# সীমান্ত # পর্ব – ৫ কলমে – অরণ্যানী

# সীমান্ত # পর্ব – ৫
কলমে – অরণ্যানী

(আবারও উল্লেখ করছি, এই কাহিনীর স্থান, কাল, পাত্র, সবই কাল্পনিক)
এবার মাস্টারদার চোখ পড়ল ওদের দিকে। ওদের হাবভাব দেখে মাস্টারদা কিছু আন্দাজ করলেন। কিন্তু জবা ইচ্ছে করেই ওদের অগ্রাহ্য করল। এবার মাস্টারদার চোখ পড়ল জবার দিকে। অস্বস্তিতে চোখ সরিয়ে নিলেন। সবাই হেসে উঠল। জবা ইচ্ছে করেই সকলের দিকে তাকিয়ে বলল – কী হয়েছে?
মাস্টারদা – জবা, একটু ঠিকঠাক জামাকাপড় পরে আসবি।
এবার সবাই সশব্দে হেসে উঠল। জবা সোজা হয়ে জামাটা পেছন দিকে টেনে দিল।
জবা – ও, এই ব্যাপার? তা বললেই হয়। অত হাসির কী হলো? আমার দিদি এসেছে, দিদির নাইটি পরে চলে এসেছি। অত বুঝতে পারিনি।
পতু — ওটা তোর দিদির নাইটি? তুই তো রোজই পরিস।
জবা – হ্যাঁ, দিদি দিয়েছে। তাতে?
মাস্টারদা ধমক দিয়ে সবাইকে চুপ করালেন।
মাস্টারদা –শোন্, কাল সকালে ঘুম থেকে একটু তাড়াতাড়ি উঠে, বাড়িতে কাজ থাকলে সেরে, খাওয়া দাওয়া করে মাঠে অস্ত্রশিক্ষা নিতে চলে আসবি। আমি সবাইকে বলে রেখেছি। ছেলেরাও সবাই আসবে। আজ বাড়ি গিয়ে দাদা, কাকা, বাবা, বা ভাইয়ের, কারুর জামা প্যান্ট সেলাই করে গায়ে ফিট করে নিবি। এবার থেকে ছেলেদের জামা প্যান্ট পরে অস্ত্রশিক্ষা নিতে হবে।
সকলে – এ বাবা, ব্যাটাছেলেদের জামা প্যান্ট মেয়েরা পরবে?
মাস্টারদা – হ্যাঁ, ওই পরেই সবাইকে অস্ত্রশিক্ষা নিতে হবে। যে না পরে আসবে তাকে সারাক্ষণ কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখব। বুঝলি? এবার চুপচাপ পড়া কর।
সবাই পরস্পর মুখ চাওয়া চাওয়ি করে আবার পড়া শুরু করল।

ভুইস্ রাজতন্ত্র :-
বিশাল ভুইস্ দেশ এক সময় যুদ্ধ করেই দ্বিখন্ডিত হয়। দরিদ্র শোষিত অঞ্চল বিদ্রোহ করে অর্ধেক ভুইস্ দেশ দখল করে সেখানে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। আর বাকি অর্ধেক তুলনায় উন্নত, কিন্তু রাজতন্ত্রের অধীনেই থেকে যায়। দুই দেশের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পড়ে সীমান্তের কাঁটাতার। দুই দেশে যুদ্ধ প্রায়ই লাগে। এতো বড় একটা অঞ্চলকে হাত ছাড়া করে ভুইস্ রাজতন্ত্র শান্তিতে থাকতে পারে না। আবার ভুইস্ সমাজ তন্ত্রও উন্নতির জন্য রাজতন্ত্রের অঞ্চল দখলের চেষ্টা করে। ফলে এই জঙ্গলের সীমান্তে যুদ্ধ প্রায়ই হয়। এতো যুদ্ধের ফলে কাঁটাতারের বেড়া অনেক জায়গায় ভেঙে গেছে। সীমান্তে সেনাবাহিনীর ট্রাক ও পদাতিক সব সময় পহারা দিয়ে রেখেছে। এক চুল মাটিও কেউ কাউকে ছাড়বে না। সামান্য সুযোগ পেলেই এক দেশের সৈন্য অন্য দেশের খানিকটা দখল করে নেয়। যেই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সীমান্ত গেছে, তার নাম মুন্ডালের জঙ্গল।

মুন্ডালের জঙ্গল :-
উন্নত ভুইস্ রাজতন্ত্রে আজও মুন্ডালের মতো বিশাল বিশাল জঙ্গলে কিছু আদিবাসী সম্প্রদায় বাস করে। যদিও সংখ্যায় আগের চেয়ে অনেক কম। এরা গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনযাপন করে। কোনো কোনো গোষ্ঠীতে একশোরও বেশি মানুষ থাকে। কোনো কোনো গোষ্ঠীতে পঞ্চাশ ষাট জন। গোষ্ঠী বেশি বড় হয়ে গেলে নানা বিরোধের কারণে ভেঙেও যায়। ওরা সমাজের মূল স্রোত থেকে একটু দূরে। আবার আজকাল অনেকে ধীরে ধীরে মূল স্রোতে মিশেও যাচ্ছে। ফলে ওদের সংখ্যা কমছে। তবুও ওরা আছে। বাঁচার প্রয়োজনে জঙ্গলের কিছু নিয়ম কানুন ওরা মেনে চলে। তবে সে সব নিয়ম কানুন জীবনযাপনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে ওদের নিজেদেরই তৈরি। প্রত্যেক গোষ্ঠী বা দলে একজন দলপতি থাকে, যাকে দলের সকলে মেনে চলে। জঙ্গলে হিংস্র জন্তু থাকায় ওরা উঁচু মাচা করে তার উপর ঘর তুলে বাস করে। গাছের ডালপালা ও কাঠ দিয়ে ঘর বানায়। সভ্য জগতের সঙ্গে ওদের একেবারে যোগাযোগ নেই এমন নয়। অনেক সময় জঙ্গল সংলগ্ন লোকালয়ে গিয়ে ওরা জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করা ফলমূল, মধু, কাঠ ও শিকার করা মাংস বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহ করে। সেই অর্থ দিয়ে বস্ত্র, সাজের জিনিস, চাল, ডাল, মশলাপাতি ইত্যাদি খাদ্য উপকরণও সংগ্রহ করে।

ওদের প্রধান খাদ্য আগুনে ঝলসানো শিকার করা মাংস, বনের ফলমূল ইত্যাদি। আজকাল জঙ্গলের মধ্যে ফাঁকা জমিতে মেয়েরা কিছু কিছু ফসলের চাষও করে থাকে। কারণ সকলের পেট ভরার মতো শিকার রোজ মেলে না। সেছাড়া এটাও হয়তো ওরা বুঝেছে, যে রোজ পশু মেরে খেলে বনের জন্তুও একদিন শেষ হয়ে যাবে। তাই এই গভীর জঙ্গলের মধ্যে অপেক্ষাকৃত ফাঁকা জায়গাগুলোতে এক একটি গোষ্ঠী ঘর বাড়ি তুলে বাস করে। ফাঁকা জায়গায় ছোটখাটো ফসলের ক্ষেত থাকে। সাধারণত হিংস্র জন্তু যেদিকে কম, সেখানেই ওরা বাস করে। শিকার করতে অক্ষম কিছু বয়স্ক মানুষ ও যে সব নারীদের বাচ্চা আছে, তারা চাষের কাজে থেকে যায়। বাকি অল্প বয়স্ক নারী পুরুষ খাদ্য সংগ্রহে বেরিয়ে যায়। ছোট ছেলে পিলেরা মাচার উপরেই খেলে। একটু বড়রা নিচে দৌড়দৌড়ি করে খেলে বেড়ায়। এদের অনেকেই খাটো কাপড় পরে, আবার অনেকে পশু চামড়া বা গাছের ছালও পরে। এদের গায়ের রঙ বেশ কালো, বেঁটেখাটো ও সাধারণত বলিষ্ঠ চেহারার।

এমনই এক ছোট গোষ্ঠীর ছেলে মেঘ। বয়স আঠারো। গায়ের রঙ কালো ও মাথার চুল আদিবাসীদের মতোই ঝাঁকড়া। কিন্তু মাথায় অন্যদের চেয়ে একটু লম্বা। গোষ্ঠীর আর সকলের থেকে একটু অন্যরকম। এ গোষ্ঠীতে ওর বাবা, মা বা পরিবারের কেউ নেই। ও কীভাবে এ গোষ্ঠীতে এলো তা নিজেও জানে না। তবে গোষ্ঠীর জেষ্ঠরা সকলেই জানে। একদিন শিকারে গিয়ে দলপতি ও তার সঙ্গীরা, সাত আট বছরের একটি বালককে একা দেখে নিজেদের দলে নিয়ে আসে। ছেলেটিকে পরিচয়, বাসস্থান ইত্যাদি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে সে কিছুই বলতে পারে না। ফলে সেই থেকে সে এ দলেই রয়ে যায়। দলপতিই তার নামকরণ করে মেঘ। সেই থেকে মেঘ বলেই সকলে ওকে ডাকে।
(ক্রমশ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *