৬০ টাকায় বাংলাদেশ – আমার অন্য পথ ~ শান্তনু ঘোষ পর্ব-৪

৬০ টাকায় বাংলাদেশ – আমার অন্য পথ
~ শান্তনু ঘোষ
পর্ব-৪

আগে যা ঘটেছে:

গেদে চেকপোস্ট হয়ে, নোম্যান্স ল্যান্ড পেরিয়ে এসে পরেছি বাংলাদেশ সীমানায়। প্রথমেই দিতে হবে কোভিড ডাবল ভ্যাক্সিন সার্টিফিকেট। ওটা দিলেই প্রবেশ করতে দেবে। কিন্তু আমার তো সেটা নেই। কি হবে এখন !

তারপর…

ভ্যানে করে বাংলাদেশ সীমানায় এসে নেমে প্রথমেই এক ধাক্কা। পর পর দুটি কাউন্টার প্রথম কাউন্টারে কোভিড সার্টিফিকেট পরীক্ষা হচ্ছে। দুজন বসে তা দেখে একটা খাতায় নোট করছেন। আমার সামনেই কয়েকজন তাদের সার্টিফিকেট দেখালেন। তারা ছাড়পত্র নিয়ে এগিয়ে গেলেন। আমি আমার একমাত্র সিঙ্গল ডোজ সার্টিফিকেট দেখালাম। ওনারা বললেন ডাবল ডোজ সার্টিফিকেট দিন।

আমি মুখ কাঁচুমাচু করে বলি, সেটা তো আমার নেই। কারণ আমি একটা মাত্র ডোজ নিয়েছি।
ওনাদের উত্তর, তাহলে তো যেতে দেওয়া যাবে না।

আমার তো মাথায় হাত। সেকি !! এখান থেকে ফেরত যেতে হবে ?
এবার ওনাদের বুঝিয়ে বলি, দেখুন প্রথম ডোজ ভ্যাক্সিন নেবার পরে আমার উপর তার মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়, আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। তাই ডাক্তার আমাকে আর কোন ডোজ নিতে মানা করেছেন। আমি আর ভ্যাক্সিন নিতে পারব না।

আধিকারিকদের একজন বললেন, কোন ডাক্তারের সার্টিফিকেট আছে কি ?

যাত্রা শুরুর কয়েকদিন আগেই ডাক্তারবাবু আমাকে লিখে দিয়েছিলেন। আমিই এমনি চেয়েছিলাম, যদি কোথাও প্রয়োজন হয়, এই ভেবে। সেটা যে এত গুরত্বপূর্ণ হবে তা তখন বুঝিনি।

আমি তাড়াতাড়ি বলি, হ্যাঁ আছে আছে।
সেই সার্টিফিকেট কপি একটা হাতে দিলাম। উনি মন দিয়ে দেখছেন। বুঝতে পারছি ডাক্তারের হাতের লেখা পড়া বেশ সহজ কাজ নয়। আমি সচেষ্ট হয়ে নীচের দিকে লেখা লাইনটা দেখিয়ে দেই, যেখানে আসল কথাটা লেখা আছে।

উনি কি বুঝলেন কে জানে। একটু নিমরাজি হয়ে বলেন, ঠিক আছে, আপনি যান।
আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। পরের কাউন্টারে যাবার আগে, পাশে বসার জায়গায় এসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছি।

সামনেই ভারত বাংলাদেশ সীমানা।
এক অদৃশ্য রেখা। তার এপারে একটা দেশ আর ওপারে আর একটা দেশ।
স্বয়ংক্রিয় বন্দুক নিয়ে প্রহরারত সীমান্ত প্রহরীরা।

ভাবছিলাম একই তো দেশ ছিল। একই তো মাটি। একই জল। একই বৃক্ষরাশি। কিছুই তো আলাদা করে চোখে পরে না।

৭৫ বছর আগে কোথা থেকে সিরিল র‍্যাডক্লিফ নামে একজন লোক এল, যে এই দেশটার বিষয়ে কিছুই জানত না। যে লোকটা কোন কার্টোগ্রাফার নয়। ইংল্যান্ডের একজন ব্যারিস্টার। যে দিল্লীতেই বসে রইল। বাংলায় একবারও এল না। সে হুরমুর করে একটা ম্যাপের উপর ইচ্ছে মত দাগ টানল, আর লাখ লাখ বাঙ্গালীর জীবনকে চরম বিপদ, দুর্দশা, দাঙ্গার আর মৃত্যুর সর্বনাশা আগুনে ছুড়ে ফেলে দিল। কিন্তু ওই লোকটার গায়ে একটুও আঁচর লাগলো না। শুধুমাত্র ওই লোকটাই নয়, তখন যে সব বড় বড় ভারতীয় নেতারা দিল্লীতে বসেছিল, আর বিভাজনে ফলে কার কত লাভ হবে সেই অঙ্ক কষছিল, তাদের উপরেও কোন আঘাত এল না।

দেশ ভাগের সেই অমানুষিক যন্ত্রণা ও অত্যাচারের ঘটনাগুলো পরবর্তী কালে কোন একটা নির্দিষ্ট বই বা একটা লেখায় সম্পূর্ণ প্রতিফলিত হয়নি। তা করাও সম্ভব নয়। যাঁরা সেই আগুনে পুড়েছেন, একমাত্র তাঁরাই জানেন কত গভীর ছিল এই ক্ষত। স্বজন হারানোর হাহাকার রাতের অন্ধকারে হারিয়ে গিয়েছিল। কত যুবতী ধর্ষিত হয়েছিল তার হিসেব নেই। চলেছিল পৈশাচিক ধর্ষণের পরে নগ্ন নারীদেহের উপর বীভৎস নারকীয় অত্যাচার।

সচ্ছন্দ জীবন থেকে বিতাড়িত পরিবারগুলোর রাতারাতি প্রাণ হাতে করে পথের ভিখারি হয়ে ভিটেমাটি ছেড়ে অনিশ্চিতের অন্ধকারে হারিয়ে গিয়েছিল। সে সব কথা আজ আর কজন মনে রেখেছে ?

দেশের কথা বলতে গিয়ে আমার ঠাকুমার চোখ জলে ভরে উঠত। তিনি চোখের সামনে এই নরককুণ্ড দেখেছিলেন। বুকে চিরদিন ছিল অব্যক্ত যন্ত্রণার পাষাণ ভার । কিন্তু তার জন্য তো তিনি দায়ী ছিলেন না। তাঁর দুই নাবালক সন্তানের মৃত্যু । সেটা কি কাম্য ছিল? এমন মর্মান্তিক চিত্র সেই সময়ে উদ্বাস্তু হয়ে আসা প্রতি ঘরে ঘরে ছিল।

আমাদের দেশ ছিল ঢাকায়। সব থাকা সত্ত্বেও আমাদের পরিবারের উপর “উদ্বাস্তু” ছাপ পড়েছিল । শুনেছি আজ আমাদের সেই সম্পত্তি দখল করে অন্য কেউ সুখে ভোগ করছে। কি জানি, হয়ত তা হতে পারে ঢাকার অভিজাত এলাকা ধানমান্ডি, গুলশান, বনানী বা বারিধারার কোন বিলাস বহুল আবাসনের অংশ।

কয়েকটা অসম্ভব ক্ষমতা লোভীর ইচ্ছাপূরণের জন্য লাখলাখ জীবনের বলিদান। যে বা যারা এই ধ্বংসের নেপথ্যে ছিল তাদের গায়ে কিন্তু একটুও আঁচ লাগলো না।

নাহ, আর সময় নষ্ট নয়। এগিয়ে যেতে হবে। এবার যাবো পরের কাউন্টারে। বি জি বি – বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-র কাউন্টার। সেখানে বিশেষ ঝামেলা কিছু হচ্ছে না। আমার পাসপোর্ট নিয়ে তথ্যগুলো নথিভুক্ত করে নিচ্ছে। দুজন তরুণী আছেন। নিজেদের মধ্যে জমিয়ে গল্প করছেন। ভাষাটার সুর শুনে খুব একাত্ত বোধ করলাম। ঠিক এই টানের বাংলা তো আমার ঠাকুমা বলতেন। শুধুমাত্র কথার টান শোনার জন্য আমি খানিকক্ষণ ইচ্ছে করেই দাঁড়িয়ে রইলাম। বেশ ঘরোয়া মনে হচ্ছে। কাউন্টার একদম ফাঁকা।

এখানে পাশেই একটা রেল ষ্টেশন। গুটিকয়েক লোক সেখানে দাঁড়িয়ে। মৈত্রী এক্সপ্রেস এই ষ্টেশন দিয়েই যায়। কিন্তু থামে না।

এবার আমি হেঁটে চলেছি বাংলাদেশ কাস্টমসের দিকে। সব কিছুই কাছে কাছে। একটু এগুতেই দু-চার জন এসে আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করল কাগজপত্রের কাজ করতে হবে কিনা। তারই মধ্যে একটি বছর কুড়ির হাসি-মুখ ছেলে এসে বলল, জালালের কাছে যাইবেন তো কাকু ?

আমি বুঝলাম চ্যানেল মারফত খবর এসে গেছে। সে আমাকে কাছেই একটি টিনের ছাউনি দেওয়া বেড়ার ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালো। বলল পাসপোর্টটা দ্যান কাকু। তারপর সে উধাও হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে এসে বলল, ন্যান, সব হইয়া গ্যাছে।
আমি জিজ্ঞেস করি, তোমার নাম কি?
– আলম।
– আমারে চিনলা ক্যামনে ?
– সে সব আমাগো সিস্টেম আছে।
যাই হোক আর কথা না বাড়িয়ে । আলম কে তার সেবা-মূল্য চুকিয়ে বেরিয়ে এলাম।

বাইরে দেখি একজন ভ্যান ওয়ালা ইতিমধ্যেই এসে হাজির।
– দর্শনা যাইবেন তো দাদা ?
– হ্যাঁ। ঢাকার ট্রেন ধরব। বেনাপোল এক্সপ্রেস। ষ্টেশনে ছাড়তে হবে কিন্তু।
কৌস্তভ বারবার করে বলে দিয়েছিল। ভুলাভাল ষ্টেশনে যেন চলে না যাই।
তাই জোর দিলাম ।

লোকটি বলল, সে নিয়ে যাবে। ভাড়া ৫০ টাকা। কৌস্তভ তো বলেছিল ৩০ টাকার বেশী হবে না। যাই হোক। সময় হয়ে আসছে। তাই দেরী করলাম না।

এখানে আশেপাশে অনেকগুলো গুমটি ঘর। বুঝলাম এগুলো সব এজেন্টদের অস্থায়ী অফিস। সব ফাঁকা ফাঁকা। কারণ সেই একই। এখন এই চেক পোষ্ট দিয়ে খুব কম লোক যাতায়াত করে। বাংলাদেশীদের যাবার নিয়ম নেই এখন। আগে বেশ ভিড় হত। এখন বেশিরভাগই পেট্রাপোল দিয়ে যায়।

ভ্যানে উঠে বসলাম। আমি একাই যাত্রী।
ভ্যান চলছে গ্রামের মধ্য দিয়ে। অবশেষে আমি চলেছি বাংলাদেশের গ্রামের রাস্তায়।

ক্রমশঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *