালা জঙ্গলের টিকটিকি! বললাম কতো করে এসব নিয়ে খোঁচা খুঁচি করিস না। তা নোয়কো। হিরো হবে শালা!” স্বপন পিছমোড়া করে বাঁধল অপূর্ব কে। সবে সে ভোজালি ঢোকাতে যাবে অপূর্ব বাবুর পেটে, হঠাৎ সে এক গুরুগম্ভীর স্বর শুনতে পেল, ” যে হাতে বাঘ মেরেছিলাম, সেই হাত দিয়ে মানুষ মারতে এক মিনিট ও সময় লাগবে না। ” সবাই দেখে এক বলিষ্ঠ ছায়ামূর্তি এবং আরও জনা চারেক ছায়ামূর্তি। তারা এক বিষম ক্ষমতায় সবাইকে মেরে শুইয়ে দিলো। পতিত দারোগা কে বলিষ্ঠ ছায়ামূর্তি শূন্য থেকে আছড়ে ফেলল এবং তারপর বলে উঠলো,” টেগারট আমায় ভয় করে চলতো আর তুই কিনা আমার বাংলার মা বোনদের ক্ষতি করিস পুলিশ হয়ে?? ” পতিত দারোগা ঐখানেই নরক লোকে যাত্রা করলেন। সবাইকে শায়েস্তা করে ছায়ামূর্তি বলে উঠলো, ” অপূর্ব! গাঁয়ের লোক কে বলো, তাদের আর বাঘের ভয় করার দরকার নেই। যতীন দা ফিরে এসেছে, এই বাংলার বুকে।”

পর্ব ৬:

অপূর্বর মুখে সব টুকু শুনে মুখ্যমন্ত্রী আবেগতাড়িত হয়ে পড়লেন। চোখের জল মুছে তিনি স্বগতোক্তি করে উঠলেন, ” এই সেদিন উগ্রপন্থীদের হাত থেকে রেহাই দিলেন বীনয়, বাদল, দীনেশ আর আজ নারী পাচারকারী দের শায়েস্তা করলেন বাঘা যতীন। বাংলার বিপ্লবী কুল আবার স্বমহিমায় ফিরে এসেছেন বাংলা কে রক্ষা করতে। আমি নিশ্চিন্ত। বন্দে মাতরম! “

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *