রবীন্দ্রজয়ন্তী *** কলমে – উজ্জ্বল কুমার দত্ত।

রবীন্দ্রজয়ন্তী
কলমে – উজ্জ্বল কুমার দত্ত।
“”””””””””””””””””
রবীন্দ্রজয়ন্তী বা পঁচিশে বৈশাখ বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক উৎসব। বাংলা বর্ষপঞ্জিকা অনুসারে, প্রতিবছর বৈশাখ মাসের ২৫ তারিখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে এই উৎসব পালিত হয়। এ বছর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৪-তম রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপিত হতে চলেছে। ভারত, পশ্চিমবঙ্গ-সহ অন্যান্য রাজ্য এবং বাংলাদেশ, ব্রিটেন , আমেরিকা ও বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলে বিপুল উদ্দীপনার সঙ্গে এই উৎসব পালন করা হয়। বহির্বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের বসবাসকারী বাঙালিরাও এই উৎসব পালন করেন। পশ্চিমবঙ্গে এই দিনটি ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়। রবীন্দ্রজয়ন্তী উৎসব উদযাপনের অঙ্গ হলো রবীন্দ্রসংগীতানুষ্ঠান, নৃত্যানুষ্ঠান, রবীন্দ্রনাট্যাভিনয়, রবীন্দ্ররচনাপাঠ, আলোচনাসভার আয়োজন ও নানাবিধ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। রবীন্দ্রস্মৃতিবিজড়িত ভবনগুলোতে এই সময় বিশেষ জনসমাগম দেখা যায়। পশ্চিমবঙ্গে রবীন্দ্রজয়ন্তীর প্রধান অনুষ্ঠানগুলো আয়োজিত হয় কলকাতায় অবস্থিত কবির জন্মস্থান জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি, রবীন্দ্রসদন এবং শান্তিনিকেতনে। এছাড়া শিলাইদহ কুঠিবাড়ি ঘিরেও একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায়ও রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপন করা হতো। ঘটা করে, সাড়ম্বরে এ দিবসটি পালনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি বাঙালির ভাষা ও সাহিত্য, শিক্ষা ও সংস্কৃতি, মন-মানসিকতা বিকাশে রবীন্দ্রনাথের গৌরবোজ্জ্বল অবদানের প্রতি ঋণ স্বীকার করে। কিন্তু এ রবীন্দ্রজয়ন্তী সৃষ্টির পেছনে রয়েছে এক সুমহান ইতিহাস। যা আমরা অনেকেই জানি না। জেনে নেয়া যাক, রবীন্দ্রজয়ন্তীর ইতিহাস এবং রবীন্দ্রনাথ তার রবীন্দ্রজয়ন্তীকে কোন দৃষ্টিতে দেখতেন! ১৮৮৬ সালের ২৫-শে বৈশাখ শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠিতে লিখছেন, ‘আজ আমার জন্মদিন। পঁচিশে বৈশাখ-পঁচিশ বৎসর পূর্বে এই পঁচিশে । বৈশাখে আমি ধরণীকে বাধিত করতে অবতীর্ণ হয়েছিলুম। জীবনে এখন আরও অনেকগুলো পঁচিশে বৈশাখ আসে এই আশীর্বাদ করুন। জীবন অতি সুখের।’ এইটুকু পড়ে পাঠকের মনে হতে পারে রবীন্দ্রনাথ নিজের জন্মদিন নিয়ে বেশ সচেতন ছিলেন। কিন্তু এই ধারণা ভেঙে যাবে যদুনাথ সরকারকে লেখা অন্য একটি চিঠিতে। সেখানে কবি লিখেছিলেন, “এই সমস্ত বাহ্য আড়ম্বরের উদ্যোগ আয়োজনে আমি যে কিরূপ সঙ্কোচ অনুভব করিতেছি তাহা অন্তর্যামীই জানেন।” রবীন্দ্রনাথ নিজের জীবদ্দশায় নিজের জন্মদিন উদযাপন নিয়ে একেবারেই উৎসাহী ছিলেন না। তাই ২৬ বছর বয়সে তার প্রথম জন্মদিন উদযাপিত হয়। তারপরও কবির জন্মদিন আরও ২২ বছর ঠাকুরবাড়ির অন্দর মহলের আড়ালে ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে কবি তার বিশ্বজোড়া গুণগ্রাহীদের আকুল আবেদন ফেরাতে পারেননি। ভক্তদের কাছে হার মেনেছেন কবি।
কবির জীবদ্দশায় রবীন্দ্রজয়ন্তী প্রথম উদযাপিত হয় ১৮৮৭ সালে, কবির তখন ২৬ বছর বয়স। কবির ভাগনি সরলা দেবীর
আত্মজীবনী ”জীবনের ঝরাপাতা” বইটিতে তিনি লিখেছেন, ‘রবিমামার প্রথম জন্মদিন উৎসব আমি করাই। তখন মেজমামা ও নতুন মামার সঙ্গে তিনি ৮৯ নং পার্ক স্ট্রিটে থাকেন। অতি ভোরে উল্টোডিঙির কাশিয়াবাগান বাড়ি থেকে পার্ক স্ট্রিটে নিঃশব্দে তার বিছানার কাছে গিয়ে বাড়ির বকুল ফুলের নিজের হাতে গাঁথা মালা বাজার থেকে আনানো বেলফুলের মালার সঙ্গে অন্যান্য ফুল ও একজোড়া ধুতি-চাদর তার পায়ের কাছে রেখে প্রণাম করে তাকে জাগিয়ে দিলুম। তখন আর সবাই জেগে উঠলেন-পাশেই নতুন মামার ঘর। রবির জন্মদিন বলে সাড়া পড়ে গেল। সেই বছর থেকে পরিজনদের মধ্যে তার জন্মদিনের উৎসব আরম্ভ হল।’ কিন্তু প্রকৃত অর্থে ও সর্বজনীনভাবে প্রথম রবীন্দ্রজয়ন্তী পালিত হয় ১৯১০ সালে, শান্তিনিকেতনে। কবি সেবার উনপঞ্চাশ থেকে পঞ্চাশে পা দিয়েছেন। বিপুল উৎসাহে আশ্রমিকরা রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করেছিলেন ‘আত্মীয়দের উৎসব’ নামে। রবীন্দ্রজয়ন্তী সাড়ম্বরে প্রথমবার পালিত হয়েছিল ১৯১২ সালে। সে বছর ৫০ পূর্ণ করে ৫১-তে পা দিয়েছেন কবি। রবীন্দ্রজয়ন্তীকে সফল করতে শান্তিনিকেতনের আশ্রমিকদের সঙ্গে প্রশান্ত মহলানবিশের নেতৃত্বে যোগ দিয়েছিলেন কলকাতা থেকে বেশ কিছু গুণীজন। তাদের মধ্যে ছিলেন, সত্যেন দত্ত, সুকুমার রায় ও রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। বেদ-উপনিষদ পাঠ করে এবং মালা পরিয়ে কবিকে বরণ করা হয়েছিল। কবির মনের কথা সেদিন অনুচ্চারিত থেকে গেলেও, তা প্রকাশ পেয়েছিল নেপাল চন্দ্র রায়ের ভাষণে। নেপাল চন্দ্র বলেছিলেন, ‘তোমরা সকলেই গুরুদেবকে ভক্তি কর, কিন্তু তাকে কখনো যেন ঈশ্বরের স্থানে বসিও না’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের এক মহান প্রাণপুরুষ, যার অস্তিত্ব কখনও মুছে ফেলা যাবে না। যেমনটা যায়নি ইংরেজি সাহিত্যে শেক্সপিয়ারকে। রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। যে নক্ষত্র আলো ছড়াতে থাকবে এবং সদা থাকবেন আমাদের হৃদয় পিঞ্জরে ও
সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন, আছেন এবং সদা থাকবেন আমাদের বিবেককে জাগ্রত করে।
(মতামত ব্যক্তিগত)