ধারাবাহিক উপন্যাস অধ্যায় – ১

সুদেষ্ণা সিনহা

আত্মজা

অলোক সান্যাল মফস্বলের ছেলে। নদীয়ার কৃষ্ণনগরের ঘুর্ণিতে তার পৈত্রিক বাড়ি। মাত্র একুশ বছর বয়সে সে যখন কৃষ্ণনগর গভর্নমেন্ট কলেজ থেকে দর্শন শাস্ত্রে অনার্স পাশ করে তখন তার দুরন্ত যৌবন। সে সময় মাস্টারমশাইদের বেতন কম থাকায় শিক্ষকের  চাকরির তেমন চাহিদা  ছিল না। যদিও অলোক সান্যালের  বাবা, শ্রদ্ধেয় অঘোর সান্যাল শিক্ষানুরাগী ছিলেন বলে তাঁর খুব ইচ্ছে ছিল, ছেলে শিক্ষক হোক।

বাবার ইচ্ছেতেই অলোক সান্যাল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন শাস্ত্রে এম.এ ক্লাসে ভর্তি হয় ।  সে যেমন সুদর্শন তেমনই ব্যক্তিত্বময়। একদিকে তার ছয় ফুটের মেদবিহীন পেটানো শরীর ,চওড়া কাঁধ,পুরুষালি লোমশ বুক ,লম্বা বাহু , মাথাভর্তি কোঁকড়া ঘন চুল, টিকালো নাক,ভাষাময় চোখ,বঙ্কিম ভুরু,মাঝারি ঠোঁটের  উপর চওড়া কালো গোঁফ,অন্যদিকে তার ভরাট গলার ভাটিয়ালি গান,উদাত্ত কন্ঠে স্বরচিত কবিতা পাঠ , অসাধারণ বাগ্মিতা তাকে সকলের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় করে তুলেছিল।  ইউনিভার্সিটির মেয়েরা  অলোক সান্যালের নামে পাগল। এসব অজানা নেই অলোকেরও। বরং মেয়েদের এই পাগলামি বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে সে। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে মেয়েদের নিয়ে গাছের তলায়  বসে বেশ আড্ডা চলে তার।

অলোক সখের কবি। বেশ কয়েকটি পত্র-পত্রিকায় তার লেখা কবিতা ছাপা হয়েছে। সাহিত্য সভায় সে কবি হিসাবে ডাক পায়। ইউনিভার্সিটির ছুটির দিন সকালে পায়জামা-পাঞ্জাবি  পরে, কাঁধে শান্তিনিকেতনি  ব্যাগ ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়ে সে। কোথায় যাচ্ছে নিজে থেকে কাউকে বলে না।

কোন দিন সামনাসামনি দেখা হয়ে গেলে রুমমেট প্রদীপ জিঞ্জেস করে কোথায় চললি ? আজ হোস্টেলে মাংস হচ্ছে।দুপুরে ফিরছিস তো?

অলোক ঘাড় নাড়ে।

– না রে। আজ একাডেমিতে প্রোগ্রাম আছে। ফিরতে দেরী হবে।

অলোকের ব্যভিচারী জীবনযাত্রা প্রদীপের অজানা ছিল না। সে জানত যে একাডেমি নয় ঘনিষ্ঠ   প্রেমিকাকে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে অলোক শহর থেকে অনেক দূরে। হোস্টেলে ফিরতে ফিরতে হয়তো তার রাত্রি ন’টা হবে।            

        দু’দিন অন্তর অন্তর অলোকের প্রেমিকা বদলে যায়। ইউনিভার্সিটিতে অলোককে নিয়ে তখন চাপা গুঞ্জন। সবটাই কানে আসত প্রদীপের। যতই হোক রুমমেট বলে কথা। এক ঘরে অনেকটা সময় তারা কাটায়। অলোকের চারিত্রিক বদনাম সহ্য হতো না প্রদীপের।

একদিন রাতে টেবিল-ল্যাম্প জ্বেলে বইখাতা নিয়ে বসে কি সব লেখালেখি করছিল অলোক। প্রদীপ তার বিছানায় শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছিল অনেকক্ষণ ধরে। কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছিল না তার। মাথা জুড়ে অসহ্য যন্ত্রণা।

হঠাৎ বিছানায় উঠে বসে প্রদীপ।অলোককে বলে, একটা কথা জিঞ্জেস করব তোকে? ঠিকঠাক উত্তর দিবি?

অবাক হয়ে লেখা থামিয়ে খাতা থেকে মুখ তোলে অলোক।

– বল্। বল্ কি জানতে চাস?

– ইউনিভার্সিটিতে ওরা তোর নামে যা বলে, সে সব কি সত্যি?

আলো-আঁধারিতে অলোক যেন কিছুটা চমকে ওঠে।তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে আত্মপ্রত্যয়ের সাথে বলে,কারা বলে? কি বলে? বল্, কি বলে?

 – আমাদের ক্লাসের ছেলেমেয়েরা বলছে তুই নাকি…

– আমি কি?

-তুই নাকি প্রেমের খেলায় মেতে উঠেছিস। একটার পর একটা মেয়েকে নিয়ে শরীরী খেলায় মেতে উঠেছিস।

        প্রদীপ ভেবেছিল এই সব কথা শুনে রেগে যাবে অলোক। কিন্তু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ হো হো করে অট্টহাস্যে মেতে ওঠে অলোক।

– ইয়ার উস্ আদমি লোগোকো বাত ছোড় দো। জগতের নিয়মই এই তুই যখন এগিয়ে যাবি তখন আর পাঁচটা লোক তোর সমালোচনা করে তোকে পিছিয়ে দেবে। বুঝলি?

একটু থেমে বোতল থেকে ঢক ঢক করে গলায় জল ঢালে অলোক। কিছুটা নীরবতা। ঘড়ির কাঁটার টিক টিক আওয়াজ বেশ সুস্পষ্টভাবে কানে আসে।   

         গভীর দৃষ্টিতে প্রদীপের দিকে তাকায় অলোক বেশ কিছুক্ষণ ধরে। একসময় চোখের দৃষ্টি সরিয়ে নেয় তার মুখ থেকে।তারপর গম্ভীর ভাবে বলে, তোকে একটা কথা বলি প্রদীপ।আশা করছি এই কথাটা চিরদিন তুই মনে রাখবি।

       প্রদীপ অপলক চোখে চেয়ে আছে অলোকের দিকে নীরবে। মনে মনে সে বলে, আমি জানি তোর কিচ্ছুটি বলার নেই।

– শোন প্রদীপ, আমার পেছনে টিকটিকির মতো লেগে থাকতে হবে না তোকে। তোর পড়াশোনার কাজটা তুই ঠিকভাবে কর্। আমার দিকে মন দিয়ে সময় নষ্ট করিস না।

      প্রদীপ বুঝতে পারে অলোক তার ব্যক্তিগত ব্যাপারে তার সঙ্গে কোন কিছুই আলোচনা করতে চায় না। মনে মনে সে ঠিক করে নেয় ধীরে ধীরে অলোকের ছায়া থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবে সে। আর মাস খানেক পরেই তাদের স্টাডি লিভ। দরকার হলে সে বাড়ি গিয়ে এম.এ পরীক্ষার প্রস্তুতি নেবে, তবুও কিছুতেই সে অলোকের সঙ্গে থাকবে না।

জয়িতা বসেছিল হেঁদুয়া পার্কে একটা ফুরুস ফুলের গাছের নীচে। বিকেলের ম্লান আলোয় গাছের ফুলগুলো চিক্ চিক্ করছে। গাছের চারপাশ গোল করে নীল-সাদা মার্বেল দিয়ে বাঁধানো। সাদা ফুরুস ফুলের দু’একটা পাপড়ি ঝরে পড়ছিল জয়িতার মাথায়। জয়িতার মনটা আজ ভালো নেই একদম। ইউনিভার্সিটির ক্লাস শেষ হয়ে গেছে কবেই। এখন এম.এ ফাইনাল পরীক্ষার অপেক্ষায়।

কাল বাড়ি থেকে চিঠি লিখেছেন বাবা, “তোমার মায়ের শরীরটা ভালো নেই। তুমি বাড়ি এসে পড়াশোনার প্রস্তুতি নিলে সব দিক রক্ষা হয়।”

বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত গ্রামে জয়িতাদের বাড়ি। পুরুলিয়া এক্সপ্রেসে বাঁকুড়ায় নেমে আরামবাগ যাবার বাসে উঠতে হয়। কোতুলপুরে নামতে হয় তাকে। বাবা কোতুলপুরে নিতে আসেন তাকে।

অলোক দাঁড়িয়েছিল একটু দূরে। জয়িতা ডেকেছে তাকে। কাল বাড়ি চলে যাবে সে। হেঁদুয়ার কাছে একটা মেসে থাকে জয়িতা।

আলাপের শুরুটা হয়েছিল বেশ অভিনবভাবে। এম.এ ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাস শুরু হয়েছে সবে। যে সব ছেলেমেয়ে হোস্টেল পেয়েছে তাদের লিস্ট টাঙ্গানো হয়েছে নোটিস বোর্ডে। জয়িতার নাম লিস্টে নেই, হোস্টেল  পায়নি সে। জি.এস, স্বরূপ দাসের ঘরে সে এসেছে অভিযোগ জানাতে। স্বরূপের পাশেই বসেছিল অলোক।

ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকে ঝাঁঝিয়ে উঠেছিল জয়িতা,নমস্কার।আপনিই তো স্বরূপ দাস?স্টুডেন্ট ইউনিয়নের জি এস তো আপনি?

মুখ তুলেছিল স্বরূপ।

 – বলুন।

 -একটা কথা জানতে চাই আপনার কাছে।

 – বলুন।

 – এখানে কি হোস্টেল পাওয়ার বিষয়ে ফ্রেশ সিলেকসন হয়েছে?

 – কেন বলুন তো?

 – আমার বাড়ি তিনশো কিলোমিটার দূরে বাঁকুড়া জেলার প্রত্যন্ত গ্রামে, আমি হোস্টেল পেলাম না! হোস্টেল পেল স্বাগতা দাস,যার বাড়ি কিনা আগরপাড়া,নর্থ চব্বিশ পরগনা? এ তো একটা উদাহরণ যা আমি জানতে পেরেছি। এইরকম অন্যায্য কাজ কতই গোপনে চলছে যা আমরা জানতে পারি না। ছাত্র ইউনিয়নের সাধারন সম্পাদক হিসাবে আপনার কি কিছুই করার নেই? তাহলে আমরা ভরসা করব কাকে? কার কাছে নিজেদের অভিযোগ জানাব?

অলোক খুব মনোযোগ দিয়ে জয়িতার কথা শুনছিল।তার চেহারায় এমন কোন মাদকতা ছিল না যা একটা ছেলেকে আকর্ষণ করতে পারে।তবে সাধারণ বেশবাসে রোগাটে চেহারার জয়িতার বাচন ভঙ্গী,যুক্তিগ্রাহ্য মতামত,জড়তাহীন সরাসরি কথাবার্তা খুব ভাল লেগেছিল অলোকের।

জয়িতা চলে গেলে স্বরূপকে সে জিঞ্জেস করেছিল, এরকম হয়েছে নাকি রে?

-নিজেদের ক্যান্ডিডেটদের ঢোকাতে গিয়ে দু’একটা বেনিয়ম হয়েছে বৈকি।

ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষের পাশ করা লিস্ট অদলবদল হলে বিক্ষোভ, সমাবেশ – অনেক কিছু হবার সম্ভবনা থাকে। তাই সে লিস্টের পরিবর্তন হয়নি। তবে জয়িতার সাথে অলোকের খুব বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। অলোক জয়িতাকে কম খরচে মেস খুঁজে দিয়েছিল বিডন স্ট্রীটে। জয়িতার সঙ্গে অলোকের সম্পর্ক বেশ গাঢ় হয়েছে এই দু’বছরে।

জয়িতা আজ বেশ অন্যমনস্ক।পড়ন্ত রোদ্দুরের সোনালি আভায় বেশ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে তাকে।  সে যেন অতীত ঘটনার আচ্ছন্নতায় ডুবে আছে …

অলোক ডাকে, জয়ি…জয়ি… চুপ কেন! কথা বল।

ডান হাতের তর্জনীর ডগা দাঁতে কাটতে কাটতে জয়িতা বলে,উহুঁউ… কি বলব বল?

-কি বলার জন্য আজ ডেকেছ আমাকে?

-তুমি আমাকে ভুলে যাবে না তো?

-কি যে বল!

-চাকরি পেলে বিয়ে করবে তো আমায়?

– তুমি বিশ্বাস কর না আমায়?

– করি। তবুও ভয় হয়!

– কিসের ভয়? জয়ি চুপ করে আছ কেন?

– ওরা যে বলছিল…

– কারা? কি বলছিল?

– আমি তোমাকে বলিনি তুমি কষ্ট পাবে বলে।আমাদের ক্লাসের স্বপ্না, অদিতি বলছিল……..আর ছেলে পেলি না! অলোক সান্যালের পাল্লায় পড়লি শেষ পর্যন্ত! সব নিংড়ে নিয়ে চায়ের ভাঁড়ের মতো ছুঁড়ে ফেলে দেবে শেষে!

– আর কি বলছিল?

– থাক না আজকের দিনে।

– তুমি বিশ্বাস করেছ ওদের কথা?

– বিশ্বাস করিনি। আমি তোমাকে খুব ভালবাসি। কতদূরে চলে যাবে তাই ভয় করছে আমার!

– তোমার বাবা যদি বিয়ের ব্যবস্থা করেন… কি করবে?

-বাবাকে সব বলব বুঝিয়ে…

-আর আমি যদি চাকরি না পাই

-ব্যবসা করবে।আমিও কিছু না কিছু করব। দুজনে মিলে এক সাথে সংসারের জন্য প্রাণপন খাটব।তবে আমার বাবার এত সম্পত্তি নেই যে তোমাকে যৌতুক দেবে।

ঝুপ করে সন্ধ্যে নেমে আসে। ইভিনিং ওয়াকে যারা এসেছিল তারা বাড়ি ফিরছে একে একে।

ছল ছল চোখে জয়িতা উঠে দাঁড়ায়। এ দিকটা গাছের অন্ধকারে ছায়া ছায়া।অলোক তার গা ঘেঁসে দাঁড়ায়। ঈষৎ নীচু হয়ে জয়িতার অধরের উষ্ণতা নিংড়ে নেয় অলোক। আবেশে জয়িতা অলোকের  বুকে মাথা হেলিয়ে দেয়। পার্কের ওপাড়ের বড় রাস্তায় আলোগুলো জ্বলে উঠছে একে একে।

       এবার দুজনের পথ দু’দিকে।

        জয়িতা হেঁটে মেসের রাস্তা ধরে।ক্রমে ক্রমে ছোট হয়ে যাচ্ছে তার অবয়ব।অলোক একটা সিগারেট ধরায়।সিগারেটের শেষ টুকরোটা তার স্যান্ডেলের নীচে টিপে ধরে শেষ করতে করতে স্বগতোক্তি করে,অলোককে কেউ বাঁধতে পারবে না কোনদিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *