#স্মৃতি_রোমন্থন #বিষয়_সরস্বতী_পূজা

#স্মৃতি_রোমন্থন
#বিষয়_সরস্বতী_পূজা

সরস্বতী পূজা বলতে পুরোটাই স্মৃতি, অর্থাৎ সাড়ে তিন দশক আগের কথা। প্রথমেই যা চোখে ভাসে,তা হলো বাগান ভরা গাঁদা ফুল। কত রকম গড়নের,কত রঙের, কত বিচিত্র আয়তনের। তার মধ্যে যেটা বাসন্তী রঙের, সেটা রেখে দেওয়া হতো শুধু সরস্বতী পূজার জন্য। রাতারাতি চুরি তো হয়ে যাবেই, তাই আগের বিকেলে সাজি ভরে, ঝুড়ি ভরে ফুল তুলে নেওয়া হতো। অমনি সূচ সুতো নিয়ে বসে যেতাম মালা গাঁথতে। সমান আয়তনের ফুলগুলি বেছে নিয়ে কখনো একরঙা, কখনো দুই বা তিন রঙে সেজে উঠতো মালা। মনের উৎসাহ উচ্ছ্বাসও তাতে গাঁথা পড়তো নিঃসন্দেহে।
হারমোনিয়ামের বাক্সো নতুন চাদরে ঢেকে পেছনে একটা বড়ো নতুন বেডকভার ঝোলানো হতো। তার ওপর কাগজ কেটে নানা নকসা ফুটিয়ে সাজানো হতো। নতুন কাগজ সবসময় জুটতো না, পুরোনো ক্যালেন্ডারের উল্টো পিঠের সাদা দিকটা ব্যবহার করা হতো।
এদিকে আশেপাশের শরবন থেকে খাগ সংগ্রহ করে বাবা নিপুণ হাতে কলম বানিয়ে ফেলেছেন। ছোট ছোট দলে ছেলেমেয়েরা বাড়ির সামনে দিয়ে যেত নানান সামগ্রী নিয়ে, তাদের কাছ থেকে বেলপাতা,পলাশের কুঁড়ি, আমের মঞ্জরী জোগাড় হতো।
এর পরের আনন্দ ছিল দাদার সঙ্গে ঠাকুর কিনতে যাওয়া। স্টেশন সংলগ্ন বাজার থেকে ছোট বা মাঝারি মূর্তি ক্ষীণ আলোতে বেছে টেছে নিয়ে আসতাম, সঙ্গে ঘট, চাঁদমালা ইত্যাদি দশকর্মার বাজার। বাড়িতে এনে সেই মূর্তির যা অসম্পূর্ণতা আছে, যেমন বীণার তার, হাঁসের চোখ ইত্যাদি রং তুলির ছোঁয়ায় পূর্ণ করা হতো। সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেলে দেখে দেখে আর আশ মিটতো না। অনেক রাত অব্দি বারবার করে দেখতাম আমার নিজের হাতের ‘মণ্ডপসজ্জা’।
নিমপাতা, কাঁচা হলুদ, সর্ষে,আর সব কি কি বেটে যেন একটা মণ্ড তৈরি করতেন মা। তাতে সরষের তেল দিয়ে মাখা। সেটাকে মা বলতেন শ্রী। শ্রীপঞ্চমীতে ওটা মেখে স্নানের বিধি। চর্মরোগের প্রতিষেধক সন্দেহ নেই, কিন্তু ঐ শীতের ভোরে ঠাণ্ডা কনকনে ‘শ্রী’ মাথাটা বড্ডো আতঙ্কের ছিল। যাই হোক, কোনো রকমে শ্রীযুক্তা হয়ে স্নান সেরে মায়ের হাতে হাতে পুজোর জোগাড়। দোয়াতে দুধ ভরে ওপরে টোপা কুল দিয়ে খাগের কলমের সাথে রেকাবিতে সাজিয়ে রাখা, পুষ্পপত্রে নানারকম ফুল, বেলপাতা,চন্দন, দূর্বা এই সব নানা উপকরণ সাজিয়ে রাখা, ঘট, সশীর্ষ ডাবে সিঁদুর দিয়ে স্বস্তিক আঁকা এই সব।
এরপর পুজোর শেষে অঞ্জলি দেওয়া। সত্যি বলছি, ভীষণ ভক্তিভরে অঞ্জলি দিতাম। সারা বছর ফাঁকিবাজি ঐ ভক্তি দিয়েই পূরণ করার চেষ্টা আর কি! তারপর শাড়ি পরে স্কুলের পথে ছোটা। বাড়ি থেকে স্কুল ছিল দূরে, বাসে করে যেতে হতো। সঙ্গীসাথীর অভাবে প্রতি বছর যাওয়া হতো না। শাড়ি পরে নিজেকে সেদিন বেশ বড় বলে মনে হতো, কেউ অবশ্য পাত্তা দিত না। স্কুলেও পুজোর আগের দিন রঙিন কাগজের শিকলি বানানো, ঘট আঁকা, আলপনা দেওয়া, এসব কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকতাম। স্কুলের ঠাকুরকে প্রণাম করে প্রসাদ নিতাম। নানা রকম ফলের সঙ্গে ছোট ছোট দুটো নারকেল নাড়ু পেলে জীবন ধন্য হয়ে যেত। ক্লাস টেনের আগে স্কুলের খিচুড়ি খাওয়া হয়নি আমার। বাড়িতে এসে খিচুড়ি, বাড়ির গাছের বেগুন ভাজা, বাঁধাকপির ঘণ্ট, আলুর দম, কুল দেওয়া টমেটোর চাটনি, পাঁপড় দিয়ে সারা হতো মধ্যাহ্নভোজ। আহা! কী তার স্বাদ!
সারাদিন অনেকে আসতেন অঞ্জলি দিতে, প্রসাদ নিতে। কিন্তু সন্ধ্যার পর ভীষণ নির্জন হয়ে যেত বাড়ি। শঙ্খধ্বনিতে, ধূপধূনা, পঞ্চপ্রদীপে সন্ধ্যারতির শেষে একটু গান কবিতা আবৃত্তির দর্শকশূন্য ঘরোয়া আসর বসাতেন বাবা। দাদারা তখন চলে গেছে যে যার বন্ধুমহলে। বাবার আদেশে আমি গান গাইছি, আমার অনুরোধে বাবা আবৃত্তি করছেন। শ্রোতা আমার গর্ভধারিনী জননী আর স্বয়ং বাগদেবী। সমস্ত দোষ ত্রুটি ক্ষমা করে দু’জনের মুখেই স্মিত হাসি।
পরদিন ভোরে বেলপাতায় খাগের কলম দিয়ে লিখিত ভাবে মাকে প্রণাম জানানো হলে দধিকর্মা এবং দাদাদের সঙ্গে গিয়ে ঘট বিসর্জন। মূর্তি বিসর্জন দেওয়া হতো না, তিনি সারা বছর পূজিতা হতেন সম্বৎসরের ফাঁকিবাজি মেরামত করার দায় নিয়ে।
আমার এই প্রেমহীন, সঙ্গী বিহীন স্মৃতিচারণ কারোর ভালো লাগবে কিনা জানিনা, তবে মনের মণিকোঠায় সঞ্চিত হয়ে আছে সব।
পরিশেষে একটি ছোট্ট ঘটনা বলি। তখন আমি কলকাতার বাসিন্দা, পাড়ার তিনটে কুঁচো বাচ্চা সরস্বতী পূজার চাঁদা নিতে এসেছে, নিয়মমাফিক সরস্বতী বানান জিজ্ঞেস করায় ঠিক উত্তরও দিয়েছে। টাকা বার করতে করতে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আর পূজা বানান কি?” দুচার বার ঢোক গিলে বলে, ‘প-এ হস্সু… উনতু য-এ আকার। টাকাটা দিয়ে দাও না!” হায় রে! শেষ রক্ষা হলো না। ওটা যে সিলেবাসের বাইরের প্রশ্ন!

কলমে -সুনৃতা রায় চৌধুরী ©

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *