অরূণ আলোয় রবীন্দ্রনাথ মিতা ঘোষ

অরূণ আলোয় রবীন্দ্রনাথ
মিতা ঘোষ
………………………..,

হে বিশ্ব কবি, তুমি রবি
তোমার আলোয় বাংলা ভাষা আজ অম্লান
তোমাকে জানাই শত কোটি প্রণাম

শুনেছি দুঃখ না পেলে ভালো লেখা যায় না। তার জলজ্যান্ত প্রমান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বলতে গেলে জীবনভর তিনি অসংখ্য দুঃখ কষ্ট ভোগ করেছেন, আর সেই দুঃখই হয়তো তাকে অসাধারণ লেখক করে তুলেছে। প্রদীপের শিখার মতো জ্বললেও তার হৃদয়ে ছিল গভীর বেদনার অন্ধকার।
জমিদার পরিবারের সন্তান হয়েও তিনি জামাইদের কাছে যথেষ্ট অবহেলা ও অপমান সহ্য করেছেন। অকালে একটার পর একটা সন্তান হারানোর যন্ত্রণা সব মিলিয়ে আঘাতে আঘাতে তার হৃদয় জর্জরিত হয়েছে, আর তাই দিয়েই তিনি লেখনীর শিখরে আরোহন করেছেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ৭ মে ১৮৬১ সালে, কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারে।
পিতার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মাতার নাম সারদা দেবী।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেশিরভাগ সময় পরিচারিকাদের দ্বারা লালিত-পালিত হয়েছেন ।কারণ মাতা সারদা দেবী তার শৈশবেই মারা গিয়েছিলেন। পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারির বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকতেন এবং তিনি খুব ভ্রমণ করতেন।
সেই সময়ে বাংলার নবজাগরণের অগ্রভাগে ছিল ঠাকুর পরিবার। তারা সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশের আয়োজন করত সেখানে নিয়মিতভাবে বাংলা ও পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সংগীতের মঞ্চায়ন এবং আবৃত্তি হত।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবারে প্রতিভার ছড়াছড়ি ছিল। বড় ভাই দ্বিজেন্দ্রনাথ ছিলেন একজন দার্শনিক এবং কবি। আরেক ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন অভিজাত এবং পূর্বে সর্ব _ইউরোপীয় ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে নিযুক্ত প্রথম ভারতীয়। আরেক ভাই জ্যোতিন্দ্রনাথ ছিলেন একজন সঙ্গীতজ্ঞ, সুরকার এবং নাট্যকার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বোন স্বর্ণকুমারী ছিলেন একজন ঔপন্যাসিক।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী কাদম্বরী দেবী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সমবয়সী। তাই তাদের দুজনের মধ্যে খুব গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। যা তার সৃষ্টিশীলতাকে প্রভাবিত করে। কাদম্বরী দেবী রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন গল্প কবিতা নাটক আর গান রচনায় উৎসাহ যুগিয়েছেন তার সৃষ্টিশীল মতামত প্রদানের মাধ্যমে। তবে তাদের সম্পর্ক নিয়ে তখনকার সমাজে বিভিন্ন বিতর্কও সৃষ্টি হয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিয়ের পরপরই ১৮ ৮৪ সালে কাদম্বরী দেবীর আকস্মিক আত্মহত্যা ঠাকুরকে গভীরভাবে আঘাত করে , যা তার জীবনের সর্বপ্রথম বড় শোক।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৮৩ সালে মৃণালিনী দেবীকে বিবাহ করেন। তখন মৃণালিনী দেবীর বয়স ছিল মাত্র ৯ বছর। তাঁদের পাঁচ সন্তান_
মাধুরীলতা , রথীন্দ্রনাথ ,রেনুকা, মিরা সমীন্দ্রনাথ ।
১৯০২ সালের শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন মৃণালিনী দেবী অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে চিকিৎসার জন্য কলকাতা নিয়ে আসা হয়। ডাক্তার অসুস্থতার কারণ কিছুই ধরতে পারলেন না। ফলে তিন মাস রোগ ভোগের পর ১৯০২ সালের ২৩ শে নভেম্বর মাত্র ২৯ বছর বয়সে মৃণালিনী দেবীর মৃত্যু হয়। তবে কেউ কেউ বলেন অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে তার মৃত্যু হয়। তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স ছিল ৪১ বছর ৬ মাস। এটা ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আর একটা হৃদয়বিদারক মর্মান্তিক আঘাত।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম সন্তান মাধুরীলতা। কবিগুরু তাকে “বেলা ” বলেই ডাকতেন। আদর করে কখনোবা “বেলী” ও বলতেন। রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন লেখায় বিশেষত পত্র সাহিত্যে ” বেলী ‘নামের উল্লেখ দেখা যায়।

মাধুরীলতাকে মাত্র ১৫ বছর বয়সে শরৎচন্দ্র চক্রবর্তীর সাথে বিবাহ দেওয়া হয়। শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী পেশায় একজন আইনজ্ঞ ছিলেন।
মাধবীলতা দেবী নিঃসন্তান অবস্থায় মাত্র ৩১ বছর বয়সে ১৯১৮ সালে যক্ষ্মা রোগে মারা যান।বেলার মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথের জীবনে ও পরিবারে এক শূন্যতার সৃষ্টি হয়। একের পর এক সন্তানের অকাল মৃত্যু, রবীন্দ্রনাথকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে যিনি ইতিমধ্যেই ব্যক্তিগতভাবে উল্লেখযোগ্য ক্ষতি সহ্য করেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র রথীন্দ্রনাথ ছিলেন বহুমুখী প্রতিবার অধিকারী_একজন কৃষিবিদ, স্থপতি এবং চিত্রশিল্পী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষিত হয়ে তিনি পরে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হন। এত সাফল্য থাকা সত্ত্বেও তার ব্যক্তিগত জীবন ছিল বেশ দুঃখময়।
রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে বিবাহ হয় নীলনাথ মুখোপাধ্যায়ের বিধবা স্ত্রী প্রতিমা দেবীর সঙ্গে। রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে প্রতিমা দেবীর এই বিয়ে বিধবা প্রথার বিরুদ্ধে ঠাকুর পরিবারে প্রথম বিধবা বিবাহ। যদিও রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। তারা নিঃসন্তান থাকায় পারিবারিক ধারা অব্যাহত রেখে নন্দিনী নামের একটি মেয়েকে দত্তক নিয়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় কন্যা রেনুকার (রানী )জীবনকাল ছিল অসুস্থতার কারণে অতি সংক্ষিপ্ত। মাত্র ১০ বছর বয়সে সত্যেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের সাথে রেনুকা দেবীর বিয়ে হয়। নিঃসন্তান রেনুকা দেবী ১৯০৩ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে যক্ষ্মা রোগে মারা যান। রেনুর মৃত্যু ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় যে অসংখ্য আঘাতের মুখোমুখি হয়েছিলেন তার মধ্যে একটি .।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কনিষ্ঠা কন্যা মীরা দেবী(অতসী)। মাত্র ১৩ বছর বয়সে নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে তার বিবাহ হয়। তাদের দুটি সন্তান ছিল নিতিন্দ্রনাথ এবং নন্দিতা।

মীরা দেবী তার জীবনের শেষ বছর গুলি শান্তিনিকেতনে কাটিয়েছিলেন, সেখানে তিনি আশ্রমের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে গভীরভাবে জড়িত ছিলেন। মীরার তার বাবার দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি নিবেদিতপ্রাণতা নিশ্চিত করেছিল যে ঠাকুরের উত্তরাধিকার অব্যাহতভাবে সমৃদ্ধ হতে থাকে।
মীরা দেবী ৭৫ বছর বয়সে ১৯৬৯ সালে শান্তিনিকেতনে মারা যান। তবে এর আগে ১৯২০ সালে নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের মাধ্যমে তার দাম্পত্য জীবনের সমাপ্তি ঘটে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কনিষ্ঠ সন্তান সমীন্দ্রনাথ ঠাকুর (সমী) মাত্র এগারো বছর বয়সে ১৯ ০৭ সালে হঠাৎ কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মায়ের মৃত্যুবার্ষিকীতে তার মৃত্যু পরিবারের উপর গভীর প্রভাব ফেলে, যা রবীন্দ্রনাথের জীবনে আরেকটি ক্ষতির অধ্যায়ের সূচনা করে। পরবর্তী রচনাগুলিতে প্রায়শই ছড়িয়ে থাকা দুঃখকে আরো বাড়িয়ে তোলে।
এসবের মধ্যেই ১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন।
আবার ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ব্রিটিশ সরকার প্রদত্ত “নাইট” উপাধি ত্যাগ করেন তিনি।

মীরা দেবীর একমাত্র সন্তান ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একমাত্র দৌহিত্র নিতিন্দ্রনাথ ঠাকুর গঙ্গোপাধ্যায় , জার্মানিতে উচ্চ শিক্ষা নেওয়ার সময় যক্ষ্মা রোগে মাত্র কুড়ি বছর বয়সে ১৯৩২ সালে মারা যান। তিনি অকৃতদার ছিলেন। তার মৃত্যুর সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স ছিল ৭১ বছর।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বহুমুখী প্রতিভাবান। একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীত স্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। তাঁকে বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক মনে করা হয় এবং তাঁকে “গুরুদেব” “কবিগুরু “ও “বিশ্ব কবি” অভিধায় ভূষিত করা হয়।
১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য তিনি প্রথম অ ইউরোপীয় এবং প্রথম এশীয় হিসেবে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।
দীর্ঘ রোগভোগের পর ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট ৮০ বছর বয়সে কলকাতা জোড়াসাঁকোর বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
রবীন্দ্রনাথের জীবন ছিল দুঃখ আর সৃষ্টির এক অভূতপূর্ন মিলনস্থল ( অপূর্ব মিশেল)। তার দুঃখ বেদনাই তাকে অমর হতে সাহায্য করেছে ।

1 thought on “অরূণ আলোয় রবীন্দ্রনাথ মিতা ঘোষ

  1. পড়ে পুষ্ট হলাম,ঘটনা বহুল জীবনের
    কাহিনী শুনে,পড়ে অমূল্য লেখনীতে
    সম্পৃক্ত হলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *