ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে (ষোড়শ পর্ব) ✒️✒️ সায়ন্তন ধর

ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে (ষোড়শ পর্ব)

সায়ন্তন ধর

বিদ্যালয় জীবনে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, সরস্বতী পূজার আনন্দে শীতকালটা একটু চাপমুক্ত ও আনন্দের সাথেই কাটতো। কলেজ লাইফেও শীতকালে যেন একটা গা-ছাড়া ভাব আসতো। মিঠে রোদে মাঠের মধ্যে গোল হয়ে বসে থাকার সুযোগ করে দিতে ক্লাসের চাপ কিছুটা শিথিল হতো। তাছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠান লেগে থাকতো এই সময়টায়। এখন কর্মজীবনেও শীতকালটাই গতানুগতিক কাজের পরিবর্তে কিছু আনন্দঘন সময় নিয়ে আসে। এই সময়টাতেই কৃষিমেলা, ইনোভেটিভ ফার্মার্স মিট, সায়েন্স অ্যান্ড ইনোভেশন ফেস্টিভ্যালের আয়োজন করা হয়। কৃষকেরা আসেন তাঁদের উন্নত ফসল ও ফার্ম প্র্যাকটিস সাথে করে, তৃণস্তরের উদ্ভাবকরা তাঁদের নিত্য নতুন আবিস্কারের সাথে পরিচয় করায় আপামর জনতার, স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরাও তাক লাগিয়ে দেয় তাদের অভিনব চিন্তায়। উত্তর পূর্ব ভারতের সবচেয়ে বড় এমন অনুষ্ঠানটি আয়োজিত হয় ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে রিজিওনাল সায়েন্স সেন্টার, গুয়াহাটির তত্ত্বাবধানে ও ন্যাশনাল ইনোভেশন ফাউন্ডেশন – ইন্ডিয়ার সহায়তায়। স্বাভাবিকভাবেই এই ধরনের অনুষ্ঠানে যাওয়ার একটা আলাদাই মজা, তার সাথে গুরুদায়িত্বও রয়েছে। ২০১৯ সালে আমি একবার গিয়েছিলাম কালিম্পং এর দুটি শিক্ষার্থীকে সঙ্গে করে। কিন্তু এবারে শিলিগুড়ির কলিগদাদার ওপরেই সেই দায়িত্ব বর্তেছে। আমিও আমার গতানুগতিক কর্মকাণ্ডে মনোনিবেশ করেছি। হঠাৎ অফিসিয়াল হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে বসের মেসেজ। ভুবনেশ্বর সেলের একজন সায়েন্টিস্ট আসবেন গুয়াহাটি। ১৪ই ফেব্রুয়ারি রাতে থাকছে ভ্যালেন্টাইনস ডিনারের এলাহী আয়োজন। আর্থিক বছরের শেষে আমাদের একটা রিভিউ মিটিং হয়, তা এবার এগিয়ে আনা হয়েছে ফেব্রুয়ারিতেই। ১৫ই ফেব্রুয়ারি সেই দিন। ১৪ তারিখ সকালে আমাদের সকলকে গুয়াহাটি পৌঁছতে হবে। স্যার খুব মজার মানুষ। লক্ষ্ণৌ এর চোস্ত হিন্দিতে সিরিয়াস মুখভঙ্গিমায় হাস্যকৌতুক করতে ভালোবাসেন তিনি। তাই বলে দিলেন যে যদি অ্যাকচুয়াল ভ্যালেন্টাইনকে নিয়ে কোন প্ল্যান কারও থেকে থাকে, তা যেন প্রিপন বা পোস্টপন করা হয়। বাকিরা কে কি করেছে আমার জানা নেই, তবে আমার কোনটাই করতে হয়নি। কারণ আমি তো চলেছি আমার ভ্যালেন্টাইনের সাথেই। সবসময় তার সাথেই রয়েছি। ব্রহ্মপুত্র ও তার পারিপার্শ্বিক প্রকৃতি যে আমার জন্যই অপেক্ষমান। হাতে দিনসাতেক সময়। মিটিং এর প্রিপারেশন নিয়ে নিলাম, কেটে ফেললাম কাঞ্চনজঙ্ঘার টিকিট। সবদিক বিবেচনা করে এই ট্রেনটিকেই আমি বরাবর সিলেক্ট করি, আর বরাবরই একই সমস্যার সম্মুখীন হই। ভোর সাড়ে তিনটায় পৌঁছে দেয় গুয়াহাটি, ফলে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয় স্টেশনের ওয়েটিং রুমে। এবারও তার অন্যথা হলো না। ভোরের আলো ফোটার মুহূর্তে স্টেশন থেকে বেরিয়ে এলাম। আজকাল অটো বুক করা আর ওলা, উবেরের সার্ভিস নেওয়া প্রায় সমার্থক হয়ে গেছে। অ্যাপে যে ভাড়া দেখাবে গায়ের জোরে তার চেয়ে অন্তত একশো টাকা বেশি চাইবেই তারা। তাই আর ক্যাব বুক করলাম না। ভাবলাম খানাপাড়াগামী কোন বাস ধরবো। কিন্তু অত ভোরে বাস অমিল। ট্রলি ব্যাগ নিয়ে কিছুদূর এগিয়ে গেলাম। সৎপথে বাঁচলে এক অদ্ভুত সাহস সঙ্গী হয়। সেই সাহসে ভর করে এগিয়ে চলেছি। কিছু ম্যাজিক গাড়ি দেখতে পেলাম। ওদের জিজ্ঞেস করলাম খানাপাড়া যাবে কি না। ওরা বললো খানাপাড়ার সরাসরি গাড়ি পেতে হলে আরও ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করতে হবে। তারচেয়ে নারেঙ্গি তিনিয়ালিতে নেমে ওখান থেকে খানাপাড়ার ম্যাজিকে উঠতে পারবো। অগত্যা রাজি হয়ে গেলাম। ১২ কিমি পথের ভাড়া ৪০ টাকা। পথে দেখলাম নুনমাটি অয়েল রিফাইনারি। প্রথম যেবার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক্সকারশনে গুয়াহাটি এসেছিলাম সেবার দেখেছিলাম। নারেঙ্গি তিনিয়ালিতে পৌঁছাতে দিনের আলো ভালোমতো ফুটলো। কলিতাকুচি নামক স্থান থেকে আসা খানাপাড়াগামী ম্যাজিকের চালক চা পানে ব্যস্ত। মিনিট পনেরোর অপেক্ষা শেষে আবার যাত্রা শুরু হলো। এদিকে প্রায় ৮ কিলোমিটার পথ, ভাড়া নিলো ৩০ টাকা। অসমে বাস বা এই ম্যাজিকগুলোর ভাড়া অত্যধিক। তার ওপরে ভোর বেলা। তবে অ্যাপ ক্যাবের চেয়ে কত সস্তায় পৌঁছে গেলাম। একটু সময় বেশি লাগলো ঠিকই, কিন্তু কত নতুন পথ চেনা হলো… পথ চেনাই যখন কাজ, তখন তা চিনতে পথে তো নামতেই হবে। তাতে যদি এক আধবার পথ হারিয়ে যায় তো যাক্… ঠিকানা লেখা রয়েছে তো, চলতে চলতে ঠিক পৌঁছে যাবো। জিএস রোডে (যার পুরো নাম গুয়াহাটি-শিলং রোড) অবস্থিত তাজ ভিভান্তা হোটেলের সামনের সুদৃশ্য ফুট ওভার ব্রীজের কাছে নেমে বাকি পথ হেঁটে সায়েন্স সেন্টারে পৌঁছে গেলাম। অত সকালে রুম অ্যালোট করা হয়নি। কিন্তু শিলিগুড়ির কলিগদাদা আগে থেকেই সেখানে থাকায় তার রুমেই নিয়ে গেলো। ফ্রেশ হয়ে নিয়ে ক্লান্তিকে শায়েস্তা করতে একটু ঘুমিয়ে নিলাম। তারপর নিজস্ব রুম পেতেই শিফ্ট করে গেলাম। ব্রেকফাস্ট সেরে দাদা বেড়িয়ে গেলো কিছু পার্সোনাল কাজে। তারপর কিছু অংশ স্কিপ করে যাই, কারণ ভ্যালেন্টাইন দিবসে অফিসিয়াল কাজের কথা বড়োই বেমানান। রাত সাড়ে আটটার দিকে আমরা বের হলাম। লক্ষ্য আগেরবারের সেই চাওলা স্কয়ার রেস্তোরাঁ। সায়েন্টিস্ট স্যার অর্ডার করলেন ভেজ স্যুপ থেকে শুরু করে চিকেনের বিভিন্ন আইটেম। আর শেষ পাতে গোলাপ জামুন। হাল্কা ফুরফুরে মেজাজে রয়েছে সবাই। একজন বলেই বসলো আগামীকাল তো রিভিউ মিটিং, তার আগে স্যার ডিনার খাওয়াচ্ছেন। অর্থাৎ মিটিং বেশ কড়া মেজাজের হবে। এই শুনে স্যারও মুচকি হাসছেন। যাইহোক এরপর স্যার বিল মিটিয়ে দিলেন। কিন্তু রাস্তাতেই কলিগদাদা দেখলো তার সাথে পার্স নেই। দাদা তো চিন্তিত হয়ে পড়লো। আবার গিয়ে যেখানে আমরা বসেছিলাম ওখানে দেখলাম। কিছুই দেখতে পেলাম না। আমি আশ্বস্ত করে বললাম, “ডিনার তো স্যারের তরফ থেকে ছিল, তুমি হয়তো পার্স আনোইনি।” কিন্তু দাদা খুব জোর দিয়েই পার্স সঙ্গে আনার কথাই বললো। কিন্তু কিছু করার নেই দেখে অগত্যা রেস্তোরাঁর বয়কে ঘটনাটা জানিয়ে তার ফোন নম্বরটা নিয়ে গেস্টহাউসের দিকে রওনা হলাম। কলিগদাদার ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে এলেই কেন জানিনা এমনটা হয়। এর আগেও দুবার এমন ঘটনার কথা বলেছি আমার এ বিবরণীতে। গেস্টহাউসে পৌঁছে প্রথমে দাদার ঘর তন্নতন্ন করে খোঁজা হলো। তারপর একে একে আরও তিনটি ঘরে চলল চিরুণী তল্লাশি। কিন্তু না, কোত্থাও নেই। আবার রেস্তোরাঁর বয়কে ফোন করা হলো। এবারে আমরাও শিওর যে ওটা ওখানেই মিসিং। বয় আবারও খুঁজতে গিয়ে চেয়ারের নীচ থেকে উদ্ধার করে ফোনে জানালো। আমাদের এক কলিগবন্ধু মঙ্গলদৈ থেকে স্কুটি নিয়ে এসেছিল ভাগ্যিস। সেই স্কুটিতে চেপে দুজনে উদ্ধার হওয়া পার্স আনতে গেলো। সারাদিন ব্যস্ততার মধ্যে কেটে যাওয়ায় আমি বাড়িতেও ফোন করিনি। খোলা আকাশের নীচে শীতের হিম গায়ে মেখে একটু ফোন করে নিলাম। সায়েন্স সেন্টারের নতুন বিল্ডিং উদ্বোধন হয়েছে। ওখানেই এবারের ইনোভেশন ফেস্টিভ্যাল সম্পন্ন হয়েছে। এখনও কিছু সাইনবোর্ড সে স্মৃতি ধরে রেখেছে। ফোনও শেষ হলো, ওরাও চলে এলো। এদিকে যাওয়ার সময় দাদাকে খুব টেন্সড লাগলেও আসার সময় বেশ ফুরফুরে লাগলো। তারমানে পার্স ফিরে পেয়েছে। এদিকে হারানো প্রাপ্তির আনন্দে আর এক কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছিল প্রায়। যাওয়ার সময় কলিগবন্ধু স্কুটি চালালেও ফেরার সময় দাদাই চালাচ্ছিল। দাদা জাওয়া ক্লাসিক বাইক চালিয়ে অভ্যস্ত। বাইকে যা হয়, বাঁ হাতে থাকে ক্লাচ। আর ক্লাচকে তো পুরো টিপতে হয়। এদিকে স্কুটির বাঁ হাতে থাকে পিছনের ব্রেক। দাদা অভ্যাসবসত বাঁ হাতের ব্রেককে ক্লাচ মনে করে পুরো টিপে দিয়েছে। ভাগ্যিস গতি কম ছিল। ইনস্ট্যান্ট ব্রেক চেপার ফলে গাড়ি ছেঁচড়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। যাক বড় কোন কিছু হয়নি এটাই রক্ষা। এরপর সবাই যে যার ঘরে চলে গেলো। পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে চলে এলাম কনফারেন্স রুমে। ১৫ই ফেব্রুয়ারি অসমের একটি বিশেষ দিন। এই দিনটায় ওখানকার “মিসিং” জনজাতি ও অন্যান্যদের একটি বসন্ত উৎসব পালিত হয়। আহু ধানের চারা রোপণের মধ্য দিয়ে এই আনন্দানুষ্ঠানের সূচনা হয়। একে বলে আলি আঃয়ে লৃগাং। স্থানীয় কলিগ তথা আমাদের সেকেণ্ড বস সে কথাই জানালেন আমাকে। এবারে তিনি আমাদের সাথেই গেস্ট হাউসে ছিলেন। অনেক কোয়ালিটি টাইম স্পেণ্ডের পাশাপাশি আমাদের পাওয়ারপয়েন্ট স্লাইড তৈরীতেও সাহায্য করেছেন বড় দাদার মতো। এরপরই চমক ছিল আমার জন্য। সংবর্ধনা পাওয়া যেমন গর্বের তেমনি কাউকে সংবর্ধিত করতে পারাও বেশ আনন্দের। কিন্তু এই কাজটিতে কেন যে বিভিন্ন জায়গায় শুধু মেয়েদেরকেই নির্বাচিত করা হয়! কিন্তু আমাদের সায়েন্টিস্ট স্যারকে সংবর্ধনা জানানোর দায়িত্ব বর্তালো আমার ওপর। অসমীয়া গামুছা (গামছা), যা বর্তমানে GI Tag পেয়েছে, তাই দিয়ে স্যারকে বরণ করে নিলাম আমি। তারপর গতানুগতিক কর্মকাণ্ডে এগিয়ে চললো মিটিং। সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলো আমার প্রেজেন্টেশন। কিন্তু এরপরেও চমক অনেক অপেক্ষা করছিল আমার জন্য। গত বছর সেপ্টেম্বরে হিন্দি দিবসে আমি অংশগ্রহণ করেছিলাম। তার সার্টিফিকেটটাকে রীতিমতো ফ্রেমে বাঁধিয়ে এনেছেন স্যার। স্যার ছিলেন এই হিন্দি দিবসের আহ্বায়ক। উনার হাত থেকেই এই মহামূল্যবান সার্টিফিকেটটি নিলাম। এ আমার পরম প্রাপ্তি। এজন্যই আমার প্রেজেন্টেশনের সময় স্যার বলেছিলেন, “তুমি হিন্দিতে বলতে পারো।” হিন্দিতে আর যাই হোক ইংরেজির থেকেও অনেক বেশি সহজে সবকিছু বোঝানো যায়। আমার মাতৃভাষা না হোক, মাসির ভাষা তো বলা যায়। আজ এই ৭৫ বছর পর ভারতে হিন্দিকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে, অন্যদিকে চলছে হিন্দি থেকে বাঁচার অ্যান্টি ক্যাম্পেইন। অথচ কি অবাক লাগে, স্বাধীনতার লড়াই লড়তে গিয়ে ভগৎ সিং-বটুকেশ্বর দত্ত কথা বলছে হিন্দিতে, হ্যাঁ দুজনেই তাঁদের মাতৃভাষাকে সযত্নে দূরে সরিয়ে রেখেছে। পরস্পরের কথা বুঝতে, বোঝাতে কমন ল্যাঙ্গুয়েজের আশ্রয় নিয়েছে কোন চাপিয়ে দেওয়া ছাড়াই। যাই হোক প্রসঙ্গান্তরে চলে যাচ্ছি। এরপর সব মিটে গেলে আমরা প্রথমে স্যারকে বিদায় জানালাম। তারপর আমি আর কলিগদাদা রওনা দিলাম গুয়াহাটি স্টেশনের উদ্দেশ্যে। ফেরার টিকিটটা আমাদের একসাথেই কেটে রেখেছিলাম সেই কাঞ্চনজঙ্ঘাতেই। এরপর ব্রহ্মপুত্রকে বিদায় জানালাম, আবার আসবো কথা দিলাম। কিন্তু বিদায় জানিয়ে যাবো কই? ভূগোলের পরিভাষায় বলতে হয় ব্রহ্মপুত্র অববাহিকাতেই তো আমার বাড়ি… তিস্তা পাড়, জল শহর।

(ক্রমশঃ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *