সেদিনের কবি গান: ৩য় পর্ব কলমে : গীতালি ঘোষ

সেদিনের কবি গান: ৩য় পর্ব
কলমে : গীতালি ঘোষ

মুখে মুখে গান বেঁধে যারা লড়াইএ নামতেন, তাদেরকে কবিয়াল বলা হয়। তারা সাধারণ কবিদের থেকে কিছুটা আলাদা। তাদের কোনো লিখিত ব‍্যাপার ছিল না, সবটাই ছিল মৌখিক। গাম্ভীর্য পূর্ণ বিষয় নিয়ে গান বাঁধলেও তাদের গান আসরে বিশেষ গম্ভীর ধরণের হত না। ক্ষণিকের বিনোদন বা দর্শক শ্রোতার চাহিদা  অনুযায়ী  আনন্দ দান করাই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। তাদের মধ্যে  একদল গানের মাধ্যমে প্রশ্ন করতেন। বিপক্ষের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন‍্য তাৎক্ষণিক মৌখিক রচনা করতে হত তাদের। কবিগানের পালায় সবসময়ই দুটি দল থাকত। প্রথম দলের প্রশ্নকে ‘চাপান’ বলা হত এবং দ্বিতীয় দলের উত্তরকে বলা হত ‘উতোর’। এই চাপান-উতোরের খেলায় সাধারণ শ্রোতা দর্শক আনন্দ লাভ করত। কবিগানের নানা উপাদানের মধ্যে পাঁচালি, আখড়াই, ঢপ, বসা কবিগান,দাঁড়া কবিগান, তর্জা গানও থাকত। এসব গানে রুচিশীলতা বিশেষ দেখা যেত না, যদিও ব‍্যতিক্রম তো আছেই। কবিগানের মূল লক্ষ‍্যই ছিল  একদলের অপরদলকে আক্রমণে পর্যুদস্ত করে তাৎক্ষণিক চিত্ত বিনোদন করা।

একটা কথা মানতেই হবে যে, আসরে দাঁড়িয়ে তাৎক্ষণিক গান বাঁধার মত বিরল ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন এই শিল্পীরা। প্রতিপক্ষের প্রশ্নের তাৎক্ষণিক জবাব দেওয়ার মতন প্রতিভা এই কবিয়ালদের ছিল। এটি ঈশ্বরদত্ত ক্ষমতা হলেও কবিগানের  রীতি নীতির কিছু কিছু শিক্ষাও নিতে হত তাদের। তারা অবশ্যই গুরু খুঁজে নিয়ে গুরুর কাছে শিক্ষা গ্রহণ করতেন। প্রথমে গুরুর সঙ্গে গান গাইতেন এরা এবং পরে সাব‍্যস্ত হয়ে নিজেদের দল গঠন করে নিতেন তারা। আসরে এদের প্রশ্নোত্তরের মাঝে কোনো কোনো সময় চেতনার ব‍্যাপ্তি ধরা পড়ত, যা কবির বিভোর মনকে প্রকাশ করত। কখনো কখনো প্রকৃতি, পরিবেশ, নিসর্গপ্রেমের প্রকাশও দেখা যেত এদের গানে। এদের গানে ছিল আবেগ ও একধরণের উচ্ছ্বাস যা সমবেত শ্রোতাকে একধরণের উত্তেজনায় আবিষ্ট করত।

সাধারণ ভাবে নিজের এবং নিজের দলের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করাই ছিল তাদের উদ্দেশ‍্য। এক্ষেত্রে দেখা যায় কবিয়ালরা বহুলাংশেই গান বাঁধতেন শ্রোতাদের চাহিদা অনুসারে। কারণ এই কবিগান ছিল পুরোপুরি দর্শক ও শ্রোতানির্ভর। এই গানের শাখাটি প্রাথমিক ভাবে গ্রামগঞ্জে প্রচলিত থাকলেও পরবর্তীকালে  এটি নগরকেন্দ্রিক হয়ে  ওঠে। সেকালের নগরকেন্দ্রিক বাবুসমাজের কাছে এই কবিগান অত্যন্ত প্রিয় হয়েছিল। নাগরিক সমাজের বহু  স্বচ্ছল বাড়িতেই কবিগান বসানোর রেওয়াজ ছিল এবং তা ছিল সম্মান ও অহংকারের চিহ্ন। কথিত আছে শোভাবাজারের রাজবাড়ির নবকৃষ্ণ দেব প্রথম তাঁর বাড়িতে  কবিগানের আসর বসান।

তারপর থেকেই শহর কলকাতায় বহুল প্রচলিত হয়ে  ওঠে এই কবিগানের আসর।স্বচ্ছল উচ্চবিত্ত ঘরে কবিগান বসানোর রীতি দেখা দিল সমাজে। কোনো আনন্দ অনুষ্ঠানের অন‍্যতম অঙ্গ রূপেও এই শাখাটির প্রচলন ঘটেছিল।          ( চলবে )

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *