সাধারণ মেয়ে কলমে :- মোহনা মজুমদার

সাধারণ মেয়ে
কলমে :- মোহনা মজুমদার

-কিরে সুরো,পাঁচ টা বাজে, টিভি টা খোল, প্রথমা নারী শুরু হবে তো।
– হ‍্যা মা,চায়ের জল টা বসিয়ে যাচ্ছি,তোমরা এবার আস্তে আস্তে ওঠো বিছানা ছেড়ে,এরপর তো সেই রাতে ঘুম আসবে না,এপাশ ওপাশ করবে ।
রোজ বিকেলে চা খেতে খেতে মানুষী দেবী ,ওনার স্বামী, মেয়ে সুরঙ্গমা সবাই বসে জননী বাংলা চ‍্যানেলে প্রথমা নারী দেখবেই দেখবে,একটা দিন ও মিস হয়না।
রোজ ওই অনুষ্ঠানে কয়েকজন জন প্রতিযোগী আসেন, খেলেন, আর তাদের স্ট্রাগেল এর গল্প শোনান,সর্বপরি স্ট্রাগেল করে জীবন যুদ্ধে জিতে যাওয়ার গল্প শোনান, মন দিয়ে শোনে সুরঙ্গমা, এক এক নারীর এক এক রকম যুদ্ধ,ইচ্ছে করে ও যদি যেতে পারতো, কিন্তু গিয়ে কি গল্প শোনাবে ও, ওর তো কোনো জিতে যাওয়ার গল্প নেই ,যে লোকে শুনে হাততালি দেবে, নিজেদের জীবনে এগোনোর অনুপ্রেরণা পাবে।
ও না চাকুরীরতা, না সুন্দরী,তাই হাজার খুঁজে ও একটা ঠিকঠাক সম্বন্ধ দেখে বিয়ে দিতে পারেনি ওর বাবা মা, আর এখন তো নয় নয় করে প্রায় পয়ত্রিশের কাছাকাছি বয়স ও হয়ে গেল ওর,যৌবনের লাবন্য ও আজ অনেক টা ফিকে হয়ে এসছে।তবু স্নান করে রোজ ও আয়নার সামনে দাঁড়ায়,চুল আঁচড়ে,ক্রীম মেখে নিজেকে দেখে,কি খোঁজে ও,নিজের ক্ষয়ীষ্নু সৌন্দর্য ? প্রত‍্যেকটা মানুষ ই তো  বাইরের পৃথিবীর কাছে যেমন ই হোক, নিজের কাছে সব থেকে সুন্দর।
বছর পাচেক হল  সুরঙ্গমার বাবা সুসান্তবাবু ও রিটায়ার করে গেছেন,প্রাইভেট ফার্মের চাকরি,তাই পেনসন বলতেও তেমন কিছু নেই, এককালীন যা পেয়েছিল  রিটায়ারের সময়, তা ভাঙিয়ে আর এল আই সি পেনসন স্কিম র মাসিক কিছু সুদ ,সব মিলিয়ে সংসার টা কোনো রকমে চালিয়ে যাচ্ছেন। একটা ই চিন্তা কাটা র বিধে থাকে, মেয়েটার একটা গতি করতে পারলাম না,আমারা না থাকলে কি হবে ওর,কে দেখবে ওকে।
বি.এ পাশ করে একটা ছমাসের কম্পিউটার কোর্স ও করে ছিল, তবে তাতেও বিশেষ কিছু সুবিধা হয়নি, বাংলা মিডিয়ামের সাধারণ মেয়ে,না পারে ইংরিজিতে দুটো বুলি  আওরাতে,না আছে মেরিট,কে চাকরি দেবে ওকে।অগত্যা পাড়ার কটা টিউশনি এখন সম্বল,মাসের শেষে যা পায় ,হাত খরচা দু-পাঁচশ রেখে বাকি হাজার তিনেক মা র হাতে তুলে দেয়।
মানুষী দেবী এখনো স্বপ্ন দেখেন মেয়ের বিয়ে হবে,বেশ ধুমধাম করে দেবেন, তাই সংসার খরচা থেকে যতটুকু বাচে,সরিয়ে রাখেন মেয়ের ভবিষ্যতের জন্য।
– কি গো আজ আবার চিংড়ি মাছ আনলে,এত ঘন ঘন এত দামি দামি মাছ আনলে সংসার টা কি করে চালাবো বলতো,চারাপোনা আনতে পারো তো,খরচা টা একটু কমে।
-আরে এ সপ্তাহে তো একবার ই আনলাম,মেয়েটা চিংড়ি মাছ খেতে ভালোবাসে।
-এ মাস থেকে তোমার আমার ওষুধের খরচা টাও তো কত বেড়েছে, একটু চিন্তা করে তো চলবে।
স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সংসারের খুটিনাটি হিসেব নিকেষ চলতেই থাকে।
কিন্তু সুরঙ্গমা,ও যাবে কোথায়? কার কাছে ওর পাওয়া না পাওয়ায় হিসেব কষবে? কার বুকে মাথা রেখে একাকীত্বের গ্লানি কাটাবে?
ওর লড়াই টা কি লড়াই নয়?ওর না আছে রোজ অফিস ছুটে মান্থ এন্ডে টার্গেট মীট আপ করার লড়াই, না আছে স্বামীর পছন্দের রান্না করে বাচ্চার ন‍্যাপী পরিষ্কার করে সংসারী হয়ে ওঠার লড়াই, তবু আছে,একটা সাধারণ মেয়ের সাধারণ হয়ে বেচে থাকার লড়াই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *