সীমান্ত # পর্ব – ৩

কলমে – অরণ্যানী

(আবারও উল্লেখ করছি, এই কাহিনীর স্থান, কাল, পাত্র সবই কাল্পনিক)
মিনুর বাড়ি :- মিনুর মা তার বড় ছেলে অলোক ও স্বামী হীরনকে খেতে দিচ্ছে। অলোকের বয়স বছর কুড়ি, হীরন চল্লিশ ঊর্ধ্ব। মিনুর মা শোভার বয়স চল্লিশের একটু কম।
অলোক — খেয়ে উঠে একটু বিশ্রাম নিই। তারপর তো অস্ত্রশিক্ষা নিতে যেতে হবে।
মা -— আবার অস্ত্রশিক্ষা? সকালে নিলি না?
অলোক – হ্যাঁ। তাতে কী? শোনা যাচ্ছে যুদ্ধ যে কোনো সময় লাগতে পারে।
হীরন — আমাদেরও কি নিতে বলছে?
অলোক – প্র্যাকটিস রাখতেই পারো। দরকার তো হতেই পারে, তাই না?
শোভা – হ্যাঁ, সীমান্তের গ্রাম। যত ঝামেলা তো সব আমাদেরই। অথচ দেখো, ভেতর দিকে যারা থাকে তাদের তো আর এরকম কথায় কথায় যুদ্ধ করতে হয় না?
হীরন – কী বলো। যারা ভালো অস্ত্রশিক্ষায়, তাদেরই গণসেনায় নেওয়া হয়। সে ভেতরের গ্রাম হোক আর সীমান্তের।
শোভা – তবে ভালো অস্ত্রশিক্ষায় হয়ে কাজ নেই।
অলোক – কী বলছো? দেশ রক্ষা করতে হবে না?
হীরন – চুপ করো। এসব যা তা বলো না। সেছাড়া সীমান্তের গ্রাম এ্যাটাক হলে যুদ্ধ সবাইকেই করতে হবে।
অলোক – হ্যাঁ, নাহলে গ্রাম রক্ষা পাবে কী করে?
শোভা – তোদের মাস্টারদা পারেও বটে। সবাইকে অস্ত্রশিক্ষা দিলেই কি সবাই পন্ডিত হয়ে যাবে?
অলোক – থামো তো। পন্ডিত তো হয় লেখাপড়া করে।
শোভা – ওই হলো আর কি।
অলোক -– অস্ত্রশিক্ষা নেওয়া থাকলে তবু বিপদের সময় অন্তত বাঁচতে পারবে।
শোভা – সেনার সামনে পড়লে কে জানে তখন কে বাঁচবে আর কে মরবে।
হীরন – থাক না এখন ওসব কথা। আর যুদ্ধ লাগলেই কি সেনা গ্রামে ঢুকে পড়বে? আমাদেরও তো সেনা বাহিনী আছে।
শোভা – এসবের আগে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে ঝিনুককে সীমান্তের গ্রাম থেকে পার করে দিই। তুমি তাড়াতাড়ি বিয়ের সমস্ত বন্দোবস্ত করে ফেলো।
ওদের দু’জনের খাওয়া হয়ে গেল। ওরা উঠে গেল। শোভা এঁটো বাসন তুলতে লাগলো।

মেলাতলা :- মেলাতলায় নানান খাবারের দোকান, মেয়েদের সাজের গহনার দোকান, বাচ্চাদের খেলনার দোকান, মহিলাদের ঘরকন্যার বাসন কোসন ও নানা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দোকান একটি বড় মাঠকে ঘিরে রয়েছে। মাঠে আছে একটি নাগরদোলা ও একটি ঘূর্ণিদোলা। মেলায় নানা বয়সের নারী পুরুষ ও বাচ্চাদের ভিড়। কবিতা একটা সাজের জিনিসের দোকানে এসে কাচের চুড়ি পছন্দ করছে। মিনু ওকে পছন্দ করতে সাহায্য করছে।
মিনু – এই দেখ্, লাল আর হলুদ চুড়ি মিশিয়ে কেন। তোর ওই লাল হলুদ জামাটার সঙ্গে মানাবে।
ওরা লাল আর হলুদ চুড়ি বাছতে লাগলো।
কবিতা – আবার সন্ধের আগে ফিরতে হবে। মিনু, তুই কিছু কিনবি না?
মিনু – আমি তো কালই কিনলাম। তুই দুল, হার, সব নিয়েছিস?
– হ্যাঁ। কিন্তু তুই মেলায় এলি, আর কিছুই কিনবি না?
– পয়সা তো সব কালই খরচ হয়ে গেছে।
–- আমি কিছু কিনে দিই?
– সবই তো কিনেছি।
– তবে চল কিছু খাই। কী খাবি বল? পয়সা আমি দেবো।
মিনু – আছে তোর কাছে?
কবিতা — যা আছে তাতে যা পাওয়া যাবে তাই খাব। বল না কী খাবি?
মিনু – তুই বল্ না।
ওরা খাবারের দোকানগুলোর কাছে এলো।
কবিতা – ফুচকা খাবি?
মিনু – হ্যাঁ।
কবিতা – চার আনার ফুচকা দু’জনকে দাও তো।
ওরা দু’জনে দ্রুত গোটা কয়েক ফুচকা খেল। ফুচকা ওয়ালাকে পয়সা দিয়ে দ্রুত পায়ে প্রায় ছোটার ভঙ্গিতে ওরা মেলাতলা থেকে ভিড় ঠেলে বেরিয়ে এলো।
গাঁয়ের পথ :-
গাঁয়ের পথ ধরে কবিতা ও মিনু দ্রুত পায়ে এগিয়ে চলেছে। বিকেলের রোদ সবে একটু পড়ে এসেছে। মাটির সরু পথ। এক ধারে আগাছার ঝোপঝাড়, দু’একটা পুকুর, ফলের গাছ, অন্য ধারে গৃহস্থের বাড়ি, ফলের গাছ, ঝোপঝাড় তুলনায় কম। সব বাড়িই মাটির। কোথাও বা একটি বড় উঠোনকে ঘিরে কয়েকখানা ছোট ছোট বাড়ি।
কবিতা — তোরগুলো তো কিছু দেখাই হলো না। কী কী কিনেছিস? কাল সকালে তোদের বাড়ি যাব, তখন দেখাস।
মিনু – সন্ধে তো এখন অনেক বাকি। এতো তাড়াহুড়ো করছিস?
কবিতা হঠাৎ মিনুর হাতটা টান দিয়ে পথের ধারে একটা বটগাছের নিচে ওকে নিয়ে এলো। মিনু অবাক হলো।
মিনু – কী হলো? কিছু বলবি?
কবিতা – হ্যাঁ, মানে ক’দিন থেকেই তোকে বলব ভেবেছিলাম। কিন্তু আমার মামার মেয়ে এসে নিয়ে চলে গেল মামার বাড়ি। তাই আর বলা হয়নি। কথাটা আমি কাউকেই বলিনি।
কবিতা মিনুর দিকে ভীতু ভীতু চোখে চেয়ে। মিনু ওর মুখ দেখে বুঝে ফেলল।
মিনু – কী কথা? প্রেমের? কার প্রেম, তোর?
কথাগুলো মিনুর মুখ থেকে খুব দ্রুতই বেরিয়ে এলো।
কবিতা – কাউকে কিন্তু বলবি না। বাড়িতে জানতে পারলে কী বলবে কে জানে।
মিনু কবিতার হাত ধরে ঝাঁকিয়ে বললো – বল না। বলব না কাউকে কথা দিচ্ছি। কিন্তু কেউ কোনদিনই জানবে না? কেন?
কবিতা – ও তো এখনো কোনো কাজ করে না, না।
মিনু – তা তোর ও টা কে? আমি চিনি তাকে?
কবিতা লাজুক গলায় বললো – বিজয়দা।
মিনু – কে? আমাদের পাড়ার বিজয়দা?
কবিতা -– হ্যাঁ। নতুন প্রেম। তার মধ্যে ওর সঙ্গে দু’দিন দেখা হয়নি। আজ যখন তোদের বাড়ি দুপুরে আসছিলাম, ও তখন ডেকে বললো বিকেলে বকুল তলার ঘাটে দেখা করতে। কী করি এখন?
মিনু -– তা প্রেমটা হলো কবে? আর কী করেই বা হলো?
কবিতা – পরে সব বলবো। এখন তো বলতে গেলে এখানেই সন্ধে হয়ে যাবে। চল্।
মিনু – কিন্তু আজ দেখা করবি কী করে? পড়তে যাওয়া আছে যে।
ওরা আবার চলতে লাগলো। দ্রুত পায়ে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলতে লাগলো।
কবিতা – একটুখানির জন্য তো। আমার না মনের মধ্যে কেমন যেন হচ্ছে। প্রথম প্রেম করতে যাব – – – কী বলবো – – – ওই বা কী জিজ্ঞেস করবে – – – কী করবে – – – কিছু তো জানি না। আমার বেশ ভয় করছে।
কবিতা আবারও মিনুর হাতটা চেপে ধরলো।
কবিতা –- তুই আমার সঙ্গে যাবি?
মিনু – দেরি তো হয়ে যাবে না? ও যদি অনেক কথা বলে? অনেক প্রেম করতে চায় তখন?
কবিতা – না না। আমি বলব যে আমরা পড়তে যাব। পরে কোনো সময় কথা বলব। সেছাড়া তুই একটু পাহারা দিবি কেউ আসছে কিনা।
মিনু -– ঠিক আছে।
বকুলতলার ঘাট :-
অনেক দিনের পুরনো সান বাঁধানো ঘাট। প্রত্যেক বর্ষাতেই ঘাটের চাতাল ডোবে। ফলে ভাঙাচোরা ও শেওলা ধরা। ঘাটে কিছু আগাছাও হয়েছে। এখন বর্ষা শেষে শরতের রোদে শেওলা শুকিয়ে গেছে। এ ঘাট মানুষ এখন আর ঘাট হিসাবে ব্যবহার করে না। সন্ধের পর মাতালরা বসে মদের আড্ডা নিয়ে। দিনের বেলা প্রেমিক প্রেমিকাদের মিলনের গোপন স্থান হিসাবে এ ঘাট ব্যবহৃত হয়। তার কারণ ঘাটের চারপাশে এতো অবাঞ্ছিত গাছপালা জন্মে গেছে যে তারা রাস্তা থেকে ঘাটটাকে আড়াল করে রাখে। আর ব্যবহার না হওয়ার ফলে বন-জঙ্গল কেউ কাটেও না।
সেই বকুলতলার ঘাটের তুলনামূলকভাবে একটু পরিচ্ছন্ন স্থানে নদীর দিকে মুখ করে রাস্তার দিকে পেছন ফিরে উদাস মনে বসে আছে বিজয়। প্রেমিকার জন্য প্রতীক্ষা করতে করতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে।
এই বিজয় পাড়ায় ভালো ছেলে নামে বেশ খ্যাত। পড়াশোনাও কিছুটা করেছে। হাইস্কুলেও পড়েছে। অস্ত্রশিক্ষায় বেশ ভালো। ফলে মাস্টারদার একজন প্রিয় ছাত্র। বয়স কুড়ির কাছাকাছি। চেহারা ভালো। চোখে মুখে বুদ্ধির ছাপ। শরীরে পূর্ণ যৌবন। গাঁয়ের অনেক কিশোরীর কাছেই আকর্ষণীয় পুরুষ। গায়ের রঙ মাঝারি।

এদিকে কবিতা বাড়ির বড় মেয়ে। তার নিচে একটি ভাই ও দুটি বোন আছে। কবিতা মিনুরই সমবয়সী। বড় মেয়ে হওয়ার কারণে মার সাথে ঘরের কাজে তাকে সাহায্য করতে হয়। ফলে এই বয়সেই গৃহকর্ম নিপুণা। গাঁয়ের অন্য ছেলে মেয়েদের মতো সেও মাস্টারদার কাছে লেখাপড়া শেখে ও অস্ত্রশিক্ষা নেয়। তার শান্ত ও মিষ্ট প্রকৃতির জন্য কারো সাথে ঝগড়া হয় না। তাই সকলেই তাকে পছন্দ করে। তবে কবিতার প্রিয় বান্ধবী হলো মিনু। অর্থাৎ মৃন্ময়ী। তবে মৃন্ময়ী নামে তাকে মাস্টারদা ছাড়া আর কেউ ডাকে না। কবিতা সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে মিনুকেই। তাই ওর সমস্ত মনের কথা ও মিনুকেই বলে। ফলে মিনুও তার সব কথা কবিতাকে বলে। কবিতার কাছে মিনু আকর্ষণীয় ওর সারল্য ও ছেলেমানুষীর জন্য। ওরা দু’জনেই পরস্পরের খুব বিশ্বস্ত বন্ধু ও পারস্পরিক বিশ্বস্ততা রক্ষা করে চলে। ঝগড়া ওদের কোনদিনই হয় না। কবিতার থেকে মিনুকেই দেখতে বেশি সুন্দরী। গায়ের রঙ ফর্সা। মুখ এখনো কচি মিষ্টি। কবিতাকেও দেখতে সুশ্রী। গায়ের রঙ মাঝারি। মিনুকে সকলে একটু ছেলেমানুষ হিসেবেই জানে। কারণ সমবয়সী অন্য মেয়েদের তুলনায় তার আচার আচরণ একটু অন্যরকম।
ফিরে আসা যাক আবার বকুলতলার ঘাটে। বিজয় পেছন ফিরে বসে। ঘাটের কাছে এসে কবিতা ও মিনু থামলো। তখন সূর্য অস্ত গেছে। সন্ধের একটু বাকি। পাখিরা কলোরব তুলে বাসায় ফিরছে। ওরা দু’জন ফিসফিসিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে।
কবিতা – এই, ভয় করছে। তুই ঘাট অবধি যাবি তো?
মিনু — আমি ঘাট অবধি যাব? না এখানে দাঁড়িয়ে পাহারা দেবো?
কবিতা মিনুর হাতটা চেপে ধরে বলল – না চল্। তোর লজ্জা তো করবে না?
মিনু – কেন? প্রেম তো করবি তুই। আমার কেন লজ্জা করবে?
কবিতা – ও তো পেছন ফিরে। যদি দেখতে না পায়?
মিনু – ডাকবি।
কবিতা – কী বলে?
মিনু – কেন, বিজয়দা।
কবিতা — এ বাবা, প্রেম করছে তো। দাদা কী করে হবে?
মিনু — তবে কী বলে ডাকবি? শুধু নাম ধরে? নাকি বরেদের যেভাবে ডাকে? এ বাবা, সত্যিই কী লজ্জা!
(ক্রমশ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *