প্রবন্ধ :- নববর্ষের রবীন্দ্রনাথ ✍️ রাজা চক্রবর্তী

প্রবন্ধ :-
নববর্ষের রবীন্দ্রনাথ
✍️ রাজা চক্রবর্তী
নববর্ষ, বাঙালির জীবনে একটি আবেগময় অধ্যায়। নতুন বছরের প্রথম সূর্যোদয় যেমন নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়, তেমনি আমাদের সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে নববর্ষের সম্পর্কও গভীর। কিন্তু নববর্ষের আবহে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভূমিকা কেমন? কেবল কবিতা, গান, সাহিত্য, নাকি আরও কিছু?
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যজগৎ এতটাই বিস্তৃত যে জীবনের কোনো দিকই তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি। প্রকৃতি, প্রেম, দর্শন, সমাজ, রাজনীতি—সবকিছুতেই তাঁর অসামান্য দৃষ্টিভঙ্গির ছাপ পড়েছে। বাংলা নববর্ষও ব্যতিক্রম নয়। বরং বলা যায়, নববর্ষ উদযাপনের আধুনিক ধারা, বিশেষ করে পয়লা বৈশাখের যে উৎসবমুখর রূপ, তার অন্যতম রূপকার রবীন্দ্রনাথ নিজেই। তাঁর কবিতা, গান, নাটক, প্রবন্ধ এবং জীবনদর্শনের মধ্যে নববর্ষের অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়।
নববর্ষের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সংযোগ:-
নববর্ষকে রবীন্দ্রনাথ শুধুমাত্র একটি দিন হিসেবে দেখেননি, বরং এটিকে তিনি জীবনের নবজাগরণের প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর অনেক কবিতায় নববর্ষের নতুন দিনের ভাবনা এসেছে। উদাহরণস্বরূপ, “এসো, এসো, এসো, হে বৈশাখ, এসো এসো” গানটি আজও বাঙালির নববর্ষ উদযাপনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই গানে তিনি বৈশাখের রুদ্র রূপের মধ্যেও নতুন কিছুর সৃষ্টির ইঙ্গিত দিয়েছেন—
“প্রলয়কারী বন্ধনহারা,
আগুন বহো শূন্য-‘পারা,
ঝড়-বৃষ্টির অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।”
এখানে বৈশাখের ঝড় যেন পুরনো জীর্ণতাকে মুছে দিয়ে নতুন প্রাণের সঞ্চার করছে। নববর্ষ মানে শুধু নতুন বছর আসা নয়, বরং পুরনো দুঃখ, গ্লানি, হতাশা ঝেড়ে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার নতুন অনুপ্রেরণা। এই ভাবনাই রবীন্দ্রনাথ তাঁর সাহিত্যে বারবার তুলে ধরেছেন।
নতুন বছরের দর্শন ও রবীন্দ্রভাবনা:-
নতুন বছর মানে কেবল ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে যাওয়া নয়, বরং আত্মবিশ্লেষণের একটি সময়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রবন্ধ ও লেখায় বারবার বলেছেন, অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে, নতুন উদ্যমে সামনে এগিয়ে যাওয়াই সত্যিকারের নববর্ষ উদযাপন।
তাঁর “বিশ্বপরিচয়” বইয়ে তিনি লিখেছেন, “নতুন কিছু পাওয়া মানে পুরনো কিছু হারানো নয়, বরং পুরনোকে নতুনভাবে দেখা।” নববর্ষে আমরা যখন পুরনো স্মৃতির দিকে ফিরে তাকাই, তখন তা শুধুই অতীতচারিতা হওয়া উচিত নয়, বরং নতুন পথ খোঁজার উপলক্ষ হওয়া উচিত—এই শিক্ষা রবীন্দ্রনাথ আমাদের দিয়ে গেছেন।
নববর্ষ ও জাতীয় চেতনা:-
রবীন্দ্রনাথ নববর্ষকে শুধুমাত্র পারিবারিক বা সামাজিক আনন্দের বিষয় হিসেবে দেখেননি, তিনি একে জাতীয় চেতনার সঙ্গেও যুক্ত করেছেন। তাঁর মতে, নববর্ষ হলো নতুন আশা ও জাতীয় পুনর্জাগরণের সময়। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে যখন বাঙালির আত্মপরিচয়ের লড়াই চলছিল, তখন তিনি বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি এবং আত্মপরিচয়কে শক্তিশালী করার জন্য নববর্ষের মাহাত্ম্য তুলে ধরেছিলেন।
তিনি স্বদেশি আন্দোলনের সময় নববর্ষ উপলক্ষে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে বলেছিলেন, “নতুনকে আপন করো, আপনাকে নতুন করো।” এটি কেবল সাহিত্যিক কথা নয়, বরং একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক বার্তাও বটে।
আধুনিক নববর্ষ উদযাপন ও
রবীন্দ্রনাথের প্রভাব:-
আজকের দিনে বাংলা নববর্ষ মানে মঙ্গল শোভাযাত্রা, বৈশাখী মেলা, নতুন জামাকাপড়, হালখাতা এবং আনন্দ-উৎসব। কিন্তু এই সংস্কৃতির গভীরে রবীন্দ্রনাথের ছোঁয়া স্পষ্ট। তাঁর লেখা গান, কবিতা আজও নববর্ষের প্রাণসঞ্চারক শক্তি। বাংলাদেশে নববর্ষের দিন ‘এসো হে বৈশাখ’ গান দিয়ে দিন শুরু হয়, আর পশ্চিমবঙ্গে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুরে নববর্ষের শুভারম্ভ হয়।
আসলে, নববর্ষ আমাদের জন্য শুধুই উৎসব নয়, এটি আমাদের আত্মপরিচয়ের প্রতীক, আমাদের সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। আর এই পরিচয় গঠনে রবীন্দ্রনাথের অবদান অনস্বীকার্য। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন, নববর্ষ কেবল একটা তারিখ নয়, এটি নবজাগরণের আহ্বান।
উপসংহার:-
নববর্ষ আসে নতুন স্বপ্ন, নতুন আশা, নতুন সম্ভাবনা নিয়ে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সাহিত্য ও জীবনদর্শনের মাধ্যমে আমাদের শিখিয়েছেন, পরিবর্তনকে গ্রহণ করতে হবে, পুরনো বাধাকে অতিক্রম করতে হবে এবং সর্বদা নতুনের পথে এগিয়ে যেতে হবে। তাই নববর্ষের উৎসবে রবীন্দ্রনাথ কেবল কবিতায় নয়, আমাদের মননেও অমর হয়ে থাকেন।
পয়লা বৈশাখের সকালে যখন বাঙালি “এসো হে বৈশাখ” গানে মেতে ওঠে, তখন সেটি কেবল গান নয়, বরং এক অনন্ত নবজাগরণের আহ্বান, যার উৎস রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাবনা ও দর্শন। নববর্ষ আসুক নতুন আলো নিয়ে, রবীন্দ্রনাথের মতো সৃষ্টিশীলতার স্পর্শ নিয়ে—এই হোক আমাদের কামনা।