মিরুজিন আলো (পর্ব তেরো)✒️✒️ বিজয়া দেব

মিরুজিন আলো (পর্ব তেরো)
বিজয়া দেব

জগবন্ধু মাটি কোপাতে কোপাতে দেখল  খুরপির নিচে একটা হলুদ পতঙ্গ ছটফট করছে। তারই খুরপির আঘাতে পতঙ্গটি আহত হয়েছে। জগবন্ধু হাতের খুরপি ফেলে তাকিয়ে আছে নিষ্পলক। পারুল পারুল। এমনি ছটফট করতে করতে  প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেল। কত বিশ্বাস করেছিল, তাকে কত ভালবেসেছিল। শারীরিক মিলনে তার অনীহা দেখে বলত – তোমাকে আমি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। পারুল গাঁয়ের মেয়ে। গাঁয়ের নাম সোনাদিঘি।কী সুন্দর  গাছগাছালি ঘেরা চমৎকার এক দিঘি আছে সেখানে। মেয়েটি ক্লাস নাইনে পড়ত। গরীবের মেয়ে হলেও দেহে বেড়েছিল চমৎকার। তার সন্ধান কী করে যে পেল মহল্লার দালালগুলো। ওরা বুঝি গাঁয়ে গাঁয়ে লোক বসিয়ে রাখে। তাদের চেনা যায় না, বোঝা যায় না। আত্মীয় বন্ধু সেজে উঠতি মেয়েদের বাড়িতে যায়, দালালদের খবর দেয়। তারপর মিথ্যে প্রেমিক সাজিয়ে জগবন্ধুদের পাঠায়। না না এই ভদ্র জীবন জগবন্ধুর জন্যে নয়। এক হত্যাকারীর জীবন তার। ফিরে যাওয়াটাই উচিত ছিল ঐ মহল্লাতে। একের পর এক শারীরিক ও মানসিক মৃত্যুর কারবারী সে। সে কেন পারিজাতের বাড়িতে বসে মাটি কোপাতে কোপাতে হলুদ পতঙ্গকে হত্যা করবে। ছটফট করতে করতে পতঙ্গটি আপাতত স্থির। এক সজীব সকালে তার উৎফুল্ল ডানাদুটি কি জানত ফুরিয়ে আসছে জীবন! সে কি জানত এক হননকারী ঢুকে পড়েছে এই চমৎকার বাগানে।
কাঁধে হাত রাখল কেউ। রাঙাপিসি। রাঙাপিসির মুখে হাসি। বলছেন – তুমি না হলেও এ মারা পড়ত। রোজ রোজ কত প্রাণী মরে যায়। ঝড়ে ঝঞ্ঝায়। তুমি মন খারাপ করছ কেন? আচ্ছা পাগল তো তুমি জগবন্ধু।
জগবন্ধু বিড়বিড় করে – পাগল নই গো , পাগল নই। এক ভৌতিক ছায়া জন্ম থেকে আমার কাছে কাছে আছে। ঘাড়ে ধরিয়ে আমাকে দিয়ে এমন সব কাজ করিয়ে দেয় যা আমি কখনোই করতে চাই নি।
রাঙাপিসি কী যেন ভাবলেন। তারপর বললেন – জুহিদের বাড়ি ছেড়ে এলে কেন? আমি তো জানি দেবাংশী তোমাকে পার্ক থেকে তুলে এনে নিজের বাড়িতে ঠাঁই দিয়েছিলেন। ওকে ছেড়ে আসা কি তোমার ঠিক হয়েছে? কি হয়েছিল যে ছেড়ে এলে?
জগবন্ধু মাথা নিচু করে বসে থাকে। উত্তর দেয় না। রাঙাপিসি বলে – কিছু বলছ না। মানে বলতে চাইছ না। মানে একটা রহস্য আছে। কী রহস্য জানি না। কীসব মহল্লার কথা বলছিল পারিজাত? বলছিল তোমার সাথে মহল্লায় গিয়ে জীবনটাকে দেখবে। তা সেই মহল্লায় আছে কি?
-ওসব জেনে মনখারাপ করে কি করবেন পিসিমা? আমাদের গরীব গুর্বোর জীবন, কত কিছু দেখতে হয়, কত কিছু করতে হয়।
-কি করেছ তুমি? এভাবে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে কেন?
রাঙাপিসির কন্ঠের কাঠিন্যটা টের পেল জগবন্ধু। সব বললে পিসিমা তাড়িয়ে দেবে, এটা জানে সে। সে চলে যাবে তাতে নিজের কিছু যায় আসে না। তবু কেন কে জানে পারিজাত দাদাবাবুর জন্যে বড্ড মায়া পড়ে গেছে।
-দ্যাখো জগবন্ধু, লুকোছাপা ঠিক নয়। যা সত্যি তা কোনও একদিন ঠিক বেরিয়ে আসবে। তখন হয়ত এ বাড়ি ছেড়ে যেতে তোমার আরও কষ্ট হবে। সবটা আমাকে খুলে বলো।
-বেশ তো পিসিমা। আমি চলে যাব। পারিজাত দাদাবাবু কি বাড়িতে আছে? ওর সাথে একটু দেখা করে যাই।
হাতের খুরপিটা ফেলে জগবন্ধু উঠে দাঁড়ায়।
-চলে যাবে?  এমন কি কথা আছে তোমার জগবন্ধু যে খুলে বলতে চাইছ না? জিজ্ঞেস করতেই চলে যেতে চাইছ?
– আমি তো এখানে থাকতে চাইনি পিসিমা। এরকম করে থাকতে চাইছি না মোটেই। নিজে থেকে থাকতে চাইলে অবশ্যই সবটা খুলে বলাটা দরকার। কিন্তু আমি তো বারবার করে চলে যেতেই চাইছি।
তমসা অর্থাৎ পারিজাতের রাঙাপিসি এবার গলা নামিয়ে বলেন – আমি কি তোমাকে চলে যেতে বলেছি? বেশ কিছু বলার দরকার নেই। তোমাকে চলে যেতে হবে না।
পিসিমা চলে যাচ্ছে ঠুকঠুক করে হেঁটে। জগবন্ধু বোঝে এ বয়সে আরাম যত্ন এসবের খুব দরকার। জগবন্ধু যতটুকু সম্ভব করছে, ভাবছে আমার মা থাকলেও তো করতাম।
কিন্তু সবাই কি আর মায়ের মত হয়! মা কত কষ্ট করেছে যাতে সে একটা স্বাভাবিক সুস্থ জীবন পায়। সে কি করেছে? কিছুই না। উপরন্তু একটি অসহায় মেয়ের সাথে প্রবঞ্চনা করেছে, যে কিনা তাকে বিশ্বাস করেছিল, ভালবেসেছিল। সে কি আর একটা মানুষ?
মৃত হলুদ পতঙ্গটির ছেঁড়া ডানা হাতে নিয়ে অদ্ভুতভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে থাকে জগবন্ধু।

(ক্রমশ)

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *