পেয়ালা – পিরিচ ✒️✒️ গীতশ্রী সিনহা

পেয়ালা – পিরিচ

গীতশ্রী সিনহা

নিজস্ব ভঙ্গিতে জড়িয়ে থাকা এক অচেতন ঘুমের মধ্যে পাশ ফেরার মতন… একটা টেলিফোন বেজে ওঠে। বিরক্ত হওয়ার মতো যথেষ্ট কারণ রয়েছে, চোখের পাতায় ঘুম লেগে আছে চুম্বকের আলিঙ্গনে।
উফ! এতো সকালে কে ফোন করছে ? কমলটা যে কোথায় থাকে ! ফোনটা তো ও-ই ধরে ! ঘরের কাচের জানালাগুলো বন্ধ করে ভারী পর্দা টেনে দিতে ঘরটা বেশ ঠান্ডা হয়েছে, গত রাতে বালিশের পাশে পড়ে থাকা রিমোটে এ.সি.টা অফ করে রিমোটে পাখা চালিয়ে শুয়ে পড়েছিল বৃষ্টি। উপমার কথা ভাবতে ভাবতে ঘুম আসেনি বৃষ্টির গতরাতে। ছবির মতো চোখের পাতায় আলতো ছুঁয়ে ছিল লাস্যময়ী উপমা। শরীর বেয়ে একটা চটক, লুকানো শ্রী ছড়িয়ে আছে চেহারায়। ওর প্রতি একটু মনোযোগ দিলে ভালো লেগে যাওয়ার সম্ভবনা । ঠোঁটের হাসিতে শিকারীর বিজয়, মুক্ত সাজানো বাগান যেন দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে… শরীরের আনাচে-কানাচে তীব্র যৌন মাদকতার ঢেউ ছড়ানো আছে। উপমা মিত্র, ডাক নাম জয়ি। স্কুল কলেজে ছিল উপমা রায়। একটি ভীরু লাজুক মেয়ে। পারিবারিক কড়া শাসনে ছোট্ট গন্ডির মধ্যে বড় হয়ে ওঠা। যে মেয়ের স্বাদ – আহ্লাদ প্রতিনিয়ত ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে আবর্জনার স্তুপে, সে ছোট ছোট কিছু স্বপ্ন লালন করতে শুরু করেছিল… যৌবনের শুরুতে বিয়ের মতো একটা ঘটনা দুর্ঘটনার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় ………
আবার ফোনটা বেজে চলেছে, অস্ফুটে একবার বলার চেষ্টা করলো বৃষ্টি, ‘ কমল ফোনটা ধর না ! ‘ যাক, থেমে গেল ! বৃষ্টি পাশ ফিরে শুয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়।… কিন্তু কয়েক মিনিট মাত্র ! চোটকে যাওয়া ঘুম আর চুঁইয়ে পড়া বিরক্তি ‘ রাবিশ যতসব ‘ ! হাতের মুঠোর মধ্যে চেপে ধরা রিসিভারে প্রতি বিরক্তির প্রকাশ ঘটে।
—— ইয়েস সুপ্রভাত, বৃষ্টি রায়চৌধুরী বলছি !
—— আমি যেহেতু ফোন করেছি, আমি জানি তুমি কে ! তোমাকে চাই । আজ সারাদিন তুমি কি আমার সাথে কাটাতে রাজি আছো ? পুরুষ কন্ঠে ভেসে আসে কথাগুলো।
——- রাবিশ ! রিসিভার নামিয়ে উঠতে যায় বৃষ্টি , বেজে ওঠে আবার।
——- বেশ লাগে তোমাকে রেগে যেতে দেখলে… বলো না প্লিজ কোথায় যেতে চাও ? শহর থেকে অনেক দূরে … ? রাজি তো ? পুরুষ কন্ঠ বলে চলে …
হঠাৎ কোন পথের ভুলে / যদি যাও আমার গ্রামে,
দেখতে পাবে সবুজ মাঠে / করছে দু’জন খেলা।
অবাক হয়ে উঠবে হেসে / তুমিও ওদের পাশে,
দেখবে ওরা তোমার আমার হারানো মেয়েবেলা।
এই মুহূর্তে বৃষ্টির মুখে কোনো কথা সরে না ! কোনোক্রমে বলে, ‘ উপমা ! উপমা তুই ! তুই কি রে !
——- আমি ? আমি হচ্ছি কর্ণ-কুন্তির কর্ণ আর বাসবদত্তার সন্ন্যাসী উপগুপ্ত… খুব জোরে হাসতে হাসতে উপমা বলে, ভুলে গেলি কি করে রে মাথামোটা ! স্কুল – কলেজে তো একটাও মেয়ের রোল পেলাম না কোনোদিন ! আমি মেয়ে হলে আমার ম্যাচিং পুরুষ জুটতো না ! তাই তো বাধ্য হয়ে ছেলেদের গলা নকল করা শুরু করেছিলাম সেই থেকেই। ভাবলাম, আমার বৃষ্টির সাথে সুপ্রভাত টা সেরে নিই। উপমা আবার বলে, আমি কিন্তু ক’টা লাইন শোনালাম ! উত্তর চাই আমার, দিবি না রে ? না না থাক, সবুজ মাঠে গ্রামের পথে যেতে যেতে তোর উত্তর শুনবো।
——- বল রে, কখন বেরোবি ?
——- এতো ফূর্তি কেন রে ? এই ! অফিস যাবি না ?
——- অফিসের কোনো গল্প নেই আজ ! আজ শুধু long drive. খুব স্মল গ্যাপ নয় রে টুপুর ! গ্র‍্যাজুয়েশনের পর তুই বোধহয় এম.এ. করছিলি… বল টুপুর বল ! তারপর কি আমাদের দেখা হয়েছে ? সময়ের স্বীকার ছিলাম রে !
——– তাই বুঝি সাত সকালে …!
——– না, আর কথা নয়। বাকি সব দেখা হলে… আমি ঠিক নটার সময় হাজির হয়ে যাবো তোর গেটের সামনে। হুম, বল কি ভাবে যাবো ?
——– ঢাকুরিয়া ব্রিজ ক্রশ করে যাদবপুর ইউনিভার্সিটি বাঁ দিকে ফেলে দেশপ্রাণ শাসমল রোড ধরে সেই পুরোনো রাধা স্টুডিও যা নাকি টলিউডের তীর্থ ক্ষেত্র ছিল এক সময়। তাকেও বাঁদিকে ফেলে একটু এগিয়ে মেঘমল্লার অ‍্যাপার্টমেন্ট। তার দশ তলায় আমার বাস।
——– আমি কিন্তু উপরে উঠবো না
——– তোর এতো তাড়া কিসের রে ? মনে হচ্ছে রেডি হয়ে আছিস আমাকে পেলেই প্রপোজ করবি! হা হা হা হা…
——– ঠিক তাই, অনেক সময় নষ্ট করেছি রে…
——– ওকে ম্যাডাম, নিচে অফিস ঘরে জানালেই আমি নেমে আসবো রে৷
পাক্কা ন’টা, উপমা মিত্রের গাড়ি এসে দাঁড়ালো অ‍্যাপার্টমেন্টের বড় গেটের সামনে। মোটামুটি অফিস এবং স্কুল-কলেজের টাইম,দারোয়ান ড্রাইভারের ভীড়ের মধ্যে ছাই রঙের জিন্সের সাথে কালো পাঞ্জাবীতে উপমা যেন অনন্যা। অফ হোয়াইট ও মেরুনের ঢাকাই জামদানীরতে বৃষ্টিকেও বেশ চনমনে দেখাচ্ছে। সৌখিন রোদচশমা দু’হাতে নাকের ডগায় নামিয়ে উপমা বলে চলে… টুপুর… এই টুপুর নষ্ট সময়ে হারিয়ে গেছিলাম রে ! হঠাৎ করে বৃষ্টি উপমাকে জাপটে জড়িয়ে ধরে, উপমাও যেন তৈরি ছিল। দু’জনের চোখে জল……
ছোট্ট বেলার গল্প শোনা /ছোট্ট মনের আশা
রূপকথার ঐ রাজকুমারীর / ছোট্ট ভালোবাসা
ছোট্ট অনেক কল্পকথা মনের কোণে রয়
সেটাই বেশ ভালো ছিল / আজকে মনে হয়
উপমা মুগ্ধের মত শুনতে থাকে বৃষ্টির সকালের উত্তর। একহাত স্টিয়ারিং -এ রেখে বাঁ হাত দিয়ে বৃষ্টির হাত খুঁজতে থাকে।
এই আমরা কেমন কবি হয়ে যাচ্ছি রে, উপমা বাঁ হাতটা কলার তোলার ভঙ্গিতে বলে। দু’জনেই হাসতে থাকে, যেন হাসিতে শার্সি ভাঙার শব্দ।
ছোট্ট নিরবতা… দু’জনের দৃষ্টি সামনের দিকে। হাঠাৎ করে উপমার স্টিয়ারিং-এ রাখা হাতটা চেপে ধরে বৃষ্টি, আস্তে করে বলে, ‘ প্লিজ একটু থামা ‘ ! দ্যাখ… দ্যাখ… উত্তেজিত বৃষ্টি দেখাতে থাকে দুটো রঙিন পাখি।
উপমা — হ্যাঁ, বেশ মিষ্টি পাখি, কিন্তু দেখার কি আছে ?
ফুরুৎ করে পাখি দুটো এসে বসলো কাছে একটি গাছের ডালে। রীতিমতো উত্তেজিত বৃষ্টি উপমাকে প্রশ্ন রাখে, ‘ এর আগে কোনোদিন এই পাখি একসঙ্গে দুটো দেখেছিস !
—- লক্ষ্য করি নি, তাই দেখি নি ( হাল্কা চালে উপমার উত্তর )। মায়া লাগে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে। না, আসলে কেউ তো এভাবে কোনোদিন … তোর মন দিয়ে, চোখ দিয়ে আমাকে দেখতে শেখাবি রে বৃষ্টি !
আপনমনে বলতে থাকে, পাখিরা একজোড়া হলে দেখতে বেশ লাগে… যেন অল্পবয়সী স্বামী -স্ত্রী বেড়াতে চলছে…
—– অল্পবয়সী কেন মনে হয় ?
—– এমন রঙিন পাখিদের বুড়ো হতে দেখেছিস ?
জানিস, পাখিরা অনেক দিন খাঁচার মধ্যে নিশ্চিন্তে খাবার পেতে পেতে, বাইরের আকাশে উড়তে চায় না। অনেকটা সেকেলের হিন্দু বাড়ির মেয়েদের মতন ! যেন নিজেরাই স্বাধীনতা চায় না।
ইয়েস ম্যাডাম, এবার একটু এগোতে পারি ? পাখিতে আটকে থাকলে চলবে ? হাল্কা ইয়ার্কির ছলে মুচকি হেসে উপমা বলে…
হ্যাঁ হ্যাঁ প্লিজ চল রে, পাখিদের দিকে তাকিয়ে থেকেই আনমনে বলে বৃষ্টি।
ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসির ঢেউ ফুটিয়ে উপমা বলে, মনে আছে রে বৃষ্টি, হাজরাদের বাগানে খেলতে যেতাম, কত ফড়িং ধরতাম ! প্রজাপতি ধরা মানা ছিল, প্রজাপতি ধরলে নাকি বিয়ে হয় না ! ‘ পোড়াকপাল ‘। এসব সব কথার কথা ! তখন বুঝতাম না ! জীবনের অনেকটা পথ পিছনে রেখে বুঝেছি গত দিনগুলো ছিল ধূসর, আর সেই ধূসরতার শরীর থেকে হঠাৎ কোনো এক স্মৃতি টুপ করে নেমে আসে আমার একাকী বিষন্ন ঘরে, সেই শীতার্ত স্মৃতি আমাকে কাঁপায়, ভাবায় !
এক অদ্ভুত বিপন্নতায় আক্রান্ত গৃহবধূটি ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে শেষমেশ নিজের জায়গা করে নিতে পেরেছিল। দাখিল করতে পেরেছিল আত্মপরিচয়। ভয়ানক নিরপত্তার ঘেরাটোপ থেকে নিজেকে মুক্ত করেছিল। বাঁ হাতটা বৃষ্টির হাতে রেখে উপমা বলে চলে… ‘আজও ভুলতে পারে নি অসহায় গৃহবধূটি, বেঠিক সময়ের সামাজিক ভঙ্গুর চালচিত্রের ছবি। ‘
মনে ভাবে বৃষ্টি, উপমা কীভাবে গড়গড় করে বলে দিতে পারছে আমার কথাগুলো ! গৃহবধূটি কি আমি ? না, ও নিজে ! গাড়ির স্টিয়ারিং -এ আলতো করে ডান হাতটা রাখা … গ্রামের পথে পথে চাকা ঘুরছে… খুব সম্ভব জায়গাটার নাম ‘ কামারকুন্ডু ‘……

ক্রমশ আগামী সংখ্যায় ———–

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *