ছোটগল্প #রবীন্দ্রজয়ন্তী ©মোনালিসা সাহা দে

ছোটগল্প
#রবীন্দ্রজয়ন্তী
©মোনালিসা সাহা দে
– “আপনি কি রবীন্দ্রনাথ নাকি? কবিতা লেখেন, সুর দেন, প্রবন্ধ আর গল্পও লেখেন? হাসালেন! বলি একটা দুটো পত্রিকাতে দু- একটা লেখা ছাপলো কি না ছাপলো, চলে এসেছেন আশা নিয়ে এত বড় দপ্তরে! স্যার ব্যস্ত মানুষ, উল্টোপাল্টা লোকের সাথে তিনি দেখা করেন না। যান যান, দূর হন এখান থেকে! ধাপ্পাবাজির আর জায়গা পাননি?”
মনটা বিরক্তিতে ভরে উঠল দীপ্তর। সে কি একবারও বলেছে যে সে রবীন্দ্রনাথ? উপন্যাস আর নাটক কি আদেও লেখে সে? নাকি লিখলেই সে কোনোদিন ওই মানুষটির নখের যোগ্যও হতে পারবে? তবু সেটুকু সে চর্চা করে থাকে, সেটুকু বললে এমন বিদ্রুপ শুনতে হবে?
– “যদি একবার আমার নামটা ওনাকে গিয়ে বলেন। বলবেন দীপ্ত মজুমদার এসেছেন। উনি আমাকে বলেছিলেন সময় পেলে যেকোনো বুধবার দুপুরের দিকে একবার ওনার দপ্তরে এসে দেখা করতে, রোজগারের পথ দেখাবেন উনি।”
একটু যেন দমে গেল উগ্র মেক আপে নিজের প্রকৃ্ত সৌন্দর্য্য ঢেকে ফেলা যুবতীটি।
– “কবে বলেছিলেন? অ্যাপোএন্টমেন্ট আছে কোনো?”
– “না। তা তো নেই। আসলে ফেসবুকে আমার লেখা এক প্রবন্ধের কমেন্টে বলেছিলেন উনি। ওনার প্রোফাইলে এই দপ্তরের নাম দেওয়া ছিল, তাই ভাবলাম আজ তো বুধবার, একবার দেখা করি আজ!”
– “হাঃ হাঃ! হোঃ হোঃ! আপনি ফেসবুকে লেখেন বুঝি? এই যোগ্যতা নিয়ে এখানে এসে পড়েছেন? স্যার মন রাখতে একটা কমেন্ট করেছেন কি করেননি…!”
– “একবার নামটা বলেই দেখুন।”
– “দাঁড়ান!”
অবশেষে কি যেন ভেবে প্রতীক বাবুর পি.এ. ঢুকে গেলেন ভিতরে। ফিরলেন বেশ কিছুক্ষণ পরে।
– “যান তো মশাই, যান এখান থেকে।”
-“কি হল?”
– “যান বললাম তো!”
কিছুই বোঝা গেল না। তবু্ এত অসম্মানের পর আর দাঁড়িয়ে থাকাও যায়না। প্রখর রোদের গ্রীষ্ম-দুপুরে দীপ্ত বাড়ির পথ ধরতে চলল।
খুব আশা নিয়ে বড় মুখ করে বাবাকে বলে এসেছিল, তার লেখার জোরে রোজগার করার পথ খুঁজে পেয়েছে সে। প্রথাগত পথে না হেঁটেও সংসারের হাল ধরা সম্ভব। কিন্তু তার সব আশায় জল পড়ে গেল আজ। নাকি তার আশা করাতেই ভুল ছিল? ম্যাসেঞ্জারে অভ্যস্ত নয় সে কোনোকালেই। খুলে দেখতেও ভালো লাগে না। অবশ্য তার মত ত্রিশ বছর বয়সের টিউশনি করে বেড়ানো রোজগারহীন সাহিত্যপ্রেমী যুবককে কেউ মেসেজ করেও না। তবু আজ হুট করে সরাসরি ভদ্রলোকের দপ্তরে না গেলেই সে পারতো। অনেকের মত যদি প্রতীক বাবুর সাথে মেসেঞ্জারে কথা বলে নিত, নিশ্চয় তাকে আজ এভাবে খালি হাতে ফিরতে হত না!
মোটামুটি নামকরা ওই পাক্ষিক পত্রিকার দপ্তরের বাইরেই এক চায়ের দোকান। এমনিতে কোনো কিছুরই নেশা নেই তার, সাহিত্য টুকু ছাড়া। তবু আজ এক কাপ চা খেয়ে মেজাজ টা ঠিক করতে বসে গেল সে।
সেখানে দুই ভদ্রলোকের কথোপোথন এইরূপ চলছে…
প্রথম জন- “আরে মশাই, কাল স্কুলে ছুটি তো কি হল, এক্সট্রা ঝামেলা আর খরচটা দেখছেন না? স্কুলে একটা অনুষ্ঠান তো থাকছেই, তাতে যেতেই হবে। আমি যে আবার বাংলার মাষ্টার। তাতে আবার বিকেলে মেয়ের নাচের প্রোগ্রাম সংস্কৃতি মঞ্চে, সেটা ভাবুন।”
দ্বিতীয় জন- “হ্যাঁ এটা ঠিকই বলেছেন। জীবনে উটকো ঝামেলার আর শেষ নেই।”
দীপ্ত মনে মনে হাসলো, হতাশও হল। কাল রবীন্দ্রজয়ন্তী। যে মানুষটাকে সে তার অনুভবের আদর্শ রূপে মানে, তাঁর জন্মদিন। দীপ্তর ঘরে জ্বলজ্বল করে সদাই বিকশিত হয় রবীন্দ্রনাথের অস্তিত্ব। আলাদা কোনো দিনে নয়, তার সত্তার সমস্তটা জুড়ে থাকে ওই দাড়িওয়ালা লোকটার অবদান। তবু কালকের দিনটা সে একটু আলাদা ভাবেই প্রতিবছর পালন করে থাকে। এই দিনটায় তার নিজের আঁকা রবীন্দ্রনাথের তৈলচিত্রটিতে ফুল- ফল-মিষ্টি, ধূপ-ধুনো সহযোগে শ্রদ্ধা নিবেদনকরে সে প্রতিবছর।
আজ এই চায়ের দোকানের বিদ্বানদের আলোচনা শুনে তার উঠে চলে যাওয়া ছাড়া আর কিছু করে লাভ নেই যদিও। একটু আগেই যা অভিজ্ঞতা হল!
বাড়ি ফিরে হাত পা ধুয়ে নিজের ঘরে ঢোকার আগেই অবসরপ্রাপ্ত বাবার উৎসুক মুখ দেখে মিথ্যা বলতে বাধ্য হল সে- “আজ বেশী কথা হয়নি, উনি একটু অসুস্থ। দুদিন পরে ডেকেছেন।”
– “কবে যাবি আবার।”
-“ওই তো! এগারোই মে।”
পিছনের ঘর থেকে অসুস্থ মা বলে উঠল- “বাবান এলি? কিছু হল?”
– “বাবার কাছে শুনে নিও মা”… বলেই তড়িঘড়ি নিজের ঘরে ঢুকে পালিয়ে বাঁচলো সে।
ঘরে ঢুকে দরজায় খিল দিয়ে রবীন্দ্রনাথের ছবিটার কাছে বসে চাপা অশ্রুতে ভেঙ্গে পড়ল সে।
– “বড়লোকরা কি এমনই হয়? সব প্রতিশ্রুতি ভুলে যায়? তুমিও কি তাহলে এমনই ছিলে? আমার সকল প্রতিভা কি তাহলে মিথ্যে?”
কিছুই ভালো লাগছে না আর দীপ্তর। কালকের দিনটার যাবতীয় আয়োজনের জন্যও যেন উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে সে।
হঠাৎই পাশের ঘর থেকে রেডিওর সুর ভেসে আসে তার কানে। মা এইসময় রোজই গান শোনে… “যায় যেন মোর সকল গভীর আশা প্রভু, তোমার কানে, তোমার কানে, তোমার কানে….”
“…নাঃ! উনিই আজ এই মুহূর্তে আবার আমায় আশার আলো দেখলেন, উনিই আমাকে বারবার বুঝিয়েছেন… “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে।”
দীপ্ত উঠে দাঁড়ালো। রবিঠাকুরের ছবিতে চোখে চোখ রেখে মনস্থির করলো আগামীকাল রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপনের সমস্ত ব্যবস্থা করবে সে। শুধু তার আগে সকালে উঠেই বাবা মা কে প্রকৃত সত্যটা জানিয়ে দেবে।
**
সকাল ছটার মধ্যেই উঠে পড়ে দীপ্ত। আজ ঘুম ভেঙ্গে গেছে সাড়ে পাঁচটাতেই। এখনও মা বাবা কেউই ঘুম থেকে ওঠেনি।
মোবাইলটা হাতে তুলে নিয়ে ফেসবুক খুলল সে। কিন্তু কিছুই ভালো লাগছে না তার আজ। হঠাৎ কি মনে হল, অনেকদিন পরে আজ মেসেঞ্জারে ঢুকলো। অনেকগুলো আনরিড মেসেজ, বেশীর ভাগই গুড মর্নিং এর ছবি।
আরে ওই ভদ্রলোকের মেসেজ এসে পড়ে আছে তো কয়েকটা!
হাত কাঁপতে শুরু করেছে তার।
প্রবল উত্তেজনায় ক্লিক করলো দীপ্ত।
সাত দিন আগের মেসেজ…
“ভাই, আসতে বলেছিলাম যে, কবে আসবে?”
কাল রাতের মেসেজ…
“ভাই আজ তুমি যখন এসেছিলে তখন আমি হঠাৎ সুগার ফল করে অসুস্থ বোধ করছিলাম। আমার পি.এ. ঘরে ঢুকে আমার পরিস্থতি বুঝে আমাকে কিছু না জানিয়েই তোমাকে ঘুরিয়ে দিয়েছে। অবশ্য ওকে পুরো দোষ দেওয়াও যায় না। বিকেলে সব জানালো আমায়। তুমি কিছু মনে কোরো না ভাই। পরশু এগারো তারিখ চলে এস আমার কাছে। এত ভালো লেখো তুমি! আমার পত্রিকা তোমার কলমকে স্বাগত জানাতে চায়। আমার মোবাইল নম্বরও দিয়ে দিলাম।”
নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না দীপ্ত। অসুস্থতা? এগারো? বাবাকে তো সে এই সব কথাই বলল!!
অতি আশ্চর্যে দীপ্ত হতবাক হয়ে আজ অবাক ভাবে স্থির। তবু আনন্দের বন্যা আপ্লুত করছে দীপ্তর দুই চোখ।
সামনের তৈলচিত্রে রবীন্দ্রনাথের দু চোখ যেন আজ অতি জীবন্ত। মুখে হাল্কা হাসির রেশ।
—-(সমাপ্ত)—-
©মোনালিসা সাহা দে