বাসন্তীর আরাধনা, ###মৌসুমী

বাসন্তীর আরাধনা,

#মৌসুমী

তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে সুবর্ণা, এই বাসন্তী রঙের শাড়ি টা তে।। অভীক এর কথায় লজ্জায় লাল হয়ে গেল সুবর্ণা।। একটু মুচকি হাসি হেসে সুবর্ণা বলল, তোমার পছন্দ অভী, কখনও খারাপ হয়! তারপর অভীর হাতটা আর একটু শক্ত করে ধরলো সুবর্ণা।। কী হলো বর্ণা?
চোখে ছলছল জল নিয়ে সুবর্ণা বলল, অভীক বাবা আমার বিয়ে সুবিনয় কাকুর ছেলের সাথে দেবে বলে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে।। তোমার কথা ভয়ে বলতে পারছি না।। তাহলে কি আমরা আর! বলেই থেমে গেল সুবর্ণা।।

অভীক সুবর্ণার কথা শুনে খানিক হেসে বলল, চলো ওই গাছের নিচে বসে কথা বলি।। দুজনে মিলে গঙ্গার ধারে একটা বড় বট গাছের নিচে বসলো।। অভীক যত্ন করে সুবর্ণার
হাতটা নিজের হাতের ওপর নিয়ে বলল, বর্ণা, আমি এই তিন মাস আগে কলেজের চাকরি টা পেয়েছি।। ছোট একটা বাড়ি আর বিধবা মা ছাড়া আমার আর কিছু নেই।। তুমি পারবে আমার সাথে সংসার করতে।। আমি পারবো অভী।। তুমি আমার পাশে থাকলে আমি পারবো, কথাটা বলে সুবর্ণা অভীকের হাতটা নিজের হাতের ওপর রাখলো।। বেশ, তাহলে কালকে আমি তোমার অপেক্ষা করবো বড় রাস্তায় সকাল দশটায়।। বিয়ে করে বউ করে ঘরে নিয়ে যাবো তোমাকে বর্ণা। তারপর, সূর্য অস্ত যাচ্ছিল, আর দুটি মন নতুন জীবন শুরু করার অনুভূতি তে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল।।

পরেরদিন সকালে সুবর্ণার বাবা কে খবরের কাগজ টা হাতে দেওয়ার সময় পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো! আজ হঠাৎ প্রণাম করছিস মা! পরীক্ষা আছে নাকি! চশমা টা পরতে পরতে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন রবীন বিশ্বাস, সুবর্ণা কিছু বলার আগেই তিনি বললেন, এই রবিবার সুবিনয় তার পরিবার নিয়ে আসবে।। তুমি বাড়িতে থেকো, কথাটা বলেই আবার খবরের কাগজে মন দিলেন বিশ্বাস বাবু।। সুবর্ণা ঘাড় নেড়ে স্নান করতে চলে গেল।।

ছোট বেলা মা মরা সুবর্ণা কথা কখনও শোনেন নি রবীন বিশ্বাস, সুবর্ণার বাবা।। তাঁর নিজের ইচ্ছে গুলো সুবর্ণার উপর চাপিয়ে দেওয়া টাই ওনার অভ্যাস।।
স্নান সেরে আলমারি থেকে মায়ের একটি লাল রঙের তাঁতের শাড়ি পরলো। হালকা বিনুনি, কপালে ছোট লাল টিপ, এবং হালকা প্রসাধনী তে খুব সুন্দর লাগছিল সুবর্ণা কে।। কলেজের ব্যাগে অভীকের দেওয়া বাসন্তী রঙের শাড়ি ছাড়া আর কিছু নিলো না।।

এক মাথা সিঁদুর পরে অভীকের বাড়ির দরজায় দাঁড়ানোর পরে পরম যত্ন করে শাঁখ বাজিয়ে ঘরে ভিতর নিয়ে এলো অভীকের মা তাঁর একমাত্র পুত্রবধূ কে।। রাতে অভীক সুবর্ণা কে বলল, বর্ণা তুমি আমাদের ছোট সংসার কে সাজিয়ে রেখো।। রাতের নিস্তব্ধ প্রকৃতি কে সাক্ষী রেখে অভীক সুবর্ণার বিবাহিত জীবন শুরু হলো।।।

ছোট থেকে মা মরা সুবর্ণা কে তার শ্বাশুড়ী নিজের হাতে সাংসারিক সমস্ত কাজ শিখিয়ে দিতেন পরম আদরে।। এমনভাবে একটা বছর পরে সুবর্ণা এবং অভীকের ঘর আলো করে তাদের একটি পুত্র সন্তান জন্ম নিলো।। অভীকের মা তাঁর আদরের নাতির নাম দিলো অনীক।। অনীকের জন্মের পাঁচ বছর পরে সুবর্ণার শ্বাশুড়ী পরলোকগমন করলেন।।

সুখে দুঃখে অভীক সুবর্ণার সংসার চলে যাচ্ছিল।। অনীক ও আস্তে আস্তে বড় হতে লাগল।। বাবার মতো মেধাবী অনীক।। পড়াশোনা খুব ভাল ছিল।। মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য অনীক পড়াশোনায় ডুবে গেল।। একদিন দুপুরে গায়ে ভীষণ জ্বর নিয়ে অভীক কলেজ থেকে বাড়ি এলো।। তিন দিনেও জ্বর না যেতে ডাক্তার দেখায়।। এক সপ্তাহ পরে পরীক্ষায় দেখা গেল অভীক ব্রেন ক্যান্সারে আক্রান্ত, last stage..

হাসপাতালে বিছানায় মৃত্যুর আগের দিন অভীক সুবর্ণার হাত ধরে ভীষণ আস্তে করে বলল, অনীক কে মানুষের মতো মানুষ করো।

কেটে গেছে পনেরো বছর।। অনীক আমেরিকায় কর্মরত।। ভীষণ ব্যস্ত তার জীবন।। তার স্ত্রী ঋতু ও সেখানে চাকরি করে, এবং এক মাত্র কন্যা তিতলি।। একদিন অনীকের ফোন এলো সুবর্ণার কাছে, সে দেশে ফিরে আসছে স্থায়ীভাবে।।

সুবর্ণার বয়সের ভারে শরীর দুর্বল হয়ে গেছিল।। সব সময় থাকে মালতী সংসারের সব কাজ করে।। একদিন রাতে অনীক সুবর্ণার ঘরে এসে বলে , মা আমি একটা ফ্ল্যাট কিনেছি যাদবপুরে।। আমার এবং ঋতুর কাজের সুবিধার জন্য।। তোমার জন্য একটি ভাল বৃদ্ধাশ্রম দেখেছি।। ওখানে তুমি ভাল থাকবে।। জীবনের সব পরিস্তিতি তে কখনও ভেঙে না পড়া সুবর্ণা ছেলের প্রস্তাবে এক কথায় রাজী হয়ে গেল।।

ও ঠাকুমা, এই নাও খিচুড়ি, আজকে সরস্বতী পূজা তাই আশ্রমে খিচুড়ি হয়েছে তোমাদের জন্য।।। সুবর্ণা খিচুড়ি মুখে দিতে মনে পড়লো অভীক ভীষণ খুশি হতো সরস্বতী পুজোর দিন সুবর্ণার হাতের খিচুড়ি ও বেগুনী খেতে।। বিকেলে অনীক তার স্ত্রী ঋতু এবং কন্যা তিতলি কে নিয়ে সুবর্ণা কে দেখতে এলো।।

মা, তোমাকে একটা কথা বলার ছিল, কথাটা বলে ঋতু ব্যাগ থেকে একটা দলীল বের করলো।। এটা আমাদের বাড়ির দলীল, তুমি এখানে সই করে দাও।। কী হবে বাড়ি টা রেখে, কথাটা বলে অনীক সুবর্ণার হাতে দলীল টা এবং একটি পেন ধরিয়ে দিলো।। সুবর্ণা তখন তার নাতনী তিতলি কে দেখছিল।। ঠিক সুবর্ণার যৌবনের রূপ তিতলি।। বাসন্তী রঙের শাড়িতে তিতলি কে ভারী মিষ্টি লাগছিল।। সুবর্ণা কোন কথা না বাড়িয়ে নাতনীর থেকে চোখ সরিয়ে দলীলে সই করে দিলো।। মনে মনে বলল, এ জগতে সেই বেশি চায় আছে যার ভুরি ভুরি!
সই করার পর দু এক কথা বলে অনীক বলে, এবার উঠি মা।। ঋতুর ক্লাবে অনুষ্ঠান আছে, আমাদের যেতে হবে।। তুমি সাবধানে থেকো।।।

সুবর্ণা বৃদ্ধাশ্রমে জানলা দিয়ে নীচে দেখলো, তিতলি গাড়ি থেকে নেমে ওপরে আসছে।। দৌড়ে দৌড়ে ওপরে উঠে ঠাম্মি কে জড়িয়ে ধরলো তিতলি।। Granny মা বাবা ছিল বলে তোমাকে বলতে পারি নি, এই শাড়ি তে আমাকে কেমন লাগছে?
সুবর্ণা তিতলি কে চুমু খেয়ে বলল, তোমাকে ভীষণ মিষ্টি লাগছে দিদিভাই।। কে দিয়েছে, তোমার মা।। তিতলি হেসে বলল, না granny আমার boyfriend সৌভিক দিয়েছে, আজকে ওর সাথে দেখা করতে বলেছে এই শাড়ি টা পরে।। সোনারপুরের বাড়ি তে ওই কিছু দিন তুমি আমার সব থেকে ভাল বন্ধু হয়ে গেছিলে।। তাই তোমাকে কথাটা বলতে ওপরে এলাম।। একদিন সৌভিক কে তোমার কাছে নিয়ে আসবো, কথাগুলো বলে তিতলি সুবর্ণা কে খুব আদর করে চলে গেল।।।।

অনীকের গাড়ি ছেড়ে দিলো।। তিতলি তার ঠাকুমা কে হাত নাড়িয়ে চোখের পলক ফেলার আগে অনেক দুর চলে গেল।।
বৃদ্ধাশ্রমের জানলা দিয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল সুবর্ণা।।।।
এই শহরে সরস্বতী পুজোর তারিখ বদলায়,পরিস্থিতি বদলায় কিন্তু আবেগ এবং অনুভূতি গুলো একই থেকে যায়।।।
তিতলি এবং সৌভিকের মধ্যে থেকে যাবে অভীক এবং সুবর্ণার প্রেমের গল্প যুগ থেকে যুগ তিলোত্তমার বুকে।।।

#মৌসুমী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *