ধারাবাহিক উপন্যাস

#ইচ্ছেপূরণ

 পর্ব--১

বিথীকা সাতদিন ধরে শুধু ক্রমাগত ভেবেছে আর ভেবেছে। এই সাতদিনের প্রতিটি মুহূর্তই তার ভাবনাটা সিরিয়াস ছিল।দুমাস পিরিয়ড পিছিয়ে যাওয়ার পরেও তার মনে হয়েছিল কোনো কারণে বন্ধ হয়েছে।এর আগেও তার পিরিয়ডের গন্ডগোল হয়েছিল।প্রায় আড়াই মাস বন্ধের পর নরম্যাল হয়েছিল।কিন্তু তখন সে নিশ্চিত ছিল এবং মাকে বলেওছিল।মার কথামতো ডাক্তার দেখানো ঠিক করতেই পিরিয়ড হয়ে গেল।

এবারে পরপর দুমাস পিরিয়ড বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও তিনমাসের ডেট পিছিয়ে যাওয়ার পিছনে যে কারণটা সে আশঙ্কা করছে সেটা সত্যি হলে পরিবারে বিরাট ঝড় উঠবে।তার বাবা মা দুই দাদা কেউ তাকে ক্ষমা করবে না।

তার বাবা অরুণাভ মজুমদার কড়া প্রকৃতির মানুষ হলেও দুই ছেলে আর একমাত্র মেয়েকে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে মানুষ করেছেন। বিথীর বড়দা বিতান কলেজে অধ্যাপনা করে।সে তার বন্ধুর বোন শ্রাবণীকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে। শ্রাবণী পেশায় প্রাইমারি স্কুলের টিচার।বিয়ের ব্যাপারেও অরুণাভ ছেলের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়েছেন।অনুষ্ঠান করে ধুমধাম করে বিয়ে দিয়েছেন। ছোড়দা বিলু মানে বিপ্লব সদ্য সরকারি চাকরিতে জয়েন করেছে।তারা তিন ভাই বোনই আগাগোড়া নামী ইংলিশ মিডিয়াম থেকে লেখাপড়া করেছে।বিথী ইংরাজি অনার্সের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী।গম্ভীর প্রকৃতির স্বল্পবাক বাবার আদুরে মেয়ে।একমাত্র মেয়ের প্রতি অরুনাভ একটু বেশিমাত্রায় দুর্বল।বাবার এই বেশি আদর প্রশ্রয় মা অনুরাধার একদম পছন্দ নয়।অরুণাভ পেশায় স্কুল টিচার। উত্তরাধিকার সুত্রে পারিবারিক অবস্থাও বেশ স্বচ্ছল। তার অবসর নিতে এখনও দু বছর বাকি।

বাবার আদর নতুন বৌদির ভালোবাসায়, মাঝে মাঝে মায়ের দাঁত খিঁচুনি আর কলেজের বন্ধু বান্ধবীদের নিয়ে বিথীর জীবন ভালোই কাটছিল।বিথীর পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি লম্বা দীঘল চেহারা আর মারকাটারি ফিগার ডাকসাইটে সুন্দরীদের হার মানায়।কিন্তু গায়ের রঙ বাদামি ঘেঁষা বলে টকটকে ফর্সা রঙের প্রতি তার মনে একটা দুর্বলতা আছে।বাবা বলে গায়ের রঙটা আর এক পোঁচ ফর্সা হলে মেয়েটা আমার ডানাকাটা সুন্দরী হত।

মাধ্যমিক পরীক্ষার পর থেকেই সে অসংখ্য রূপমুগ্ধ ছেলের মুগ্ধতা দেখেই বড় হয়েছে।এখনও পর্যন্ত কোনো ছেলে তাকে সেভাবে আকর্ষণ করতে পারে নি।কলেজে দু তিনজন লেকচারারের চোখেও সে মুগ্ধতা লক্ষ্য করেছে।তার দিক থেকে সামান্য সারা পেলেই তারা এগিয়ে আসত।এদের মধ্যে কাউকে যে কখনও ভালো লাগেনি এমনটাও নয়।কিন্তু ওই ভালোলাগাটুকুতেই শেষ।ভালোবাসা হলে প্রথম দেখাতেই একটা তীব্র আকর্ষণ থাকত বলেই তার ধারণা। সেই আকর্ষণ আর মুগ্ধতা থেকেই তো ভালোবাসার জন্ম হয়।তার এ পর্যন্ত সেরকম আকর্ষণ কোনো পুরুষের মধ্যে এখনও আসেনি। কলেজে তার বেশিরভাগ বান্ধবীর স্টেডি বয় ফ্রেন্ড আছে।হয়তো তাদের এই মেলামেশা ভবিষ্যতে বিয়ে পর্যন্ত গড়াতে নাও পারে। তার এই পাঁকাল মাছের মতো ছেলেদের থেকে পিছলে বেরিয়ে যাওয়া নিয়ে বন্ধুরা হাসি ঠাট্টা করে বলে–তোর একটা সাইকিয়াট্রিস্টের সংগে কনসাল্ট করা দরকার বিথী।নারী পুরুষের আকর্ষণ তো প্রকৃতিদত্ত।মেলামেশা করলে বা একটু আধটু সম্পর্কে জড়ালে কি বিয়ে করতে হবে?তুই মান্ধাতা আমলের যুগে পড়ে আছিস। আরে বাবা নিখাদ বন্ধুত্ব ও হতে পারে। নাকি তোর রূপের অহংকারে ছেলেদের তুচ্ছাতিতুচ্ছ জ্ঞান করিস?ইংরাজির কুনাল স্যার তো তোর জন্য ফিদা।আমি হলে ঝুলে পড়তে এক মুহূর্তও ভাবতাম না।হঠাৎ মিতালি বলে একজন বন্ধু বলল–আচ্ছা বিথী তুই সমকামী নোস তো?তোর চালচলন কিন্তু খুব সন্দেহজনক।

বিথী মুচকি হেসে বলল–তোর মনে হয়?আর হলেই বা কি।আমি তোদের মধ্যে কাউকে কি পার্টনার করার অফার দিয়েছি? এতদিনে আমার বিশেষ বান্ধবী কেউ থাকলে তোদের গোয়েন্দা চোখে নিশ্চয়ই ধরা পড়ত।আরে বাবা তোদের মতো আমার সহপাঠী ছেলে বন্ধুও তো আছে। তাদের সঙ্গে মেলামেশা আড্ডা সবটাই তো হয়। তোদের হয়তো স্টেডি বয়ফ্রেন্ড আছে। দ্যাখ ভাই আমি কলেজে এসেছি লেখাপড়া করতে।ছেলেদের সংগে ফষ্টিনষ্টি বা প্রেম করতে নয়।প্রেম করার জন্য ঢের সময় পাব।কিন্তু লেখাপড়ার সময়টা হারিয়ে ফেললে আর ফিরে পাবো না।ওরা বলল–আমরা তো ভাই লেখাপড়ার সংগে সংগেই একটু আধটু ইন্টুমিন্টুও করি।তাতে ক্ষতি তো কিছু হচ্ছে না।বরং লাভই হয়।শরীর মন দুটোই চনমনে থাকে।আমরাও তো স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন নিয়েই পড়তে এসেছি।

বিথী বলল–আমার রসায়নটা একটু অন্যরকম রে।আমি যার সঙ্গে বিয়ে করব বা প্রেম করব সে এখন থেকেই আমার জন্য সাধনা করছে।ওরা সমস্বরে বলল–সেই ভাগ্যবান ব্যক্তিটি কে তোকে বলতেই হবে।বিথী বলল–সে কে আমিও জানিনা। তবে নিশ্চয়ই একদিন খুঁজে পাব।

বিথী এই গাড্ডায় পড়ে ভাবছিল এরকম মনোভাব ধরে রাখতে পারলে সে লেখাপড়া শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারত।তারপর আর পাঁচজনের মতো বাবা মায়ের পছন্দে কিংবা নিজের পছন্দে ভবিষ্যতে কোনো প্রতিষ্ঠিত ছেলের সংগে বিয়েটা করত।কিন্তু সব ওলোট পালট হয়ে গেল রঙ্গমঞ্চে হঠাৎই অবনীর আগমনে।

অবনীকে প্রথম দিন দেখেই বিথী একটা অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ বোধ করেছিল।অবনী হল তার বড় বৌদির খুড়তুতো ভাই।নিজের খুড়তুতো ভাই নয়।বড় বৌদির বাবার খুড়তুতো ভাই য়ের ছেলে।অবনীর ছফুট দু ইঞ্চি হাইট।গৌরবর্ণ রঙ,সুদর্শন আকর্ষণীয় চেহারা আর পেটানো স্বাস্থ্য।সদ্য একটা কোম্পানিতে জয়েন করেছে। সে একদিন তার দিদির দেওয়া ঠিকানা মতো দেখা করতে এল। বৌদি তার সঙ্গে সবার পরিচয় করিয়ে দিল।কিন্তু সে ছেলে তাকে তেমন পাত্তা না দিয়ে শুধু আলাপটুকু করেই ছোড়দার সংগে আড্ডায় মশগুল হয়ে পড়ল।

এই পাত্তা না দেওয়াটা বিথীর ইগোকে প্রথম হার্ট করল।দীর্ঘদিন ধরে পুরুষের মুগ্ধ চোখ কিংবা লোলুপ চোখকে বিথী ইগনোর করেছে।আননোন ফোনে প্রেমের ভাষণ শুনে শুনে বিরক্ত হয়ে আননোন ফোন রিসিভ করাই বন্ধ করে দিয়েছে।অজস্র বানান ভুলে ভরা গোছা গোছা প্রেমপত্র ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছে।কিন্তু আজ তার কি হল?সে সুদর্শন ছেলে তো কম দ্যাখেনি। তাহলে এক দেখাতেই অবনীকে তার এত ভালো লাগছে কেন?সে তো ভীষণই বাস্তববাদী মেয়ে।ছেলেটির সঙ্গে ভালোভাবে আলাপ পরিচয় হল না,তার পরিবারের কথা জানা হল না অথচ দেখা মাত্রই অহংকারী ছেলেটাকে ভালো লেগে গেল?নাকি ছেলেটা তেমন পাত্তা দিল না বলেই আকর্ষণটা তীব্র হল?

ছোড়দা বড়দা বড় বৌদির সংগে আড্ডাতে সেও উপস্থিত ছিল।অবনী গল্পের মাঝে একবারও তার দিকে চোরা চোখে চাইলই না?অথচ সে নিজেই অবনীর গল্প আর মাঝে মাঝে প্রাণখোলা হাসি হাঁ করে গিলছিল।বৌদির কথায় বুঝল তার এই তুতো ভাইয়ের সংগে তার বেশ যোগাযোগ আছে।দু দফা চা কফি খাওয়ার পর বৌদি বলল–টুবাই আজ রাতে এখানে খেয়ে যাবি।আচ্ছা তুই আছিস কোথায়?বিথী মনে মনে বলল–বাব্বা বাবুর একটা ডাকনামও আছে?

অবনী বলল–মাস দুয়েক পিজিতে ছিলাম।এখন মানিকতলায় একটা ওয়ান রুম ফ্ল্যাটে থাকি।—তাহলে বাগমারি থেকে খুব কাছেই থাকিস। অবনী বলল–আজ থাক দিভাই।আমি বরং রবিবার আসব।–তাহলে সকালেই চলে আসিস।একবারে রাতে খেয়ে ফিরবি। আসল কথাটাই জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছিলাম।হ্যাঁ রে কাকু কাকিমা কেমন আছেন?অবনী বলল– বাবা ভালো আছে।মা একগাদা ওষুধের ওপর আপাতত ঠিক আছে।আজ আমি উঠছি দিভাই।হঠাৎ বিথীর দিকে চোখ পড়তেই বলল–আপনার সংগে সেভাবে আলাপ পরিচয় হল না। আজ আমার একটু তাড়া আছে।রবিবার দেখা হচ্ছে।

সেই থেকে অবনীর এই বাড়িতে এন্ট্রি।ইদানীং সব রবিবার ছাড়াও বাড়িতে ভালো মন্দ কিছু রান্না হলেই ফোন করে বৌদি তার পেয়ারের ভাইকে ডেকে পাঠায়।তিনিও দিভাই একবার ডাক দিলেই চলে আসেন এবং চোব্যচোষ্য খেয়ে রাত দশটা পর্যন্ত আড্ডা মেরে নিজের ডেরায় ফেরেন।তার ব্যবহারে তার গম্ভীর প্রকৃতির বাবা ও খিটখিটে মা ও মুগ্ধ।

প্রথম রবিবারেই বিথীর সংগে অবনী অনেকটা সময় কাটিয়েছিল।তার সাবলীল ব্যবহার ও কথাবার্তায় বিথীর মুগ্ধতা বেড়ে গিয়েছিল।ইদানীং অবনী আসাতে ছোড়দা আর বড়দার সান্ধ্য আড্ডা ব্যাহত হচ্ছিল বলে আধঘন্টা গল্প করার পর একটু আসছি ভাই বলে বেরিয়ে যেত।তখন যতো গল্প হত বিথীর সংগে।এভাবেই আস্তে আস্তে বিথীর অবনীর প্রতি ক্রমশ মুগ্ধতা বাড়ছিল।চাতক পাখির মতো অবনীর জন্য বিথীর অপেক্ষা করার সময় বিথী নিজেই অবাক হচ্ছিল।অথচ অবনী সবার সঙ্গে শুধু নির্ভেজাল আড্ডা দিত।বিথীর সঙ্গে একা গল্প করলেও চোখে চোখ রেখে গল্প করত।এই ছেলে নির্ঘাত তার দুর্বল তা কন্ট্রোল করে রাখত।কিন্তু বিথীর ক্রমশই জেদ চেপে যাচ্ছিল।সে নিজে এগিয়ে এসেও অপর পক্ষের নির্লিপ্ততা মেনে নিতে পারছিলাম না।

ক্রমশ–

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *