গল্প / মানুষ হও ✒️✒️ ছন্দা চট্টোপাধ্যায়

গল্প / মানুষ হও

ছন্দা চট্টোপাধ্যায়

—————

বাড়িতে যেন শোকের ছায়া নেমেছে। গলা ছেড়ে কাঁদছে মধুজা।আজ মাধ‍্যমিকের রেজাল্ট আউট হয়েছে। দীপ কোনমতে ফার্স্ট ডিভিসন পেয়েছে বটে, কিন্তু স্টার মার্কস্ তো দূরের কথা,একটা লেটারও পায়নি। বাংলায় সত্তর শতাংশ পেলেও অঙ্কে তিরিশ। ইংরেজিতে কোনমতে পাশ মার্ক।ইতিহা,ভূগোলে মোটামুটি খারাপ নয়। এইভাবে তালেগোলে ফার্স্ট ডিভিসন পাওয়াটাই বিস্ময়কর। মধুজা চিৎকার করে-” সব সাবজেক্টের জন‍্য প্রাইভেট টিউটর রেখেছি, বাবা মুখে রক্ত তুলে খেটে পয়সা আনছে, ছেলে প্রেমে পড়েছেন। পড়বে কখন? শয়নে স্বপনে তো সোনালী।”- পাড়ার সবজান্তা কাকু ধুয়ো ধরেন -” বাংলায় তো মোটামুটি ভালো নম্বর পেলি আর একটু কারেক্ট এ‍্যানসার দিলে একটা লেটার হতো। ইতিহাস ভূগোলটা ঠিক আছে। অঙ্কটা একটু মন দিয়ে করলেই আর একটু ভালো নম্বর হতো।”- কাকিমা বললো-” ঐযে, ছেলে সময় পায়নি।”- রাজেশ বলে -” আরে চেঁচামেচি করছো কেন? দীপ তো একটা বিরাট কাজ করে ফেলেছে, সেটা দেখো!”- -“কী করেছে?”- -” আমাদের বংশের মুখ উজ্জ্বল করেছে। এই আমি–,আমার মা তো স্কুলটিচার ছিলেন। আশির দশকে আমি সেকেন্ড ডিভিসন পেয়েছিলাম। দিদি থার্ড ডিভিসন। কই, মা তো তোমার মতো খড়্গহস্ত হয়ে ওঠেনি মধু!।”- নতমুখী, কান্নায় ভেঙে পড়া দীপের মাথার চুল ঘেঁটে দিয়ে রাজেশ জড়িয়ে ধরে আত্মজকে। -” আমাদের বংশে প্রথম ফার্স্ট ডিভিসন পাওয়া ছেলে।”-

এক বাটি পায়েস নিয়ে ঘরে ঢোকেন বীথিকা দেবী। -” নাও, মিষ্টিমুখ করো সবাই।”- অত্যন্ত রাশভারী বীথিকাকে সবাই একটু সমঝে চলে। রাজেশের অতি শৈশবে তার বাবা মারা যান। বীথিকা গুরুমা ট্রেনিং নিয়ে প্রাইমারি স্কুলে চাকরি পান। অকাল বৈধব‍্যকে মেনে নিয়ে চাকরির ওপরে টিউশনি করে ছেলেমেয়েকে মানুষ করেন। মেয়ের বিয়ে দেন। নাতির মুখে পায়েস দিয়ে বৌমাকে বলেন কাঁচের বাটিগুলো আনতে। বাটি করে সবাইকে পায়েস দিয়ে পাড়ার কাকুকে বলেন -“শিবু, তুই কতো নম্বর পেয়েছিলি,আমার মনে আছে। তাও তো এক চান্সে পাশ করিসনি। তোর তো কোনো অসুবিধে হয়নি!? দিব‍্যি পৈতৃক ব‍্যবসা দেখছিস,ঘর সংসার করছিস। আমার বৌমা হয়তো অনেকটা আশা করেছিলো, তাই তেতে উঠেছে। তুই কেন আগুনে ঘি ঢালছিস? বাড়ি যা সব।”- সবজান্তা কাকু কাকিমাকে নিয়ে মুখ কালো করে চলে যায়।

বাইরের লোক সবাই চলে গেলে বীথিকা বৌমাকে বলেন-“শোনো বৌমা, ছেলের তোমার ষোলো বছর হলো। এই বয়সটায় ওরকম হয়। নানা সৃজনশীল কাজে ব‍্যস্ত রাখলে ঠিক হয়ে যাবে।আর ওরা যদি সত‍্যিই ভালোবাসে, বেপথে না যায় তা দেখার দায়িত্ব গার্জেনদেরই। কিন্তু তোমার বন্ধুদের সঙ্গে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করা ঠিক হয়নি। দীপ্তকে তুমি আড়ালে বোঝাতে পারতে। আমিও তো বাড়িতে থেকেও আজ প্রথম শুনলাম।নিজের মা-বাবা আর নিজের সন্তানকে নিয়ে কখনো কারো সঙ্গে আলোচনা করতে নেই। তাতে শেয়ালকে ভাঙা বেড়া দেখানো হয়। বেড়া ভেঙোনা। মধুজা মাথা হেঁট করে। -“কিন্তু মা,ঐ রেজাল্টে কোথায় ভর্তির চান্স পাবে? আপনাদের যুগ আর নেই। চাকরি বাকরিও পাবেনা।”- -“বৌমা, আমিও সে আশা করিনা। উচ্চমেধাসম্পন্ন ছেলেমেয়েরাই দিনের পর দিন বছরের পর বছর পথে বসে আছে। দীপ্ত তো মধ‍্যমেধার ছেলে। নিম্নমেধার ছেলেমেয়েদের কথা ভাবো তো! তাদের বাবাদের যদি গুপ্তধন থাকে তবে সন্তানদের বিদেশী ডিগ্রির ব‍্যবস্থা করবে। যদি না থাকে? ভাবতে হবে বৌমা। এই সমাজকাঠামোয় শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের মাথা উঁচু করে বাঁচার পথ খুঁজে দেওয়ার দায়িত্ব সমাজের। সমাজ আজকাল দায়িত্ব নিতে ব‍্যর্থ। অথচ দ‍্যাখো, কিছু না কিছু সুপ্ত মেধা সব মানুষের মধ‍্যে থাকে। তুমি তো সেলাই আর নানা রকম হাতের কাজে যথেষ্ঠ নিপুন। কখনো ভেবে দেখেছো ঐ গুন দিয়েই তুমিও সসম্মানে কিছু উপার্জন করতে পারো! তা নয়,সব সময়ে কেবল গল্প আর পরচর্চা!”- মৃদু ধমক দেন বীথিকা।

বীথিকা অসামান্য রূপসী এবং অল্প বয়সে বিধবা হয়ে বুঝে নিয়েছিলেন আত্মরক্ষার জন‍্য এবং সন্তানদের রক্ষার জন‍্য কী ধরণের বর্ম তাঁকে পরতে হবে। শুদ্ধ বৈধব‍্যরীতি পালন করেছেন আজীবন। আমিষ খাওয়া তো ছাড়তেই হয়েছিলো আত্মীয়দের চাপে, রঙিন শাড়ীও আর অঙ্গে তোলেননি। আবার হাসিমুখে কর্তব‍্য পালন করে গেছেন। কখনো বিষাদপ্রতিমা হননি, কেউ যেন কোনও অছিলায় তাঁকে সহানুভূতি না দেখাতে পারে। মধুজা তাই শাশুড়িকে অনিচ্ছা সত্বেও অগ্রাহ্য করতে পারেনা।এবার বলেন বীথিকা, -“দীপ্তবাবু, তুমি এখন তোমার ঘরে যাও।”- বীথিকা নাতিকে দীপ্তবাবু বলেই সম্বোধন করেন। ঐ দাদুভাই, দাদাইসোনা গুলো প্রাচীন হয়ে গেছে। এতেই বোঝা যায় তিনি কতোটা আধুনিক মনস্ক। দীপ্ত ঘরে চলে গেলে বলেন বীথিকা-” তোমাকে রাজ যেদিন পছন্দ করে নিয়ে এসেছিল আমি তোমাদের বরণ করে নিয়েছিলাম। মনে আছে তো? একটু নয়, এতোটা উদার হও যাতে তোমার ছেলে সবার আগে তোমাকেই তার মনের সব কথা উজার করে দিতে পারে। রাজ তো বাবার থেকে বেশী বন্ধুই হয়ে গেছে দীপ্তর। আর আজকের দিনে তোমাদের ছেলের মতো নম্র,ভদ্র ছেলে কটা আছে বলো তো? তোমরা দুজনেই শোনো,বাংলায় যে ছেলে এতো নম্বর পায় সে তো নিঃসন্দেহে সংবেদনশীল। রবীন্দ্রভারতী কিংবা শান্তিনিকেতনে দীপ্তকে ভর্তির ব‍্যবস্থা করো।কারণ, খেয়াল করেছো কী তোমাদের ছেলে কতো সুন্দর ,নিখুঁত সুরে রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়? ওকে সাহিত‍্য আর সঙ্গীতের মধ‍্যে থাকতে দাও। ও ছেলের যোগ‍্য সাবজেক্ট ওটাই। বৌমা,আমি আমার পেনশনের টাকাটা দীপ্তর শিক্ষাখাতেই ব‍্যয় করতে চাই। আমি চাই ছেলেটা মানুষ হোক, শিক্ষিত অমানুষ নয়। এমনই মানুষের মতো মানুষ হোক যাতে সবাই ওকে শ্রদ্ধা করে। আর তোমরা সন্তানের গর্বে গর্বিত বাবা মা হতে পারো।
********************************************

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *