৬০ টাকায় বাংলাদেশ – আমার অন্য পথ ~ শান্তনু ঘোষ পর্ব-২

৬০ টাকায় বাংলাদেশ – আমার অন্য পথ
~ শান্তনু ঘোষ
পর্ব-২

আগে যা ঘটেছে:
একটু অন্য ভাবে বাংলাদেশ যাবার পরিকল্পনা করে ফেলেছি। ভিসাপেয়েছি। এবার যাত্রা শুরু করব।
ফ্লাইট বা মৈত্রী নয়। অতি সাধারণ লোকাল ট্রেনে যাবার পরিকল্পনা।

তারপর …

শুক্রবার সকালে শিয়ালদহ ষ্টেশন থেকে ৩০ টাকার টিকিট কিনে গেদে লোকালে উঠে পড়েছি। আজ বাংলাদেশে থাকতে পারলে ভালো হত। ওখানে শুক্রবার ছুটির দিন।

শুনেছি ঢাকা শহর বেড়ানোর জন্য শুক্রবারটা খুব ভালদিন, কারণ রাস্তায় জ্যাম কম থাকে। কিন্তু কৌস্তভ যেমন বলেছে, আমি সেই অনুযায়ী রওনা হলাম।

শিয়ালদহ ষ্টেশনে ট্রেনে তেমন ভীড় নেই। বসার জায়গা পেয়েছি। কিন্তু বিধাননগর ছাড়াতেই ভীড় বাড়তে লাগলো। আমি জানালার পাশে চুপ করে বসে বাইরে-ভিতরে দেখছি।

কত রকমের লোক উঠছে। কত কথা। প্রত্যেকেই কোথাও পৌঁছতে চায়। কিন্তু সেখানে পৌছেই সে থামবে না।তারপর আবার অন্য কোথাও পৌঁছনোর জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠবে। নিরন্তর যাত্রা।
আমিও তাই। গেদে পৌঁছানোর পর, আমাকেও এগিয়ে যেতে হবে।

মাঝে মাঝে ফেরীওয়ালারা উঠছেন। তাদের কি সুন্দর মার্কেটিং টেকনিক। বিজনেস স্কুলের ম্যানেজমেন্ট ছাত্ররা এঁদের স্ট্রাটেজি স্টাডি করতে পারেন।

ট্রেন সময় মত চলছে। আমার উল্টোদিকের সিটে এক বিবাহিতা সুন্দরী যুবতী। এবার তিনি উঠে ভীড় ঠেলে নামার উদ্যোগ নিয়েছেন। সামনে একজন লোককে তার পা সরাতে বলাতে লোকটি বললেন, এই ভীড়ে কোথায় পা সরাব, পা কি হাতে নিয়ে দাঁড়াবো নাকি ?

ব্যস, সুন্দরী এবার সৌন্দর্য খসিয়ে তাঁর শব্দ-অগ্নিবাণ প্রয়োগ করছেন।

ঠিক সেই সময় একজন হেঁকে উঠল, নিয়ে যান ১২টা ৬০ টাকায়। তার পাশেই আর একজন চিৎকার করছেন, পেটে-বুকে জ্বালা, অম্বলের কষ্টের অব্যর্থ বটিকা, মাত্র ১০ টাকায়। হাতে নিয়ে দেখুন। দেখতে পয়সা লাগে না।

আর একজন কটকটি বিক্রী করতে করতে ভীড় ঠেলে এগোচ্ছেন। যেতে যেতে বললেন, আজ শুক্রবার, তাই এত ভীড়। আমি এই কথার অর্থ বুঝলাম না।

ট্রেন এগিয়ে চলেছে। কল্যাণী পার করল। রানাঘাট এল। এরপর ছোট-বড় অনেকগুলো ষ্টেশন। ধীরে ধীরে কামরা ফাঁকা হয়ে এলো। বুঝলাম গেদে আসছে। আমি এর আগে কখনো এই লাইনে আসিনি। সব কিছুই প্রথম দেখছি।

গেদে ষ্টেশনে ট্রেন থামলে অল্প কিছু যাত্রী নামল। ষ্টেশন একরকম ফাঁকাই আছে। বিক্ষিপ্ত কয়েকজন দেখলামসুন্দর পোশাক পরিহিত, হাতে বেশ মালপত্র। দেখে মনে হচ্ছে বেড়াতে যাচ্ছে। বুঝলাম এরাও হয়ত বাংলাদেশ যাবেন।

প্ল্যাটফর্মে দেখলাম কিছু লোক ইতিউতি দেখছে আর লোক বুঝে কাছে গিয়ে আস্তে আস্তে কিছু বলছে। পরে বুঝলাম এরা এজেন্ট।

প্ল্যাটফর্ম থেকে নামতেই বাঁদিকে দেখতে পাচ্ছি ইমিগ্রেশন অফিস। খুবই সাদামাটা। আমি কাউকে কিছু না জিজ্ঞেস করেই বীরের মত সেখানে ঢুকে গেলাম। কিন্তু এখানকার ইমিগ্রেশন অফিসে কি এবং কিভাবে করতে হবে তাতো ঠিক জানিনা। তাই একটু নার্ভাস বোধ করছি। পাসপোর্ট বার করতে হবে জানি। কিন্তু নার্ভাস হয়ে গেছিমনে হয়, তাই পাসপোর্ট খুঁজে পাচ্ছি না।

তখন দেখি আমার সামনেই কাউন্টারে দুজন ভদ্রলোককে ইমিগ্রেশন অফিসার কি সব মানা করে দিলেন। বললেন কাউন্টার ছেড়ে দূরে চলে যেতে। এই দেখে আমি আরো ঘাবড়ে গেলাম। ভাবছি আমাকেও তাড়িয়ে না দেয়। যদিও তার কোন কারণ নেই। তাও সরকারী ব্যাপার কখন কোন নিয়মের জালে আটকে দেয় কে জানে।

ইতিমধ্যে ব্যাগের এই পকেট, সেই পকেট খুঁজে পাসপোর্টটা পেয়েছি। বুকে বল এলো। পাসপোর্ট এত সাবধানে রেখেছি যে সময়কালে খুঁজেই পাচ্ছিলাম না।

এমনিতে তেমন ভীড় নেই, তাও পাশের কাউন্টারটা ফাঁকা দেখে সেখানে এসে দাঁড়িয়েছি। ভিতরে বেশ ভদ্র গোছের হাফ গম্ভীর একজন মাঝ-বয়সী অফিসার বসে কম্পিউটারে কাজ করছেন।

আমার আগেরজনকে কত প্রশ্ন করছেন। কেন যাবেন বাংলাদেশ, কোথায় যাবেন, কে আছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর পাসপোর্টটা ফেরত দিয়ে বললেন কি সব সমস্যা আছে তাই ওনার ইমিগ্রেশন হবে না।

এই দেখে আমি আবার ঘাবড়ে গেলাম।
এবার আমার পালা।

ভয় লুকিয়ে বেশ সপ্রতিভ মুখ করে দু-আঙুলের মাঝে পাসপোর্টটা ধরে কাউন্টারের ফোঁকর দিয়ে এগিয়ে দিলাম। ভাবটা এমন যেন রোজই তো যাই বাংলাদেশ।

কিন্তু এসব উপর চালাকি তো এখানে করে লাভ নেই। এঁরা অভিজ্ঞ মানুষ, লোক চেনেন। তার সঙ্গে আছে কম্পিউটার তথ্য। আমার ঠিকুজি-কুষ্টি বলে দেবে।

ভাবছি আমাকে এবার কি জিগ্গেস করবেন। ভদ্রলোক জিগ্গেস করলেন, এটাই কি আমার প্রথম বাংলাদেশ যাত্রা ?

উত্তর, হ্যাঁ।
– কেন যাচ্ছেন ?
– ঘুরতে।
– কি করেন ?
– সরকারী চাকুরী
– কোথায় ?
উত্তর দিলাম। ম্যাজিকের মত কাজ হল।
আর কোন প্রশ্ন নেই।

বেশ একটা সম্মানসূচক মৃদু হেসে,খটখট করে কম্পিউটারে কিসব করে, ছাপ মেরে আমাকে পাসপোর্ট ফেরত দিয়ে বললেন, থ্যাংক ইউ। আমিও প্রতি ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এলাম। এত সহজে কাজ হবে ভাবতে পারিনি।

বেরোনোর সময় দেখলাম এক কোণে ওই দুই ভদ্রলোক তখনো দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের কাজ হয়নি। বাংলাদশ যাওয়া অনিশ্চিত।

আমার এবার কাস্টমস চেক করাতে হবে।

ক্রমশঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *