আবছায়া / গীতালি ঘোষ

তৃতীয় পর্ব

এরপর আমি আর শৌণক সুধাদের গ্যারেজে ঢুকলাম। চাবি শৌণকের কাছেই ছিল। ওখানে গিয়ে আমাদেরৎ চক্ষু চড়কগাছ! যেন একটা বাচ্চাদের নার্সারি! ছোটদের খেলনা, দোলনা, নানারকম টেডি দিয়ে  যত্নে  সুন্দর করে সাজানো একটা ঘর। যেন মায়ের আকাঙ্ক্ষার বাস্তব রূপ। আমি  একটা কাঠের বাক্স পেলাম। বাক্সের ডালা খুলে যা দেখলাম, তাতে আমাদের বিশ্বাসের ভিত নড়ে গেল। বড় বাক্সের মধ্যে ছোট ছোট পাঁচটা বাক্স। প্রত্যেকটি বাক্সের মধ্যে সিল্কের কাপড়ের উপর একটা করে প্রেগন্যান্সি রিপোর্ট আর সুন্দর কাগজে বড় বড় অক্ষরে নাম লেখা…. দিয়া, রৌনক, স্নেহা, অরুণ, সাহিল। এর অর্থ,  সুধা প্রত‍্যেকবার অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পরে এমনি করেই আশা করে ভাবী সন্তানের নাম রেখেছে আর শেষে আশাহত হয়েছে। এরপর,  একটা ড্রয়ারের মধ্যে  আমি একটা অত‍্যাশ্চর্য বস্তু পেলাম। সুধা চ‍্যাটার্জির সাম্প্রতিক প্রেগন‍্যান্সি রিপোর্ট। শৌণক দেখে সঙ্গে সঙ্গে ইনটালিজেন্স ডিপার্টমেন্টে ফোন করে কি যেন বলল।

আমি শান্তা সেনকে ফোন করে গ‍্যারেজে ডাকলাম। তিনি এলে আমরা তাকে জিজ্ঞেস করলাম যে সুধার কোনো বয়ফ্রেন্ড আছে কি না। শান্তার কথায় জানতে পারলাম যে কোনো বয়ফ্রেন্ডের কথা উনি জানেন না। কিন্তু আর একটা কথা বললেন। টালিগঞ্জে ঋভুর এক ভাই আছে। তার সাথে কোনো কারণে ঋভুর মুখ দেখাদেখি বন্ধ থাকলেও সুধার সঙ্গে  ভালোই সম্পর্ক ছিল। এই নিয়ে  ঋভুর সঙ্গে  সুধার মাঝে মাঝে বেশ কথা কাটাকাটি হত। তবে ওদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যথেষ্ট ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল, একথাও শান্তা জানাতে ভুললেন না।

ইতিমধ্যে শৌণক আশেপাশের কিছু লোকজনের সঙ্গেও কথা বলেছে। কিন্তু সকলের মতেই এরা দুজনেই খুব ভালো মানুষ। তাদের নিজেদের মধ্যে কোনো ঝগড়া বিবাদ কেউ দেখেনি। এরা দুজনে প্রায়ই  এখানে ওখানে ঘুরতে যেত। মোটামুটি ভাবে দেখা যাচ্ছে যে ঋভু বা সুধা কারোর বিরুদ্ধেই এখানকার বাসিন্দাদের কোনো অভিযোগ নেই। তবে খুনটা কে করল? পুলিশ শ‍্যামলবাবুকেও থানায় ডেকেছিলেন কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করার জন‍্য। কিন্তু তেমন কোনো ক্লু পাওয়া যায় নি।

ঠিকানা ও ডিরেকশন জেনে নিয়ে  এবার আমরা টালিগঞ্জে ঋভু চ‍্যাটার্জির ভাই নয়ন চ‍্যাটার্জির বাড়ি পৌঁছোলাম। চারতলা বাড়ির একটা ওয়ান রুম ফ্ল‍্যাটে এই ভদ্রলোক থাকেন। বাড়িতেই ছিলেন, দরজা খুলে আমাদের দেখে খুবই অপ্রস্তুত মনে হল। পরিচয় দেওয়ার পরে বসতে বললেন। মুখে কি একটু অনিশ্চয়তার ছায়া দেখলাম? যাই হোক, শৌণক কথা শুরু  করল….
—  আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে আপনার ভাইএর স্ত্রী সুধা চ‍্যাটার্জি খুন হয়েছেন?
—  শুনলাম, শান্তা সেন ফোন করে জানিয়েছেন।
—  তো আপনি ওখানে গিয়েছিলেন?
—  না, আমি ঋভুর বাড়ি যাই না।
নয়নের গলার স্বর অত্যন্ত স্বাভাবিক  ও ঠাণ্ডা। আমার একটু আশ্চর্যই লাগল। পুলিশি জেরার মুখে এত ঠাণ্ডা মাথায় থাকা সত্যিই  অবাক হওয়ার মত। শৌণক আবার কথা শুরু করল….
—  এ ব‍্যাপারে আপনি কিছু আলোকপাত করতে পারেন?
—  দেখুন, ঋভুর সঙ্গে  আমার একেবারেই পটে না। বহুদিন ধরে ওর সঙ্গে  আমার মুখ দেখাদেখি বন্ধ। তবে সুধার সঙ্গে  আমার ভাব ছিল। ও মাঝেমাঝেই আমার ফ্ল‍্যাটে আসত। রান্না করত, আমরা একসঙ্গে খেতাম, আড্ডা মারত। ভীষণ হাসিখুশি মেয়ে সুধা। হঠাৎ কি করে যে এমন ঘটনা ঘটল বুঝতেই পারছি না।
হঠাৎই নয়ন দুহাতে মুখ ঢেকে বসল। এই ব‍্যাপারটাও আমার কাছে অভিনয় মনে হল। আদৌ এই খুনটা নয়নকে কোনো রকম কষ্ট দিয়েছে বলে তো মনে হল না! যার সঙ্গে  এতটাই ভাব, সে হঠাৎ এমন নৃশংস ভাবে খুন হয়ে  গেল,আর  তার কোনো শোক-দুঃখের চিহ্ন তো এই ভদ্রলোকের মধ্যে দেখা গেল না! শৌণকও তীক্ষ্ণ চোখে নয়নের হাবভাব লক্ষ‍্য করছিল।

ইতিমধ্যে শৌণকের কাছে খবর  এসে গেছে যে সুধা মারা যাওয়ার সময় প্রেগন‍্যান্ট ছিল। তাহলে? সন্দেহ এখন দুজনের  ওপরে গিয়েই পড়ল… সুধার স্বামী  ঋভু চ‍্যাটার্জি এবং এই নয়ন চ‍্যাটার্জি। শান্তার কথা থেকে জানা গেছে সুধার বন্ধু বান্ধব খুব একটা নেই। ওর কোনো বয়ফ্রেন্ডও নেই। তবে তো ব‍্যাপারটা একটু গোলমেলে বটেই।

ঋভু একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টে চাকরি করে। এমনিতে শান্ত মানুষ। সুধাকে ভালোবাসে মনে হয়। অসাবধানতাবশত যদি কিছু হয়ে  যায়  আর সুধার প্রাণ সংশয় হয়ে পড়ে, সেই ভয়ে সে নিজেই গিয়ে ভ‍্যাসেকটমি করে এসেছে সুধার অজান্তেই। এর অর্থই তো সে সুধার শরীরের জন‍্য উদ্বিগ্ন! সেই ঋভুই কি এমন করে হত্যা করবে নিজের স্ত্রীকে? আমার মাথাটা কেমন গুলিয়ে গেল। কিন্তু সুধা এবার প্রেগন‍্যান্ট হল কার জন‍্য? বিষয়গুলো আমাকে বেশ চিন্তার মধ্যে  ফেলে দিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *