সম্পাদকীয় পুঁথিদাদু, কলমে গীতশ্রী সিনহা

সম্পাদকীয়

পুঁথিদাদু

হ্যাঁ বন্ধুরা, ইনি পুরুলিয়ার এক মহান মানুষ।
আড়ালেই রয়ে গেছেন, কেউ খোঁজ রাখেন না …

প্রায় বছর সাতেক আগে এমন এক মহান মানুষের সন্ধান পাওয়া যায় — যাকে আশপাশের গ্রামের মানুষের কাছে তিনি ‘পুঁথি দাদু’ নামে পরিচিত! গ্রামের আট থেকে আশি , সবার কাছে তিনি এই নামেই পরিচিত। হয়ত আজও তিনি একইভাবে চারপাশের গ্রামের গরিব শিক্ষার্থীদের কাছে নয়নের মণি হয়েই আছেন। কাদের যেন ‘বাংলার রত্ন’ দেওয়া হয় ? কিন্তু আসল ‘রত্ন ‘ যে গ্রামের কোন গভীরে লুকিয়ে থাকে, ক’জন সে খবর রাখে ? আজ সেই ‘পুঁথিদাদু’ – র গল্প শোনাই!

নিজে স্কুলের গণ্ডি পার হননি ৷ অথচ পড়ান কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের। ভাবা যায়! পেশায় কৃষক এই ‘পুঁথিদাদু’র কাছে পড়তে আসেন স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের ছাত্রছাত্রীরা৷ এহেন মানুষটির পড়াশোনা কিন্তু সপ্তম শ্রেণী অবধি৷ ছাত্রছাত্রীদের অনায়াস দক্ষতায় যখন সাহায্য করেন, তখন কে বলবে প্রথাগত শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই তাঁর ?

‘জ্ঞান’ যে প্রথাগত শিক্ষার ধার ধারে না, বোধহয় তিনি যেন এক জলজ্যান্ত উদাহরণ!

কেউ তাঁকে বলেন ‘পুঁথিদাদু’ আবার কেউ বলেন, তিনি হলেন –
‘চলমান এনসাইক্লোপিডিয়া’৷ নিন্দুকেরা তো আবার তাঁকে ‘ ‘বইপাগল ‘ – ও বলেন! তাঁর আসল নাম — গুরুচরণ গড়াই ! তবে সেই নামে খোঁজ করলে অবশ্য ৭৭ বছরের এই বৃদ্ধকে চিনতে পারবেন না প্রায় কেউই ৷

পুরুলিয়ার বাঘমুণ্ডি থানার ‘বুড়দা’ গ্রামের এই মানুষটাকে শুধুই ‘পুঁথিদাদু’ নামে এক ডাকে চেনেন ব্লকের প্রায় সকলেই৷ আর চিনবে না-ই বা কেন ? সাহিত্য হোক বা ব্যাকরণ, দর্শন হোক অথবা সাধারণ জ্ঞান – এসব বিষয় নিয়ে পড়ুয়াদের মুশকিল আসান ‘পুঁথিদাদু ও তাঁর গ্রন্থাগার’!

প্রায় ১৬-১৭ বছর বয়সে পুরুলিয়ার বাগমুন্ডির ‘বুড়দা’ গ্রামের ‘পুঁথিদাদু’ ধরলো বইয়ের নেশায়। ছোটবেলা থেকেই তিনি নতুন বইয়ের গন্ধে পাগল হয়ে যেতেন। কিন্তু বেশি বই কেনার পয়সা ছিল না। স্কুলে পড়ার সময় গ্রামে কারোও নতুন বই এসেছে শুনলেই ছুটে যেতেন। মাত্র এগারো বছর বয়সেই পিতৃহারা হন। অল্প বয়সেই সংসারের দায় এসে পড়ে তাঁর কাঁধে। মাঠে লাঙল দিতে গিয়েও মন পড়ে থাকতো সেই গল্পের পাতায়। ধান বিক্রি করে তিনি নতুন বই কিনতেন।

জন্মের পর কোনদিন ঠাকুরদাকে দেখেননি। কিন্তু তাঁর লেখা পড়েই সাহিত্য ও পড়াশুনার প্রবল আগ্রহ জন্মায় ‘পুঁথিদাদু’র। তাঁর দাদু ছিলেন গদাধর গরাঁই। তিনিও ছোট গল্প লিখতেন। যদিও সেই লেখাগুলো ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়নি কোনোদিনও। তবু এই বইগুলো ছিল তাঁর প্রেরণা। ঠিক করেন বিভিন্ন বই জোগাড় করে গ্রামের মানুষদের জন্য লাইব্রেরি বানাবেন। সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন ‘চৈতন্য গ্রন্থাগার’৷ শুরু করলেন ১০০ টি বই নিয়ে , তারপর বইয়ের সংখ্যা এক হাজারেরও বেশি হয়ে দাঁড়ালো বেশ কয়েক বছরেই! কিন্তু বই রাখার কোনো জায়গা ছিল না, তাই জ্যেঠুর কাপড়ের দোকান থেকে আলমারি কিনে বই রাখতে শুরু করেন।

সেখানে গেলেই বই পড়তে পাওয়া যায় সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে৷ পড়াশোনায় সাহায্যের জন্য ‘পুঁথিদাদু’ প্রস্তুত সবসময়৷ কোন বইয়ের কোন পাতায় কী লেখা রয়েছে — সবই নখদর্পণে তাঁর! টিউশনের পয়সা পুরোটাই প্রায় খরচ হয়ে যায় সেই গ্রন্থাগারের পিছনেই৷ নিজেই জানালেন তাঁর নিজের ছোটবেলার কথা৷ মাত্র ১১ বছর বয়সে বাবা মারা গিয়েছিলেন৷ সংগ্রামের সেই শুরু। কিন্তু ভাঁটা পড়েনি বইপ্রীতিতে৷ অভাবে স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। চেয়ে চিন্তে বই আনতেন গুরুচরণ। মা ফুটিবালা নিরক্ষর হলেও বইয়ের কদর জানতেন৷ হতদরিদ্র পরিবারে ধান বিক্রির টাকায় কেনা হত বই৷ ১৯৫০ সালে স্কুলে যাওয়া বন্ধ হওয়ার বছর তিনেক পর ১৯৫৩ সালে নিজের বাড়িতে গ্রন্থাগার গড়ে তোলেন গুরুচরণ , তিনি নিজেই — যার নাম দেন ‘চৈতন্য গ্রন্থাগার’ ! চাষের কাজের পাশাপাশি চলতে থাকে বই সংগ্রহের কাজ৷ সেই সঙ্গে পড়াশোনা৷ একটু স্বাচ্ছন্দ্যের আশায় ছাত্রছাত্রীদের পড়াতে শুরু করেন৷ লোকমুখে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগেনি৷ এখানেই শেষ নয়, সাহিত্যচর্চাও করেন গুরুচরণ৷ ‘কোরক’ নামে একটি কাব্যগ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে তাঁর৷

গুরুচরণের দুই ছেলেও চাষবাস করেই সংসার চালান৷ সংসারে টানাটানি থাকলে কি হবে, বাবাকে উত্‍সাহ জোগান তাঁরা৷ ‘পুঁথিদাদু’র বড় ছেলে শিবরাম গড়াই জানালেন, যতই দারিদ্র থাকুক, বাবাকে বাধা দেওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই৷ একমুখ খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। পরনে আধময়লা সাদা ধুতি৷ নিতান্তই সাধারণ চেহারার মানুষটা যে এমন অসাধারণ সাধনায় মেতে রয়েছেন, তা নিয়ে গর্বিত প্রতিবেশীরাও৷ ‘বুড়দা’ গ্রামের বাসিন্দা প্রাক্তন বিধায়ক তথা ফরওয়ার্ড ব্লকের রাজ্য কমিটির সদস্য নিশিকান্ত মেহেতা বলেছিলেন , ‘পুঁথিদাদু ও তাঁর লাইব্রেরি না থাকলে এলাকায় এত দ্রুত শিক্ষার প্রসার ঘটত না৷ এখানে এমন কেউ নেই, যিনি পড়াশোনায় পুঁথিদাদুর সাহায্য নেননি।’ অথচ কেন যে এমন একটি মানুষ সরকারি সহায়তা পাননি, — তার জবাব অবশ্য নেই প্রাক্তন বিধায়কের কাছে৷ ‘চৈতন্য গ্রন্থাগারে’ বিদ্যুত্‍‌ সংযোগ নেই৷ খরচ জোটাতে পারেননি বইপাগল গুরুচরণ৷ অন্ধকার নামলেই , লাইব্রেরিতে জ্বলে ওঠে কুপি৷ কালো অক্ষরে ডুবে যান ‘পুঁথিদাদু’৷
না -পাওয়ার ক্ষোভ নেই কোনও৷ অন্ধকার লাইব্রেরিতে বসে বললেন, “কিছু না পাই৷ জ্ঞানের আলো তো ছড়িয়ে দিতে পেরেছি৷”

‘পুঁথিদাদু’র ছোট ছেলে হরেরাম বাবু দেখিয়েছিলেন , পুঁথিদাদু আর্যশাস্ত্র মহাভারত – এর চারটা পাতা ইঁদুরে কেটে দেওয়ার পরেও কীভাবে পুঁথিদাদু সেই পাতাগুলো নিজের হাতের লেখা দিয়ে মিলিয়ে দিয়েছেন। অন্য আরও বেশ কয়েকটি বইয়ের নষ্ট হয়ে যাওয়া পাতা তিনি নিজে লিখেছিলেন। ‘পুঁথিদাদু’র লাইব্রেরিতে রয়েছে পুরোনো নানা দুর্লভ বই। রয়েছে রামায়ণ,মহাভারত,বাইবেল, নানা লেখকের বই। প্রায় তিরিশ রকমের গীতা রয়েছে।
এছাড়াও ইতিহাস,সংস্কৃত,বাংলা ব্যাকরণ, রবীন্দ্র সমালোচনার নানা গ্রন্থ রয়েছে। তাঁর লাইব্রেরিতে সবচেয়ে পুরানো বই ‘চৈতন্য চরিতামৃত’। এ ছাড়াও নানান প্রকাশকের বই রয়েছে।

যারা বইমেলা করেন , তারা কি শুধুই বইয়ের ব্যবসা করেন না কি বইপ্রেমীদের উদ্দেশ্যে কিছু বার্তা দিতে চান ? তাদের সংবর্ধনা আসরে অনেক লেখক – কবিদের তো সম্মান করতে দেখি ! তো বাংলার প্রান্তে যে এমন এক মহান বইপ্রেমী দীর্ঘদিন ধরে গরিব শিক্ষার্থীদের মনের মানুষ হয়ে আছেন — সে খেয়াল তো কেউ রাখেন না ?

খুঁজে পাওয়া লেখা, এবার সম্পাদকীয় কলমে সমৃদ্ধ করেছে।
৷ গীতশ্রী সিনহা । শুভেচ্ছান্তে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *