সম্পাদকীয় কলমে গীতশ্রী সিনহা

সম্পাদকীয়

অন্য হেমন্ত

গান বা চলচ্চিত্র জগতের বাইরের মানুষজন কীভাবে দেখতেন তাঁকে !
সে রকম কিছু টুকরো স্মৃতি নিয়ে আজকের কলম। ‘ অন্য হেমন্ত ‘ কে ধরার চেষ্টা।
প্রথম জীবনে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় হতে চেয়েছিলেন সাহিত্যিক। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁর বাল্যবন্ধু, কৈশোরে সাহিত্যচর্চার সূত্রেই আলাপ হয়েছিল সন্তোষ কুমার ঘোষের সঙ্গে। তাঁদের অন্তরঙ্গ স্মৃতিচারণে এ-ই সব পাওয়া প্রত্যাশিত। তা ছাড়াও সাহিত্য মনস্ক হেমন্তকে নিয়ে স্মৃতিচারণে মুখর হয়েছেন প্রতিভা বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সমরেশ বসু, শঙ্করের মতো বিশিষ্ট সাহিত্যিক। অপরদিকে পি কে ব্যানার্জি – চুনী গোস্বামীর মতো খেলার মাঠের তারকা উচ্ছ্বসিত ক্রীড়াপ্রেমী হেমন্তকে নিয়ে। শৈশব থেকেই বন্ধুদের সঙ্গে গাছে উঠে গান গাইতে গাইতে খেলা দেখতেন… দেখেছেন ছাত্রজীবনেও।পরে, মুম্বাইতে থাকাকালীন চুনী গোস্বামীর অনুরোধে তিনি মোহনবাগান দলের অভিভাবকের ভূমিকা পালন করতে এগিয়ে আসেন। চুনী এ- প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘ মোহনবাগানের প্রতি ওঁর একটা টান ছিল। মুম্বাইয়ে শচীন দেববর্মণ ইস্টবেঙ্গল টিমকে দেখাশোনা করতেন। আমাদের কোনো অভিভাবক ছিল না। হেমন্ত দা কে যুক্ত করাতে পেরে এই অভিভাবকহীনতা আমরা কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলাম। ‘ টিম জিতলে নিজের বাড়িতে ডেকে আনন্দ করে খাওয়াতেন খেলোয়াড়দের। সম্পর্ক এতটাই অন্তরঙ্গ হয়েছিল, যে একবার মুম্বাই তে হেমন্ত খেলার টিকিট চাইতে এলে চুনী ‘ শর্ত ‘ দেন, এক্ষুনি গান শোনাতে হবে। হেমন্ত আবদার মেটাতে শুনিয়েছিলেন, খালি গলায়, তাঁর সে বছরেরনতুন গান, ” অলির কথা শুনে বকুল হাসে।” আবার পি কে জানাচ্ছেন, দাদার গাওয়া গাঁয়ের বধূ শুনে চোখে জল আসত। পরে খেলোয়াড় হওয়ার সুবাদে তাঁর খুব ঘনিষ্ঠ হলাম। কারণ তিনি ছিলেন নির্ভেজাল একজন ক্রীড়াপ্রেমিক। ”
সমরেশ বসু খুব দামি একটি কথা বলেছিলেন, ” সত্যি বলতে কি, সঙ্গীত জগতের লোক যেমন নই, তেমনি সঙ্গীতের সঙ্গে রীতিমতো যোগাযোগ বলতে যা বোঝায় তাও নই। কিন্তু কোনো কোনো গান কোনোদিনই বিদায় নেয়নি, নেয়ও না বোধহয়। আজকের শ্রোতারা নিশ্চুপে ওঁর গান শুনছে। ” নিজের লেখা ‘ বাঘিনী ‘ উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়নের সময় রেকর্ডিং শুনতে গিয়ে সমরেশ বসু খুব কাছ থেকে দেখেন হেমন্তকে। তিনি বলেছিলেন, ” কাছের মানুষকে কাজের মধ্যে দেখলেই বেশি ভালো লাগে। ”
অধ্যাপক নিমাই সাধন বসু লিখেছিলেন, একবার বসুশ্রী হলে একটি দাতব্য চিকিৎসালয়ের সাহায্যার্থে এক অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তিনি। হেমন্তের বাবা কালিদাস মুখোপাধ্যায় ছিলেন এই দাতব্য চিকিৎসালয়ের অন্যতম পরিচালক। সেই অনুষ্ঠানে হেমন্ত গান গাইবেন, এই পর্যন্ত খুবই স্বাভাবিক । কিন্তু না ! সবাই দেখলেন, হেমন্ত নিজে অনুষ্ঠানের মঞ্চ সাজাচ্ছেন, চেয়ার টেবিল সরাচ্ছেন, মাইক সেট করছেন, আবার সকলকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন।
খুঁটিনাটি সব দিকে তাঁর নজর, যে ভূমিকায় ভারত বিখ্যাত শিল্পী, তিনি ছিলেন বিষ্ময়কর একজন মানুষ। শিক্ষণীয় তাঁর চরিত্র গঠন। আমাদের ইতিহাসকে তিনি ধারণ করে রেখেছেন আজও।
আজ আর কাজের কথায় এলাম না, জাতীয় গৌরবের কথা বলতে পেরে ভালো লাগলো।
সবাই সুন্দর সম্পর্কে থেকো, মনে রেখো, যে সম্পর্ক কে টেনে নিয়ে যেতে হয় সেটা সম্পর্ক নয়, বোঝা, সম্পর্ক টেনে নিয়ে যাওয়া যায় না, টান থাকতে হয়। তাই বোধহয় বলে, বিশ্বাস আর নিঃশ্বাস একবার হারিয়ে গেলে আর ফেরত আসে না…
সম্পাদকীয় কলমে গীতশ্রী সিনহা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *